সমগ্র বাস্তুতন্ত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন গভীর বিপদের মুখোমুখি
Plastic

প্লাস্টিক নামক ব্যাধি

১৯০৭ সালে লিয়ো বেকল্যান্ড যখন কৃত্রিম প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন তখন তিনি নিশ্চয়ই ভাবেননি, তাঁর এই আবিষ্কার সভ্যতার এত বড় সঙ্কট হয়ে দেখা দেবে।

Advertisement
কল্যাণ রুদ্র
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৩ ০৬:০৭
An image of Plastics

—প্রতীকী চিত্র।

আমাদের জীবনশৈলীকে বহুলাংশে বদলে দিয়েছে প্লাস্টিক। সকালে দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে শুরু করে সারা দিনে আমরা যা কিছু ব্যবহার করি, তার অধিকাংশই প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের অনেক গুণ— এটি জলনিরোধক, হালকা এবং নানা রূপ ও আকারে পরিবর্তনযোগ্য। এই উপাদানটি ছাড়া আমাদের জীবন অচল। কিন্তু প্লাস্টিকের বড় দোষ হল, এটি ‘বায়োডিগ্রেডেবল’ বা জৈব প্রক্রিয়ায় পচনশীল নয়। নানা ধরনের ব্যবহার্য প্লাস্টিক দ্রব্যের বেশির ভাগই ‘সিঙ্গল ইউজ়’, অর্থাৎ সেই দ্রব্যগুলিকে আমরা এক বার ব্যবহার করে ফেলে দিই। ভারতে ১২০ মাইক্রনের চেয়ে পাতলা প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও প্যাকেজিং-এর কাজে প্লাস্টিক ব্যবহারে কোনও বিধিনিষেধ নেই। তাই টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ও নানা ধরনের খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদির প্যাকেজিং-এ প্লাস্টিক বা থার্মোকলের একচ্ছত্র আধিপত্য। পৃথিবীতে যত প্লাস্টিক-বর্জ্য জমা হয় তার ৫০% হল প্যাকেজিং-এ ব্যবহৃত মোড়ক। সেই বর্জ্য হাজার বছর মাটি, জল ও বাতাসে থেকে যাবে। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্যে ঢেকে যাচ্ছে পৃথিবীর মাটি, নদী এবং সাগর; বাতাসেও ভাসছে অসংখ্য মাইক্রোপ্লাস্টিক। সমস্যা এতটাই গভীর যে, মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি) আবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসের পুরনো স্লোগানটি ফিরিয়ে আনল— ‘প্লাস্টিক-দূষণকে পরাজিত করুন’। এখন সারা বিশ্বে প্রতি মিনিটে ২০ লক্ষ প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয় আর প্রতিটি ব্যাগের আয়ুষ্কাল মাত্র ১২ মিনিট; এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে ১২০ কোটি টন প্লাস্টিক-বর্জ্য আমাদের বাস্তুতন্ত্রে ছড়িয়ে যাবে। এই বর্জ্যের তালিকায় আছে প্লাস্টিকের থলি, থার্মোকল, বোতল, থালা-বাটি-চামচ, স্ট্র, এবং আরও অনেক ফেলে-দেওয়া দ্রব্য।

১৯০৭ সালে লিয়ো বেকল্যান্ড যখন কৃত্রিম প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন তখন তিনি নিশ্চয়ই ভাবেননি, তাঁর এই আবিষ্কার সভ্যতার এত বড় সঙ্কট হয়ে দেখা দেবে। দোষ স্রষ্টার নয়, দোষ আমাদের মতো উপভোক্তার। প্লাস্টিক বা পলিইথিলিন অপরিশোধিত পেট্রোলিয়াম দিয়ে তৈরি এক যৌগ, যার মধ্যে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ইত্যাদি উপাদান মিশে থাকে। ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ৮৩০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়েছিল, এবং এর ৭৯% বর্জ্য হিসাবে কলকাতার ধাপার মতো নানা ল্যান্ডফিলে জমে আছে, বা জলে-মাটিতে ছড়িয়ে আছে; ১২% পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আর মাত্র ৯% পুনর্ব্যবহৃত হয়েছে।

Advertisement

১০৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম উত্তাপে প্লাস্টিক জ্বালানো হলে ডাইঅক্সিন ও ফিউরান গ্যাস বাতাসে মেশে আর ওই বিষ শ্বাসবায়ুর সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে ক্যানসারের মতো মারণরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। পেট্রোলিয়াম-জাত বলে প্লাস্টিক-বর্জ্য থেকে রিফিউজ়ড ডিরাইভড ফুয়েল (আরডিএফ) তৈরি করা যায়; প্লাস্টিককে ছোট ছোট টুকরো করে সিমেন্টের কারখানায় জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয়; আবার বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেলও নিষ্কাশন করা যায়। দুর্গাপুরের সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এ এই কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এই তেল পেট্রল বা ডিজ়েলের বিকল্প হিসাবে কতটা নিরাপদ, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন। তবে মেশিনের লুব্রিক্যান্ট বা রোলিং মিলে জ্বালানি হিসাবে ওই তেল ব্যবহার করা যায়।

এই সময় পরিবেশের দু’টি গভীর সঙ্কট হল লাগামছাড়া ভূ-উষ্ণায়ন ও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। এই সমস্যা দু’টি পরস্পর সংশ্লিষ্ট। প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ও বর্জ্য থেকে বছরে ৮৫ কোটি টন গ্রিনহাউস গ্যাস বাতাসে মেশে। আমরা যদি এখনও সংযত না হই, তা হলে ২০৫০ সালে ওই গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে হবে ২৮০ কোটি টন। আমাদের ফেলে দেওয়া ১.২৭ কোটি টন প্লাস্টিক-বর্জ্য নদী-নালা হয়ে প্রতি বছর সাগরে চলে যাচ্ছে। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে প্লাস্টিক জমে ১৬০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার, অর্থাৎ ভারতের মোট আয়তনের প্রায় পাঁচ গুণ, বিস্তৃত এমন এক মৃত এলাকা বা ‘ডেড জ়োন’ তৈরি হয়েছে, যেখানে কোনও প্রাণী বাঁচতে পারে না। বিজ্ঞানীরা এই ধরনের বন্ধ্যা এলাকার নাম দিয়েছেন ‘প্লাস্টিস্ফিয়ার’। তিমি, হাঙর, কচ্ছপ, ডলফিন, মাছ ইত্যাদি সামুদ্রিক প্রাণীরা ভুল করে প্লাস্টিক গিলে ফেলে— আর দু’তিন দশকের মধ্যে ৯০% সামুদ্রিক পাখির পেটে প্লাস্টিক পাওয়া যাবে, ৬০০ প্রজাতি নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ১৫% প্রজাতি বিপন্ন হবে। প্লাস্টিক-বর্জ্য প্রতি বছর সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি করে, তার আর্থিক মূল্য ১৩০০ কোটি আমেরিকান ডলার।

প্লাস্টিক উন্মুক্ত প্রকৃতিতে রোদ, জল ও বাতাসের প্রভাবে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। জলে ভেসে থাকা বা বাতাসে ভাসমান এই মাইক্রোপ্লাস্টিক খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করে। আমেরিকার মিনেসোটা স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড-লাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) এবং অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, পৃথিবীর ৮৫% কলের জলে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। এক জন মানুষের দেহে পানীয় জল ও নিঃশ্বাসের সঙ্গে প্রতি মাসে ২১ গ্রাম অর্থাৎ বছরে ২৫০ গ্রাম মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকছে। এই বিষ আমাদের দেহের কত রকম ক্ষতি করতে পারে, তা এখনও গবেষণার বিষয়।

সম্প্রতি প্রকাশিত নীতি আয়োগের রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে যে, ভারতে প্রতি বছর ৩৪ লক্ষ টন প্লাস্টিক-বর্জ্য তৈরি হয়। আমাদের রাজ্যে হয় তিন লক্ষ টন। ২০১৬ সালে দেশে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন চালু হয়েছে, পরে ২০২১ ও ২০২২ সালে দু’বার ওই আইন সংশোধিত হয়েছে। আইন অনুসারে প্লাস্টিকের উৎপাদককেও তাঁর উৎপাদিত বা বিক্রীত দ্রব্যের আয়ুষ্কাল শেষ হলে তা ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্ব্যবহার করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে ১০টি সংস্থা এখন প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের কাজে নিযুক্ত আছে। মহামান্য পরিবেশ আদালতের নির্দেশে রাজ্যের নানা শহরে জমে থাকা ১০৭টি জঞ্জালের স্তূপে বায়োমাইনিং অর্থাৎ নানা বর্জ্য উপাদানকে সম্পদে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছে; তৈরি হচ্ছে জৈব সার, জ্বালানি বা আরডিএফ, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি। বিটুমেনের সঙ্গে প্লাস্টিক মিশিয়ে বর্ধমান থেকে বোলপুর যাওয়ার ৩০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মিত হয়েছে; আরও কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

২০২৩ সালে দেশব্যাপী ‘মিশন লাইফ’ নামে এক প্রকল্প চালু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশ-বান্ধব জীবনশৈলীতে দীক্ষিত করাই মিশন লাইফ প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এই বিপন্ন বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করতে চারটি মন্ত্র মেনে চলা জরুরি। প্রথমত, এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থলি পরিত্যাগ করে আবার পাটের বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করা; দ্বিতীয়ত, যত দূর সম্ভব প্লাস্টিক কম ব্যবহার করা; তৃতীয়ত, অপেক্ষাকৃত পুরু প্লাস্টিকের থলি ধুয়ে ও শুকিয়ে আবার ব্যবহার করা; এবং চতুর্থত, প্লাস্টিক-বর্জ্যকে আবার অন্য রূপে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা। ‘বাস্তুতন্ত্রকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব আমার নয়, অন্য কেউ ওই দায় পালন করবে’, এই মানসিক ব্যাধি থেকে আমাদের এ বার মুক্ত হতে হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement