Israel-Palestine Conflict

হয় গুলি, নয়তো জীবাণু

৭ অক্টোবর পূর্ণ হয়েছে ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের এক বছর। আপাতত, এই অঞ্চলে সংঘাত কমার কোনও লক্ষণ তো নেই-ই, বরং আন্তর্জাতিক আশঙ্কাকে সত্যি করে তা ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য দিকেও।

Advertisement
সৌরজিৎ দাস
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:৫৫

গত ১ সেপ্টেম্বর এক বছরে পড়ল ছোট্ট আবদুল রহমান। আবদুল গাজ়ার শিশু। গাজ়ার আরও অনেক শিশুর মতো তার জন্মদিনেও এ বছর কোনও অনুষ্ঠান হবে না। সে সামর্থ্য নেই তার মা, নেভিন আবু অল-জিদইয়ানের। করলেও অবশ্য আবদুলের মুখে হাসি ফুটত না। আজ প্রায় তিন মাস যাবৎ শয্যাশায়ী সে। দু’পায়ে সাড় নেই। বাঁ হাতটাও ঠিকমতো কাজ করছে না। গত আড়াই দশকে গাজ়ায় সে-ই যে প্রথম পোলিয়ো ভাইরাসের শিকার! অথচ, ১৯৯৯ সালে গাজ়া থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে গিয়েছিল পোলিয়ো। কিন্তু গত জুলাইয়ে এই অঞ্চলের কিছু স্থানের বর্জ্য জল পরীক্ষা করার সময়ে আবার খোঁজ মেলে টাইপ-২ পেলিয়ো ভাইরাসের। এ ক্ষেত্রে, টিকা থেকেই ভাইরাসটির জন্ম বলে মনে করা হচ্ছে। এমন ঘটনা তখনই ঘটে যখন মুখে দেওয়ার টিকায় থাকা দুর্বল জীবাণুটি নিজেকে রূপান্তরিত করে এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তা সংক্রমণ ছড়াতে পারে। পোলিয়ো জীবাণুটিকে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরাও ভয় পান। কারণ, অনেক সময়েই প্রাথমিক ভাবে আক্রান্তদের মধ্যে এর কোনও লক্ষণ দেখা যায় না।

Advertisement

৭ অক্টোবর পূর্ণ হয়েছে ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধের এক বছর। আপাতত, এই অঞ্চলে সংঘাত কমার কোনও লক্ষণ তো নেই-ই, বরং আন্তর্জাতিক আশঙ্কাকে সত্যি করে তা ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য দিকেও। সেই সঙ্গে গাজ়ার মানবিকতার সঙ্কটও ক্রমশ আরও খারাপের দিকে এগোচ্ছে। গাজ়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সমীক্ষা অনুযায়ী, যুদ্ধে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৪২,০০০ প্যালেস্টাইনি, আহত এক লক্ষের কাছাকাছি। ঘরছাড়া হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। যুদ্ধের ফলে গাজ়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবার এখন যা শোচনীয় অবস্থা, তাতে উপযুক্ত পরীক্ষানিরীক্ষার সাহায্যে পোলিয়ো সংক্রমণ কতখানি ছড়িয়েছে, তা বার করা কার্যত অসম্ভব। এই অবস্থায় এই অঞ্চলের দশ বছরের নীচে প্রায় ৬.৪ লক্ষ অরক্ষিত শিশুর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছিল। সংক্রমণের উপরে রাশ টানতে তাই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় গাজ়ায় পোলিয়ো টিকাকরণ চালু করা ছাড়া উপায় ছিল না রাষ্ট্রপুঞ্জের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রথম দফায় প্রায় নব্বই শতাংশ শিশুর টিকাকরণ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয় তারা।

আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফার টিকাকরণও জরুরি। যুদ্ধে গাজ়ার মাটি যে ভাবে দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে আগামী দিনে এই অঞ্চল খরার কবলে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই টিকাকরণের সঙ্গে শিশুদের ভিটামিন এবং মিনারেল-এর মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টিও লাগবে। গাজ়ার বর্তমান অবস্থায় তা সম্ভব কি? গত বছর এখানে প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার শিশু জন্মেছে, যুদ্ধের জেরে যাদের প্রাথমিক টিকাকরণটুকুও হয়নি। যুদ্ধের ঠিক আগে জন্মানো আবদুলের ক্ষেত্রেই তেমনটা হয়েছে। সেই কারণেই সম্ভবত তাকে পোলিয়োর শিকার হতে হয়েছে।

টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা একগুচ্ছ। প্রথমত, যারা প্রথম দফায় টিকা পেয়েছে তাদের আবার টিকা দেওয়া। যুদ্ধের জেরে সমানেই ঠাঁইবদল করা পরিবারের শিশুদের খুঁজে বার করাই কঠিন। দ্বিতীয়ত, টিকাকরণের সময়। কোনও পরিবারে কেউ গুরুতর আহত হলে, তাঁকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে বাকিদের। সে ক্ষেত্রে ফাঁক পড়ছে পরিবারের খুদেদের টিকাকরণে। টিকাকরণের ব্যবস্থা করতে যে পর্যাপ্ত সময় ও পরিস্থিতির প্রয়োজন, যুদ্ধের আবহে তা মিলছে কই?

তবে, পোলিয়োই গাজ়ায় একমাত্র স্বাস্থ্যসঙ্কট নয়। যুদ্ধের জেরে বহু ঘরছাড়া প্যালেস্টাইনিদের আশ্রয় এখন জনবহুল অস্থায়ী ক্যাম্প, যেখানে ন্যূনতম দৈনিক সুবিধাগুলিও মেলে না। শরণার্থী শিবিরের চার পাশে কঠিন বর্জ্যের পাহাড় জমছে। খাদ্যসঙ্কটের পাশাপাশি এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস স্বাভাবিক ভাবেই প্রভাব ফেলছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরে। বাড়ছে হেপাটাইটিস, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার মতো সংক্রামক রোগ।

যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্যালেস্টাইনিদের এই দুরবস্থা ইজ়রায়েল-এর গণহত্যা পরিকল্পনারই অংশ। আসলে, জীবনধারণের পক্ষে চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে প্যালেস্টাইনিদের অস্তিত্বই মুছে দিতে চায় তারা। লক্ষণীয়, এই অঞ্চলের স্বাস্থ্য পরিষেবা এতটাই ভেঙে পড়েছে যে পোলিয়ো টিকাগুলিকে ঠিক রাখতে ইউনিসেফ-কেই ঠান্ডা রাখার যন্ত্রের পাশাপাশি হাজার হাজার আইসপ্যাকের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এর সঙ্গে ইজ়রায়েলি সেনা পর্যায়ক্রমে আঘাত হেনেছে জল ও নিকাশির উপরেও, যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে দেশের জনস্বাস্থ্যে। ফলে যুদ্ধে নিহত হওয়া ছাড়াও এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি।

তবে, প্যালেস্টাইনিদের কাছে পোলিয়ো-র সঙ্গে লড়াই আজ আরও বৃহত্তর সংগ্রামের অংশমাত্র। আসল লড়াইটা চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। জল নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই, নিজের দেশেই উদ্বাস্তু নেভিনদের আজ প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চলছে প্রতিনিয়ত।

এই পরিস্থিতি বজায় থাকলে নবীন প্রজন্ম শুধু শারীরিক ভাবেই নয়, মানসিক ভাবেও খাদের কিনারায় এসে পৌঁছবে। গাজ়ার অবর্ণনীয় পরিস্থিতি দেখে স্তব্ধ হতে হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাপঙ্‌ক্তি এসে ধাক্কা মারে— কার দিকে তুমি গুলি ছুঁড়ছো হে, এখানে সবাই মানুষ!

আরও পড়ুন
Advertisement