আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে ভ্রমণের বাসনা
Travel

দেখব এ বার জগৎটাকে

কেন যেত নিজেদের আস্তানা ছেড়ে বন্যপশু-আকীর্ণ জঙ্গলে? একটাই উত্তর— অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানার দুঃসাহস।

Advertisement
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:১১

মানুষের জিনে আছে ভ্রমণ। পঁচিশ লক্ষ বছর আগে মানবগণের প্রথম প্রজাতি দ্বি-পদী হোমো হ্যাবিলিস ছিল একাধারে শিকারি ও সংগ্রাহক; এবং সেই সঙ্গে পায়ে হেঁটে চষে বেড়াত আশপাশের জায়গা। দল বেঁধে চলে যেত বহু দূর। মাঝেমাঝেই জায়গা বদল করত। তার নমুনা আছে মধ্য আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি অঞ্চলে। কেন যেত নিজেদের আস্তানা ছেড়ে বন্যপশু-আকীর্ণ জঙ্গলে? একটাই উত্তর— অচেনাকে চেনা, অজানাকে জানার দুঃসাহস।

Advertisement

মানুষের বিবর্তন হয় পূর্ব আফ্রিকার রিফট ভ্যালির মধ্যে কয়েকটা সঙ্কীর্ণ গিরিখাতে। জীবাশ্ম আবিষ্কার সেই গল্পই বলে। আগ্নেয়গিরি, মিষ্টি ও নোনতা জলের হ্রদ, গাছপালা, জঙ্গল, বন্যপ্রাণী— সবার মাঝে ও সবার সঙ্গে। সেখান থেকে দূরে গিয়ে পরিচিত হত বিভিন্ন এবং বিচিত্র ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে। নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখল নতুন পরিবেশে এবং পরিবর্তনশীল আবহাওয়ায়।

বিবর্তনের ধারা মেনে কয়েক লক্ষ বছর পরে এল নতুন প্রজাতি হোমো ইরেকটাস। তাদের সঙ্ঘবদ্ধ জীবন ও পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপনের কৌশল জানা থাকায় তারা আর আফ্রিকায় নিজেদের আটকে রাখল না। লোহিত সাগরে তখন জল কমে গিয়েছে। পেরিয়ে চলে এল ইউরোপ ও এশিয়ায়। সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, প্রাকৃতিক গঠন তাদের নতুন করে শিক্ষিত করল, নতুন পাথর নিয়ে শিকার ও আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র তৈরি করল। শুরু হল বিশ্বপরিক্রমা। এর অনেক পরে এসেছে মানুষ— তত দিনে একাধিক প্রজাতি এসে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেরিয়েছে, ঘর বানিয়েছে, পশুর চামড়া গায়ে দিতে শিখেছে। পায়ে পায়ে মানুষও তাদের দেখাদেখি পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছে।

যে তাগিদে মানুষের আগের মানবেরা ঘুরে বেড়াত, উন্নত মস্তিষ্কের মানুষের লক্ষ্য তার চেয়ে আলাদা হয়েছে। সে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে শিখেছে, নতুন কিছুতে বিস্ময় জাগে তার প্রাণে-মনে। কোনও কিছুতে ভয় না-পেয়ে সবার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে আনন্দ পেতে চায়। দুর্গম গিরি কান্তার মরু সাগর হিমবাহ উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু নিজেকে বয়ে নিয়ে চলেছে। মাটি আকাশ জল সবেতে তার গতি করেছে অদম্য। এ ভাবেই কয়েক শতকের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের পথ চলা করেছে মসৃণ সর্বত্রগামী।

গত শতকেও বাঙালির বেড়ানো বলতে ছিল ‘পশ্চিমে যাওয়া’— গিরিডি মধুপুর শিমুলতলা ইত্যাদি জায়গায়, স্বাস্থ্য উদ্ধার ও বিশ্রামের জন্য। তখন খুব কম লোকই পুরী দার্জিলিং যেত। সেই ছবিটা একেবারে পাল্টে গিয়েছে মূলত মানসিক পরিবর্তন, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও আর্থিক অবস্থার উন্নতি। এখন হেন জায়গা নেই যেখানে বাঙালি পর্যটকের পা পড়ে না। অবশ্য শুধু বাঙালি নয়— যেখানেই নতুন পর্যটন কেন্দ্র আবিষ্কার হচ্ছে, সব দেশের মানুষই সেখানে যাচ্ছে। পর্যটন এখন একটা বড় শিল্প প্রায় প্রতিটি দেশে। অনেক দেশের অর্থনীতি এই শিল্পের উপরে নির্ভরশীল, যেটা স্পষ্ট বোঝা গেল কোভিডের সময়। প্রায় তিন বছর ধরে পর্যটন মুখ থুবড়ে পড়েছিল, অনেক দেশের আর্থিক অবস্থা একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল। সেই সঙ্গে বিপাকে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী পর্যটন সংস্থাগুলো। সেই অবস্থা এখন অনেকটা সামলে উঠেছে। লোকে আবার বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছে, দেশে বিদেশে ভ্রমণ করছে। একটা সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে কোভিডকালে রাস্তায় গাড়ি এবং বিমান চলাচল পঞ্চাশ শতাংশ কমে গিয়েছিল, এবং পৃথিবীর প্রথম দশটি শহরে লকডাউনের জন্যে আশি শতাংশ গাড়ি কম চলেছে। অবশ্য এর পিছনে সরকারি তরফে বিধিনিষেধ কাজ করেছে, বিনা প্রয়োজনে বাইরে বেরোনো মানা।

আন্তর্জাতিক পর্যটন ২০২৪ সালে প্রাক্-অতিমারি স্তর পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করবে বলে আশা করা হচ্ছে— প্রাথমিক অনুমান ২০১৯ সালের স্তরের উপরে দু’শতাংশ বৃদ্ধির দিকে নির্দেশ করে। তবে মুদ্রাস্ফীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ বৃদ্ধিকে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। ভ্রমণের চাহিদা বাড়লেও ভ্রমণ এখন খুব ব্যয়বহুল হয়ে যাচ্ছে। একই কথা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভারত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের ভ্রমণ ও পর্যটন উন্নয়ন সূচক র‌্যাঙ্কিং-এ উল্লেখযোগ্য পতনের সম্মুখীন হয়ে ২০১৯-এর তুলনায় বর্তমান বছরে দশ কমে ৩৯তম স্থানে এসেছে। পর্যটন শিল্পকে বাঁচাতে হলে পর্যটক-বান্ধব ব্যয়ের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। বিদেশে ভ্রমণেচ্ছুদের বিমান ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণদের মধ্যে দেশে-বিদেশে ভ্রমণের উৎসাহ বাড়ছে, কিন্তু সঙ্গত কারণেই বেড়ানোর জন্য খরচ করতে তাঁরা জমানো পুঁজিতে হাত দিতে রাজি নন। বিমান ভাড়ায় আংশিক ছাড় এ ক্ষেত্রে একটা উপায় হতে পারে।

ভ্রমণ ঐচ্ছিক হলেও কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। অনেকেই মনে করেন যে, বই পড়ে অথবা টিভি চ্যানেল বা আজকালকার ভ্লগ দেখেই ভ্রমণের পিপাসা মেটানো সম্ভব। বেড়াতে না বেরোনোর হাজার একটা অজুহাত খুঁজে পাওয়া গেলেও অস্বীকার করা যায় না যে, একটা বইয়ের সঙ্গে ভ্রমণ যতটা সম্পৃক্ত, তত বোধ হয় আর কিছুর সঙ্গে নয়। ঘরকুনো স্বভাব, আর্থিক অসঙ্গতি, শারীরিক দুর্বলতার মতো কিছু কারণ বেশ কিছু মানুষকে ভ্রমণের মতো আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতার থেকে দূরে রাখে। তাঁরা অনেকে কাছে-পিঠে যেতেও ‘সাহস’ পান না। অনেকে আছেন বিদেশ ভ্রমণে আপত্তি কারণ দেশের মধ্যেই অনেক কিছু দেখার আছে। তা কেউ অস্বীকার করছে না, তবে বেড়ানোর মধ্যে ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক বেড়ার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিলেই সবচেয়ে ভাল হয়। প্রকৃতি একটাই— তার বৈচিত্র রয়েছে, কিন্তু কোনও সীমানা নেই। আর প্রকৃতিকে উপভোগ করতে পারে মানুষই। মানুষ ছাড়া প্রকৃতির মূল্য নেই— ‘শোভার নিধি কী হবে যদি ভাবুক নাহি পাই’। প্রত্যেক মানুষের প্রকৃতিকে অনুভব করার ক্ষমতা আলাদা, তাকে বর্ণনা করার প্রথাও পৃথক। কেউ লিখে, কেউ ছবি এঁকে আবার কেউ সুরের মাধ্যমে তাকে প্রকাশ করে।

আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি ভ্রমণ শিক্ষণীয়ও বটে। বাঙালিকে ঘর থেকে বার করে হাতে ধরে ঘুরে বেরিয়েছে শ্রীকান্ত, শরৎচন্দ্রের কলমে। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে ভ্রমণে চিঠিতে নানা ভাবে ব্যক্ত করেছেন তাঁর ভ্রমণ। বিবেকানন্দের ভ্রমণাখ্যানে সে এক অন্য মাত্রা পেয়েছে ভাষায়। এ ছাড়া অনেক স্বনামধন্য লেখকের কলমে ভ্রমণোপাখ্যান আকর্ষণীয়। সকলেই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা বলেছেন। গত দশ হাজার বছর ধরে আধুনিক মানুষের সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। এক-একটা সময় সভ্যতার এক-এক রকমের নিদর্শন। মানুষ সেই ইতিহাস জেনেছে। প্রকৃতির মাঝেই গড়ে উঠেছে সেই সভ্যতা, তারই অঙ্গ। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয় পঠিত ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করার মধ্যেও এক অমলিন আনন্দ আছে।

আবার কেবল মানুষের ইতিহাস নয়, পৃথিবীর ইতিহাস, প্রাক্‌-মানুষ মানবের ইতিহাস। কত কী দেখা জানা শেখার আছে। ভ্রমণসংক্রান্ত ছবি দ্বি-মাত্রিক, মন ভরে না। সব ভ্রমণই ত্রিমাত্রিক। তাতেই বেশি লোক খুশি। এর সঙ্গে যখন ইতিহাস যুক্ত থাকে, তখন সময় চতুর্থ মাত্রা হয়ে যোগ দেয়। আবার এমন জায়গা আছে যেখানে ভ্রমণ পঞ্চম মাত্রিক হয়ে ওঠে। আমি যখন কাজ়াখস্তানে পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর (স্তেপ) দেখছিলাম এবং সেখানে ঘোড়া চরতে দেখছি, তখন আমি মনে মনে আজ থেকে পঁচিশ হাজার বছর আগের মানুষের সেই জায়গায় প্রথম পদার্পণ এবং ঘোড়া বশ করার যুগে পৌঁছে গেছিলাম। একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেরেঙ্গেটির অলদুভাই গর্জে মানব বিবর্তনের নিদর্শন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে অথবা ইরানে জাগ্রোস পর্বতের পাদদেশে প্রথম মনুষ্যকৃত চাষের প্রদর্শক্ষেত্রে। এই ধরনের বেড়ানোয় যে অভিজ্ঞতা হয় তা চূড়ান্ত।

মানবের প্রজাতির পর প্রজাতি এবং মানুষের প্রজন্মবাহিত পরিভ্রমণের যে জিন আমাদের আজকের মানুষের রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে, তারই তাড়নায় আমরা দেশে বিদেশে গ্রাম-সদর-মফস্‌সলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ভ্রমণ আমাদের দেহে-মনে।

আরও পড়ুন
Advertisement