সচেতন সরব নাগরিকদের অস্বীকার করা কঠিন
RG Kar Medical College and Hospital Incident

ঢেউ উঠছে জমি গড়ছে

একটি মর্মান্তিক ঘটনা যে সরবতার জন্ম দিয়েছে তা নানা ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এটুকুই কিন্তু যথেষ্ট নয়। এই সচেতনতা যা স্বত্ববুদ্ধি ও সত্ত্ববুদ্ধি থেকে জেগে উঠেছে তা সর্বত্র সর্বস্তরে বজায় রাখতে হবে।

Advertisement
বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:৪৩

পুজো আসছে। শরতের মেঘের মতো মন অবশ্য নির্ভার হয়ে উঠছে না। জনগণের একাংশ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বিচলিত। দলীয় রাজনীতির বাইরে সাধারণের এই জেগে ওঠার রূপ পুরনো একটি শব্দকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, নতুন করে। ‘প্রজাপুঞ্জ’ সেই শব্দ। বাংলা ভাষায় শব্দটি এখন আর ব্যবহৃত হয় না। না-হওয়াই তো স্বাভাবিক। প্রজা তো আমরা নই। সম্রাট-রাজা-জমিদারদের যুগ গিয়েছে। ইংরেজ উপনিবেশের অবসান হয়েছে। এখন তো আমরা নাগরিক— প্রজামাত্র নই। আমরা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক। তাই বলা হয় জনগণ জেগে উঠছেন। বলা হয় ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। তবে প্রজা শব্দটি এখনও একেবারে হারিয়ে যায়নি— প্রজাতন্ত্র দিবস-এর মধ্যে মিশে আছে। তবে সে প্রজাতন্ত্র মানে নাগরিকতন্ত্র।

Advertisement

প্রজাপুঞ্জ শব্দটির পূর্বপদ প্রজা, পরপদ পুঞ্জ। সংস্কৃতে পুঞ্জ শব্দের অর্থ স্তূপ। সমূহ অর্থেও ব্যবহৃত। ইংরেজি ‘মাস’ শব্দটির কথা মনে পড়বে। অর্থ, ‘আ লার্জ বডি অব ম্যাটার উইথ নো ডেফিনিট শেপ’। কিন্তু এই পরপদের পূর্বে যখন লাগসই অন্য একটি পদ বসে তখন আর পুঞ্জ নিতান্ত অনির্দিষ্ট লক্ষ্যহীন সমূহ বা স্তূপ হয়ে থাকে না। যখন লেখা হয় সফেনপুঞ্জ তখন ফেনিল জলরাশির তীব্র শক্তির ছবি ভেসে ওঠে। সমুদ্রের ঢেউ তীব্র শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে, ভেঙে পড়ছে। যখন লেখা হয় মেঘপুঞ্জ তখন ঘনীভূত শক্তিমান বজ্রনির্ঘোষক্ষম জলধর মেঘের ছবিই মনে জাগে। ঢেউ হয়ে ভাঙছে, অতি বর্ষণে প্লাবিত করছে আবার সেই প্লাবনেরজলরাশি সরে গেলে পড়ে থাকা পলিতে উর্বর হয়ে উঠছে ক্ষেত্র।

‘প্রজাপুঞ্জ’ শব্দটির ব্যবহার বিবেকানন্দের বর্ত্তমান ভারত রচনায় আছে। বিদ্যাসাগরের সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের লেখা বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাস বইতেও পাওয়া যাবে। শম্ভুচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘প্রজাপুঞ্জ কৃষিবৃত্তি অবলম্বন করে দিনপাত করিত।’ বিবেকানন্দের লেখায় আছে, ‘শক্তির অস্তিত্বে প্রজাবর্গের এখনও জ্ঞান হয় নাই। তাহাতে সমবায়ের উদ্যোগ বা ইচ্ছাও নাই; সে কৌশলেরও সম্পূর্ণ অভাব, যাহা দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিপুঞ্জ একীভূত হইয়া প্রচণ্ড বল সংগ্রহ করে।’ লিখেছিলেন যেই শাসন করুন না কেন ‘সে শক্তির আধার— প্রজাপুঞ্জ।’ একীভূত হয়ে শক্তি অর্জন করতে না পারলে নিতান্ত প্রজারা প্রজাবর্গ হয়ে থাকবেন, শক্তিপুঞ্জ অথবা তেজঃপুঞ্জ হয়ে উঠতে পারবেন না। শাসক তখন যা ইচ্ছে তাই করবেন। আর যখন প্রজাশক্তি প্রবল তখন তাঁদের সেই সমবায় প্রজাপুঞ্জ। বিদ্যাসাগর সহোদর অবশ্য ‘প্রজাপুঞ্জ’ শব্দটি এই একীভূত প্রবলবল কৃষকদের সমষ্টি বোঝাতে ব্যবহার করেননি। বিবেকানন্দ প্রচলিত শব্দটিকে বিশেষ অর্থগত গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

প্রজাবর্গ কখন প্রজাপুঞ্জ হয়ে উঠবে? বিবেকানন্দ মনে করেন ‘শক্তিলাভেচ্ছা’ আর ‘সত্ত্ববুদ্ধি’ এই দুই না জাগলে প্রজারা নিতান্ত প্রজা-সাধারণ। রাজা তাদের শোষণ করবেন। বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, “রাজ্য-রক্ষা, নিজের বিলাস, বন্ধুবর্গের পুষ্টি ও সর্ব্বাপেক্ষা পুরোহিতকুলের তুষ্টির নিমিত্ত রাজরবি প্রজাবর্গকে শোষণ করতেন।” এর হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? ‘রাজগৃহীত প্রজার ধনে সাধারণ সত্ত্ববুদ্ধি [স্বত্ববুদ্ধি] ও তাহার আয়-ব্যয়-নিয়মনের শক্তিলাভেচ্ছা’ এই দুইয়ের অধিকার যদি প্রজাদের থাকে তা হলেই রাজা আর প্রজাদের শোষণ করতে পারবেন না। ‘সত্ত্ববুদ্ধি’ না ‘স্বত্ববুদ্ধি’? বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর কালিকা-যন্ত্রে, বিবেকানন্দের অন্যতম প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী মুদ্রিত বর্ত্তমান ভারত বইতে ‘সত্ত্ববুদ্ধি’ এই বানান রয়েছে। ধনে ‘স্বত্ববুদ্ধি’ হলেই বুঝি ঠিক হয়। স্বত্ব মানে অধিকার। রাজা প্রজার কাছ থেকে কর হিসাবে যে ধন সংগ্রহ করছেন তাতে প্রজার যে অধিকার আছে এই বুদ্ধি বা সচেতনতা প্রজার থাকবে, তাই ‘স্বত্ববুদ্ধি’। তবে ‘সত্ত্ববুদ্ধি’ শব্দটিও অর্থহীন নয়। ‘সত্ত্ববুদ্ধি’ মানে নিজের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতনতা, মার্ক্সের ভাষায় আরও নির্দিষ্ট ভাবে তা শ্রেণি-চেতনা। বিবেকানন্দ ঠিক শ্রেণি-চেতনা অর্থে ‘সত্ত্ববুদ্ধি’ শব্দটি ব্যবহার করছেন না, তবে তাঁর এই বর্ত্তমান ভারত বইতে আছে ‘সোস্যালিজম, এনার্কিজম, নাইহিলিজম্‌ প্রভৃতি সম্প্রদায় এই বিপ্লবের অগ্রগামী ধ্বজা।’ পাশ্চাত্যদেশের ভাববিপ্লবের খবরাখবর ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিবেকানন্দ রাখতেন। নিজের পর্যবেক্ষণ শক্তি ও ইতিহাসবোধের সূত্রে লিখেছিলেন, ‘সাধারণ প্রজা সমস্ত শক্তির আধার হইয়াও পরস্পরের মধ্যে অনন্ত ব্যবধান সৃষ্টি করিয়া, আপনাদের সমস্ত অধিকার হইতে বঞ্চিত রহিয়াছে, এবং যতকাল এই ভাব থাকিবে ততকাল রহিবে।’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। সাধারণ প্রজা পরস্পর বিচ্ছিন্ন, নিজেরা পুঞ্জীভূত হলে যে অধিকার আদায় করতে পারে এই সত্ত্ববুদ্ধি, শক্তির অস্তিত্ববোধ তাদের হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই বিপ্লব অধরা থেকে যাচ্ছে। ব্রেশটের ‘এক মজুর ইতিহাস পড়ে’ কবিতায় আছে এই সংগত জিজ্ঞাসা, ‘হু বিল্ট দ্য সেভন গেটস অব থিবস্?’ বিবেকানন্দ বিলাত যাত্রীর পত্র রচনায় বর্ত্তমান ভারত রচনার ভাবনাই আরও সম্প্রসারিত। শ্রমজীবীরা ‘তাদের পরিশ্রম ফলও... পাচ্চে না।’ ‘হে ভারতের শ্রমজীবী! তোমার নীরব অনবরত-নিন্দিত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বাবিল, ইরান, আলেকজান্দ্রিয়া, গ্রীস, রোম, ভিনিস, জেনোয়া, বোগদাদ, সমরকন্দ, স্পেন, পোর্তুগাল, ফরাসী, দিনেমার, ওলন্দাজ ও ইংরেজের ক্রমান্বয়ে আধিপত্য ও ঐশ্বর্য।’ এই অবস্থা থেকে শ্রমজীবী সাধারণকে কেউ মুক্ত করবে না। সাধারণ যদি মনে করে তাদের অস্তিত্বের মূল্য আছে, অধিকার আছে আর সেই অস্তিত্বের মূল্য ও অধিকারের দাবির সূত্রে যদি শক্তি লাভের ইচ্ছা জাগে তা হলেই কিন্তু চাকা ঘুরবে। ভারতের শ্রমজীবীদের সঙ্গে অন্য সাধারণের সংযোগ সাধন হোক, তাও চেয়েছিলেন বিবেকানন্দ।

‘প্রজাপুঞ্জ’ শব্দটির বদলে এখন ‘নাগরিকপুঞ্জ’ ব্যবহার করতে ইচ্ছে করে। এই রাজ্যে এবং দেশের অন্যান্য রাজ্যেও নাগরিকেরা কি ‘নাগরিকপুঞ্জ’ হয়ে উঠতে চাইবেন! বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, ‘আয় ব্যয় নিয়মনের’ শক্তি যেন প্রজার থাকে। আয় ব্যয় নিয়মনের শক্তি বলতে কী বুঝিয়েছিলেন? ‘প্রজাবর্গের সাধারণ মঙ্গলকর কার্য্যসাধনোদ্দেশে সহমতি’ হওয়া চাই। অর্থাৎ দুর্গাপুজোর ঘটা-পটার জন্য ক্লাবে ক্লাবে টাকা দিলে সাধারণের উপকার হবে না কি সেই টাকা শিক্ষা বা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে সাধারণের উপকার হবে সে বিষয়ে ‘সহমতি’ হলে শাসকের নীতি নির্ধারণে প্রজাপুঞ্জের ভূমিকা থাকবে। নিরাপত্তা খাতে বেশি টাকা যাবে, না কি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেশি টাকা যাবে, সে বিষয়ে জনসাধারণের সরবতা জরুরি। শাসক ইচ্ছেমতো তখন আর জনতোষণের জন্য অর্থের অপব্যয় করতে পারবেন না। বিবেকানন্দ এও লিখেছিলেন সাধারণের মধ্যে ‘সমবায়ের উদ্যোগ বা ইচ্ছাও নাই।’ সেই সমবায়ের ইচ্ছা-উদ্যোগ চাই।

পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকরা সাম্প্রতিক কালে সচেতন হয়ে উঠেছেন। সেই সচেতনতার নানা নিদর্শন চোখে পড়ছে। নাগরিক সচেতনতার প্রকাশ রাতদখলের স্লোগানে যেমন উঠছে তেমনই বন্যা পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী পরিদর্শনে গেলে তাঁকে কী কাজ হয়েছে বা হয়নি তা খোলাখুলি বলবার সাহস-সামর্থ্য অর্জন করেছেন জনসাধারণ। খুবই ভাল এই সরবতা। একটি মর্মান্তিক ঘটনা যে সরবতার জন্ম দিয়েছে তা নানা ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এটুকুই কিন্তু যথেষ্ট নয়। এই সচেতনতা যা স্বত্ববুদ্ধি ও সত্ত্ববুদ্ধি থেকে জেগে উঠেছে তা সর্বত্র সর্বস্তরে বজায় রাখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রাশিয়ার চিঠি-তে কৃষকদের সঙ্গে তাঁর সংলাপের বিবরণ দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘উপরে একটা বড়ো ঘরে আমি এসে বসলুম— সেখানে সবাই এসে জমা হল। তারা নানা স্থানের লোক, কেউ-বা অনেক দূর প্রদেশ থেকে এসেছে। বেশ সহজ ওদের ভাবগতিক; কোনোরকম সংকোচ নেই।’ সঙ্কোচের বিহ্বলতা কেটে গিয়ে নিজের অধিকার সম্বন্ধে সরব-সচেতন হয়ে উঠলেই নাগরিকরা পুঞ্জীভূত শক্তিতে পরিণত হবেন। সেই শক্তি অনেক কিছু সম্ভব করতে পারে। মনে রাখতে হবে এই সচেতনতা ও নাগরিক আন্দোলন সম্বন্ধে যাঁরা সংশয় প্রকাশ করছেন তাঁরা ভাবছেন এই সচেতনতা হুজুগ মাত্র— তা শেষ অবধি কোনও লক্ষ্যাভিমুখে এগোবে না। কোনও লক্ষ্যাভিমুখে এগোবে কি না সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, তবে এই সচেতনতার অস্তিত্বকে খাটো করার মানে হয় না। এই সচেতনতা প্রতিমুহূর্তে শাসকদের অন্তত বুঝিয়ে দিতে চাইবে সমাজের মধ্যে সচেতন সরব নাগরিকেরা আছেন, তাঁদের অস্বীকার করা কঠিন।

আরও পড়ুন
Advertisement