Smart Phones

কোনটা ‘স্বাভাবিক’, বোঝা দায়

একই সঙ্গে এটাও না-মেনে উপায় নেই, চিরকাল স্বাভাবিক বলে মনে হত যা, তারও অনেক কিছু আজ বেশ অস্বাভাবিক লাগে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই অবশ্য। সময়ের সঙ্গে সমাজ বদলায়।

Advertisement
পুনর্জিৎ রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:০৫

দিনকয়েক আগের কথা। বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছি এক রেস্তরাঁয়। চোখ পড়ল পাশের টেবিলের চার অল্পবয়সি ছেলেমেয়ের দিকে। খাবারের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব অথবা হাসি ঠাট্টা করছে না ওরা। পরিবর্তে, সকলেই যে যার মোবাইল ফোনে ব্যস্ত! দিঘাতে বেড়াতে গিয়েও একই দৃশ্য দেখেছিলাম— সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার বদলে সৈকতে বসে থাকা জনতার বেশির ভাগই তাকিয়ে নিজেদের মোবাইলের ছ’ইঞ্চি স্ক্রিনের দিকে।

চিরকাল যা অ-স্বাভাবিক বলে জেনে এসেছি, তার অনেক কিছুই আজ দস্তুরমতো স্বাভাবিক মনে হয়। একই সঙ্গে এটাও না-মেনে উপায় নেই, চিরকাল স্বাভাবিক বলে মনে হত যা, তারও অনেক কিছু আজ বেশ অস্বাভাবিক লাগে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই অবশ্য। সময়ের সঙ্গে সমাজ বদলায়। সমাজ বদলালে সামাজিক রীতিনীতি, সামাজিক মনোভাবের বদল ঘটবেই। এ প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল— অস্বাভাবিক বলে জানতাম যা তার স্বাভাবিকীকরণ (সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘নর্মালাইজ়েশন’), এবং স্বাভাবিক বলে জানতাম যা তার অস্বাভাবিকীকরণের ফলে সমাজের বড় কোনও ক্ষতি হচ্ছে কি?

Advertisement

নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে যদি চার পাশে তাকাই, উপরের প্রশ্নটির উত্তরে ‘না’ বলা কার্যত অসম্ভব। সমাজমাধ্যমের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। আজ যা করছি, যা দেখছি, যা খাচ্ছি— সমস্ত কিছুর ছবি তুলে, ভিডিয়ো রেকর্ডিং করে কিংবা লাইভ স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে ‘শেয়ার’ করে দিচ্ছি সমাজমাধ্যমের সৌজন্যে। একই সঙ্গে, পরিচিত-স্বল্প পরিচিত-অপরিচিতদের উপরে গোপনে নজরদারি করে চলেছি নিরন্তর, তুলনা করে চলেছি তাদের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনের। নিজের জীবনের সমস্ত কিছু পৃথিবীর কাছে বেআব্রু করে দেওয়া এবং অন্যদের উপর অষ্টপ্রহর নজরদারি করে যাওয়া—আজ এগুলির মধ্যে অস্বাভাবিকতার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। এর ফলে এক দিকে যেমন আমরা হয়ে উঠছি সাইবার অপরাধীদের সহজ টার্গেট, অন্য দিকে সমানে অন্যের বেঁচে থাকার সঙ্গে নিজের বেঁচে থাকাকে তুলনা করে চলেছি বলে অজানতেই কবলে পড়ে যাচ্ছি নানা জটিল মানসিক ব্যারামের।

জনসমক্ষে অভব্য আচরণ করা, কুৎসিত মন্তব্য করা অনুচিত, অন্যায়— এত কাল তা-ই জেনে এসেছি। অথচ, আজ ‘ট্রোলিং’ অতি স্বাভাবিক হয়েছে। সামাজিক শিষ্টাচার ও সহবত— যার পাঠ পেয়ে থাকি একেবারে শৈশবের গোড়ায়— তার ধার ধারি না আর আজ। জনসমক্ষে অভব্য আচরণের মতো অস্বাভাবিকে প্রবণতার স্বাভাবিকীকরণের ফলে সমাজে কমে আসছে আলোচনা ও তর্কের পরিসর। তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত এক হিংসার বাতাবরণ যেখানে বিরুদ্ধ মতের কোনও স্থান নেই।

অস্বাভাবিক যা, তার স্বাভাবিকীকরণের ফলে সমাজের ক্ষতি হচ্ছে, সেটা তো স্পষ্ট। স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক হিসাবে গণ্য করার ফলে যে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার প্রমাণ কোথায়? সফল মাত্রই ভাল নয় আর অসফল মাত্রই খারাপ নয়— এটাই স্বাভাবিক বলে জেনে এসেছি চিরকাল। শোলে বাণিজ্যিক ভাবে সফল কিন্তু উচ্চ মানের ছবি নয় আর কাঞ্চনজঙ্ঘা বাণিজ্যিক ভাবে অসফল হলেও ছবি হিসাবে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট— এটা মেনে নিতে কোনও দিন অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আজ আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যা সফল তা-ই ভাল, যা অসফল তা-ই খারাপ। এর ফলে এক লক্ষ ভোটের মার্জিনে জেতা অথচ চরম দুর্নীতিগ্রস্ত বিধায়ককে নিয়ে আমরা মাতামাতি করি। অন্য দিকে, বাংলা টেলিভিশনের অত্যন্ত উঁচু দরের অভিনেতাকে অভিনেতা বলেই মনে করি না, যত দিন না তিনি বলিউডের কোনও ছবিতে মুখ দেখাচ্ছেন (সেটা ক্যামিও হলেও কুছ পরোয়া নেহি)। তাই সাফল্য পাওয়াটাই আজ আমাদের জীবনের মোক্ষ হয়ে উঠেছে। ‘ভাল মানুষ’ হয়ে ওঠা অথবা উৎকর্ষের সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন রাখাটা নয়।

বাবা-মায়েরা বুড়ো হলে ছেলেমেয়েরা তাঁদের দায়িত্ব নেবে, আগে এটাই স্বাভাবিক মনে হত আমাদের। আজ অবশ্য হিসেবটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। কিছু দিন আগে, আমার এক প্রতিবেশী বিলেতে চাকরি পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে তার সত্তর বছরের অসুস্থ বাবা আর ষাটোর্ধ্ব মাকে একা ছেড়ে যাবে না বলে। বছর ত্রিশের সেই যুবকের সিদ্ধান্ত জানার পর তার সমস্ত আত্মীয়স্বজন এবং শুভানুধ্যায়ী অবাক হয়ে বলেছিল, “বিদেশে না যাওয়ার এটা কোনও কারণ হল! বাবা-মাকে দেখার জন্য এজেন্সি থেকে লোক রেখে দিলেই তো হত!” বুড়ো বাবা-মায়ের দেখাশোনা ব্যস্ত ছেলেমেয়েরা করবে— এর চেয়ে অস্বাভাবিক কিছু হয় নাকি! পশ্চিমি দেশগুলির মতো একাকিত্ব আর নিঃসঙ্গতা আমাদের সমাজকে অচিরেই গ্রাস করবে, সেটা কি এক বারও মনে হয় আমাদের?

উল্লেখ্য, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়ার জন্য, অতীতের যে স্বাভাবিক সামাজিক রীতিনীতিগুলি সত্যিই আজ অস্বাভাবিক বলে গণ্য হওয়া উচিত ছিল এবং যে অস্বাভাবিক রীতিনীতিগুলিকে দেওয়া উচিত ছিল স্বাভাবিকের মর্যাদা— সেগুলির বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই তা হয়নি। জাতপাত, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য— যা অস্বাভাবিক এবং অন্যায়— আগেও আমাদের সমাজের স্বাভাবিক অঙ্গ ছিল, আজও তা-ই আছে। অপর দিকে, সমকামিতা মানব যৌনতার একটি সাধারণ ও প্রাকৃতিক প্রকরণ হলেও আমাদের তা চিরকালই অস্বাভাবিক মনে হত; আজ ২০২২-এও সেই মনোভাবের বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।

অনন্ত সমুদ্রের জনহীন তীরে বসে থাকা নবকুমারকে কপালকুণ্ডলা জিজ্ঞেস করেছিল, “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?” সত্যিই নবকুমারের মতো ‘পথ’ হারিয়েছি আজ আমরা। বিশ্বায়নের হুজুগ, পুঁজিবাদের বিস্ফার, প্রযুক্তির সর্বনিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠা— আলোর পরিবর্তে আমাদের করে তুলেছে অন্ধকারের পথযাত্রী। তবে ‘পথ’ খুঁজে পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তার জন্য ক্ষুরধার আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন। যে আত্মসমীক্ষা দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন ভাবে বলতে পারে, “যুগের হাওয়ায় ভেসে না গিয়ে, অগভীর জীবনযাপন থেকে বেরিয়ে এসে, ‘কী করছি, কেন করছি, আমার ক্রিয়াকলাপ ও সিদ্ধান্তের সামাজিক তাৎপর্যই বা কী’— সে সম্পর্কে সদা সচেতন থাকাটাই আমার এই সময়ের প্রধান কর্তব্য।”

অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement