মৃত্যুশোকের ওপারে
Coronavirus

স্মৃতির ঘর, একাকী যাপন: এই নিয়েই তো আজ সন্তাপের দিন

একাকী যাপনের নির্যাসটুকু সঙ্গে করে যদি সম্মিলনে যাই, নিজস্ব সন্তাপের ভিতরে যে আলো, তাই যদি জনে জনে বলি, সে বোধ হয় বেশি ভাল হয়।

Advertisement
সুমিত চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২১ ০৭:৩০

বার্গম্যানের ছবি দি সেভেন্থ সিল এর সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলায় ক্ষণিক বিরতি। আন্তোনিউস ব্লক গির্জায় এসেছেন। দাঁড়িয়েছেন পাদরির অপর দিকে, স্বীকারোক্তির কক্ষে। ঈশ্বর, বিশ্বাস, জীবনলব্ধ শূন্যতা, ভয়, এই সব বিষয়ে নাগাড়ে বলে চলেছেন খাঁচার ওপারে বসে থাকা ঈশ্বরের প্রতিনিধির কাছে। বলছেন— দাবা খেলায় বিরতির কথাও। খেলায় ফিরে গিয়ে কী উপায়ে মৃত্যুকে জব্দ করবেন সেই চাল শুনিয়ে রাখছেন পাদরিকে। পাদরির বেশে তো মৃত্যু স্বয়ং। বলছেন “তোমার এই চাল আমি মনে রাখব। দেখা হচ্ছে সত্বর।”

গত কয়েক মাস, বছর ঘুরে আমাদের এমন নিশ্চিত প্রতীতি হয়েছে যে, মৃত্যু আমাদের সমস্ত কূট চাল কেমন করে জেনে নিয়েছে। অথবা, হয়তো তার জানাই ছিল। চিরকাল এমনই ছিল, দেশ কাল ছাপিয়ে। রাজনীতি, ক্ষমতা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সব ছাপিয়ে নিমেষে জীবনকে ধূলিসাৎ করতে পারে— এমনই প্রতিপক্ষ সে। নির্বিকার, অচঞ্চল। কেমন করে আমাদের ঘর খালি হয়ে গিয়েছে ক্রমাগত। মনে হয়, কেমন অকারণে চলে গিয়েছেন আমাদের পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, সঙ্গী, প্রেমিকা। প্রিয় মাস্টারমশাই। ‘ছিল নেই, মাত্র এই’। একটা কালো জাদুর মঞ্চের সামনে বসে রয়েছি আমরা, আর আমাদের চেনা পৃথিবীর পরিচিত নিশ্চিন্ত পরিসর ক্রমশ ফাঁকা হয়ে চলেছে। আর আমরা যারা রয়ে গেলাম, এখনও রয়েছি, নিজেদের আড়াল করে রাখছি আরও। না, শুধু মৃত্যুর থেকে নয়, নিজেদের পরিচিত গণ্ডির থেকেও, আরও সব মানুষের, সম্পর্কের, ভালবাসার থেকেও। একা হয়ে পড়ছি কি নিজেরা, ক্রমাগত?

Advertisement

অথচ, আমরা যদি এই মারির ঝড়ের বাইরে গিয়ে দাঁড়াই খানিক? যদি আমাদের এই বেঁচে থাকাকে জরিপ করি আরও খানিক মনোযোগ দিয়ে? তার দাবার ঘুঁটি নিয়ে মৃত্যু তো সব সময়ই ছিল। অকালে আমাদের বন্ধুহীন করার জন্য, প্রিয়জনের নিশ্চিন্ত প্রশ্রয়, অনির্ণীত ঝগড়া, অভিমানের অব্যক্ত ক্ষত, অর্বাচীন হুল্লোড়ের সন্ধ্যাবেলা, এই সব অনায়াসে, এক মুহূর্তে স্মৃতির দুয়ারে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য। এই সব যা ঘটে চলেছে, এ নতুন কিছু নয়। আমাদের অভ্যেস আছে, বরং এই যে ঘরের ভিতর একা রয়েছি, আরও বেশি করে তাঁকে পাই যিনি চলে গিয়েছেন সম্প্রতি। ফিরে তো যাবই ভিড়ে, সকলের কাছে, তবু এই স্মৃতির আত্মমগ্নতা এক রকম তর্পণ, এক রকমের মনে রেখে দেওয়া। অতিমারির কাছ থেকে এও আমাদের এক রকম পাওয়া। শঙ্খ ঘোষ লিখে গিয়েছেন, “ততটা নিজস্ব পাবে যতখানি ছেড়ে দিতে পারো।/ কেউ এসে বসেছিল, কেউ উঠে চলে গেল, কেউ কথা বলেনি কখনো/ মন তার চিহ্ন রাখে সবই।” ছেড়ে দিয়েছি বলেই আসলে নিজস্ব করে পাই। মনের ভিতরে চলতে থাকা নিরন্তর সেই সংলাপে একান্ত নিজের করে ধরা দেয় চলে যাওয়া সেই মানুষ। এখানে মৃত্যু অপারগ, আমার মনের অন্দরে দাবার ঘুঁটি আমিই সাজিয়ে নিয়েছি। না, এতে শোকের সান্ত্বনা নেই, তবে সন্তাপের গায়ে স্নেহের স্পর্শ অনুভব করা যায়। প্রত্যেক শোকই একান্ত, তীব্র ভাবে ব্যক্তিগত এই উপলব্ধি থেকে আবার মানুষের সম্মিলনে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত থাকে। একাকী যাপনে সন্তাপ স্তিমিত হয়, একাকিত্ব তাই মনেরও প্রয়োজন হয়।

আসলে স্মৃতির ঘরে মানুষ যে আদতেই একা থাকে, তা কি আমরা জানি না? তা না হলে চারণ পবিত্র হয় কী ভাবে? তবু এই একাকিত্ব নিয়ে আমাদের বড় বালাই। এমন সময়ে বাস করি যখন বিবিধ সমাজমাধ্যম আমাদের কোনও না কোনও জটলার দিকে ঠেলে দেয় ক্রমাগত। এতে কি আমাদের একাকিত্ব কিছুমাত্র প্রশমিত হয়? আমরা কি ব্যক্তিগত শোকের দেওয়াল ফুঁড়ে ওপারে গিয়ে দাঁড়াতে পারি সকলের মাঝে? মনে হয় না। স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর ‘ইউ উইল নট হ্যাভ মাই হেট’ স্মৃতিকথায় লিখছেন আঁতোয়া লেইরিস। প্যারিস শহরে সন্ধ্যাবেলায় বাজনা শুনতে গিয়েছিলেন হেলেন। অকস্মাৎ সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণ। আর ফিরে আসেননি স্বামী আঁতোয়া আর সতেরো মাসের সন্তান মেলভিলের কাছে। প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়, সকলেই সান্ত্বনা দিতে চান দিশাহারা দুটো মানুষকে। আঁতোয়ার মনে হয় সন্তানকে নিয়ে তিনি যেন একটা অলীক চিত্রনাট্যের ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছেন। সকলে সংবেদনশীল, ব্যথিত। বোঝেন সে কথা আঁতোয়া। তবু আশঙ্কা হয়, “হোয়াট উইল হ্যাপেন হোয়েন এভরিওয়ান হ্যাজ় মুভড অন টু অ্যানাদার ফিল্ম? উইল আই বি অ্যালোন হিয়ার ইন মাই অ্যাবানডনড্ সেট?”

বরং একাকী যাপনের নির্যাসটুকু সঙ্গে করে যদি সম্মিলনে যাই, নিজস্ব সন্তাপের ভিতরে যে আলো, তাই যদি জনে জনে বলি, সে বোধ হয় বেশি ভাল হয়। অনেকটা কবিতাজীবন ধরে মৃত্যু যাকে তাড়িয়ে বেড়ালো, সেই ভাস্কর চক্রবর্তী লেখেন, “মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতেও আমি বেঁচে আছি বটে।/ কোথায় বেটোফেনের চিঠিপত্র/ আমি আর এক বার ওই সব পড়ে দেখতে চাই।/ আমার পুরনো জীবন আমি/ ভাঁজ করে রেখে দিতে চাই সুটকেশে। ভাবতেই পারি না/ কী শান্ত আর সুন্দর আর পবিত্র থাকি/ আমি যখন তোমার কাছে যাই।” এই যে সুটকেসে গুছিয়ে তুলে রাখা পুরনো জীবন এই তো স্মৃতির সেই ঘর। বার বার ফিরে যেতে হবে তার কাছে। মৃত্যুও রয়েছে তার ভিতরে স্বাভাবিক। আর মৃত্যুর কথা ভাবতে ভাবতেই তো বেঁচে থাকি প্রতি দিন। যে চলে গিয়েছে, যার সঙ্গে দেখা হবে না আর কোনও দিন, সে তো ওই একান্ত ব্যক্তিগত বাক্সে রয়ে গিয়েছে। ওই বাক্স হাটে উজাড় করে পাওয়া যাবে না কিছুই, বরং একাকী, অন্তরালে তার থেকে যতটুকু পাওয়া গেল, সেটুকু ছেনে নিয়ে যদি মানুষের মাঝে ফিরে যাই? তা হলে হয়তো বেঠোফেনের চিঠির অনুষঙ্গ খানিক ভাগ করে নেওয়া যাবে। তাই বুঝি বাবার মৃত্যুর পর পল অস্টার একলা ঘরে বসে লিখে ফেলেন আস্ত একটা স্মৃতিকথা, দ্য ইনভেনশন অব সলিচ্যুড। বহু দিন ধরে, ধীরে ধীরে লেখেন। বলেন মনের ভিতরে দেহকে আত্মস্থ করে নেওয়ার কথা। আর স্মৃতির বাক্স উপুড় করে দেওয়া, “মেমরি: দ্য স্পেস ইন হুইচ আ থিং হ্যাপেনস ফর দ্য সেকেন্ড টাইম।” এই স্মৃতিকে লালন করতে হয় আড়ালের যত্ন দিয়ে, নিভৃতে। তবে তো শোকের ওপার দেখা সম্ভব।

প্রিয়জনের ছেড়ে যাওয়াকে একটা গ্রহের অকস্মাৎ হারিয়ে যাওয়ার মতো মনে হয় রডরিগো গার্সিয়া। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের পুত্র। মা আর বাবা দু’জনের কথাই লিখছেন তাঁর স্মৃতিচারণ আ ফেয়ারওয়েল টু গাবো অ্যান্ড মার্সিডিস বইয়ে। বলছেন, একটা প্রতিধ্বনি রয়ে যাওয়ার কথা: ‘দি একো রিমেনস’। বলছেন, প্রতি দিন স্নানের সময় তোয়ালে দিয়ে পিঠ মোছার সময় মনে পড়ে বাবার কথা। আর মায়ের কথা মনে হয় প্রতি বার অলিভ অয়েল ব্যবহার করবার সময়। কী অদ্ভুত চারণ! আসলে ব্যক্তিগত, তাই অদ্ভুত। এর থেকেই পাঠককে খুঁজে নিতে হবে সেই গ্রহের হারিয়ে যাওয়ার বোধ। প্রতি দিনের এই একান্ত মনে পড়ার ভিতরেই তো থাকে যথার্থ শুশ্রূষা।

একটা অস্বাভাবিক সময়ে বেঁচে রয়েছি আমরা সকলে। ওয়ালেস স্টিভেন্স তাঁর বই ওপাস পস্থুমাস-এ যেন আমাদের সময়ের কথাই বলছেন, একটা ‘এক্সট্রাঅর্ডিনারি রিয়্যালিটি’, যেখানে ‘কনশাসনেস টেকস দ্য প্লেস অব ইমাজিনেশন’। কল্পনার পরিবর্তে চেতনা। এই যে আমাদের কত জন প্রিয় মানুষেরা সব চলে গেলেন বিগত কয়েক দিনে, এই শোকের ব্যক্তিগত তীব্রতা, তার সম্ভাব্য অভিঘাত কি আমরা কল্পনা করিনি কখনও? করেছি। করতে না চেয়েও করে ফেলেছি বার বার। আজ তার বাস্তবতা নিয়ে আমাদের চেতনার অন্তরঙ্গে কড়া নাড়ে প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদ। সামান্য ক’দিনের বিচ্ছেদ নিয়েই তো আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমরা যারা সাধারণ তারা শুধু নই— যারা অসাধারণ, তাঁরাও। সিমোন বোভোয়া চিঠি লেখেন সার্ত্রকে। সার্ত্র প্যারিসে নেই। ফিরে আসবেন ঠিক পরের দিন। বোভোয়া লিখছেন, “আই লাভ ইউ প্যাশনেটলি দিস ইভনিং— অ্যান্ড ইভন উইথ আ স্ট্রেঞ্জ অ্যাসর্টমেন্ট অব প্যাশনস।” বলছেন, “আই ফাইন্ড ইট প্লিজ়িং, অ্যাকচুয়ালি, সো অ্যাবসার্ডলি টু রিডিসকভার দ্যাট কাইন্ড ফর অ্যাঙ্গুইশ ফর ইউ।”

এই যে সুতীব্র সঙ্গলিপ্সা, এও তো অপরের স্মৃতির চারণ। ব্যক্তিগত। একাকী। এই অতিমারি আমাদের ঘরে বন্ধ করে রেখেছে, একা করে দিচ্ছে ঠিকই। তবু এই বুঝি নিজের অন্তরের সঙ্গে এক রকম বোঝাপড়ার সময়, শোককে চেতনায় আত্মস্থ করে নিজেকে একান্তে খানিক গুছিয়ে নেওয়ার সময়। জীবনকে আর এক বার অভিবাদন করতে, আবার তীব্র ভাবে বেঁচে থাকার রসদ নিজের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করে নিতে।

ইংরেজি বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement