আমরা হকিতেও ছিলাম, পেট্রোরসায়ন শিল্পেও ছিলাম
Odisha

সবই এখন অতীত

বামপন্থার সার্বিক ব্যর্থতা, তৃণমূলের শুধুই ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ও বাঙালি চিন্তাজগতে শিল্প-বাণিজ্যের প্রতি নিদারুণ অবহেলা আমাদের ধর্ম ও জিরাফ, দুটোকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছে।

Advertisement
মোহিত রায়
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৭:৩৩
Decorated Kalinga Stadium during Hockey World Cup 2023

উজ্জ্বল: হকি বিশ্বকাপের উদ্বোধনের আগে আলোকিত কলিঙ্গ হকি স্টেডিয়াম। ভুূবনেশ্বর, ১২ জানুয়ারি ২০২৩। ছবি: পিটিআই।

ওড়িশাতে পর পর দু’বার পুরুষদের হকি বিশ্বকাপ আয়োজিত হল। এত বড় ক্রীড়া অনুষ্ঠান ভারতে খুব একটা হয় না। হকি খেলে বিশ্বের ১৪০টি দেশ, তাদের থেকে বিশ্বকাপে নির্বাচিত হয় ১৬টি দেশ।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হবু ইঞ্জিনিয়াররা এক কালে হকি খেলতেন, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় হকি টুর্নামেন্টে প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে খেলতে যেতেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, যাদবপুর আর হকি খেলে না। যাদবপুরের একাধিক এঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র এক সময় মোহনবাগান, সার্ভিসেস, এরিয়ান, খালসা ব্লুজ়-এর হকি মাঠ উজ্জ্বল করতেন। অবশ্য যাদবপুরের বিশেষ দোষ নেই, বাম জমানায় হকিকে বাংলা ছাড়া করা হল ধীরে ধীরে। কলকাতা ছিল ভারতীয় হকির উৎসস্থল, কলকাতার বেটন কাপ পৃথিবীর প্রাচীনতম হকি কাপ। কলকাতা হকি লিগ শুধু প্রাচীনতম নয়, দীর্ঘ দিন দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হকি টুর্নামেন্ট। ফুটবলের সঙ্গে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ছিল হকিরও সর্বভারতীয় প্রধান দল। সে সব এখন অতীত— ২০০০ সালে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল তাদের হকি শাখা একেবারেই বন্ধ করে দেয়। আশার কথা, দু’টি ক্লাবই গত দু’বছরে হকি খেলা আবার শুরু করেছে।

Advertisement

২০২১ সালে টোকিয়ো অলিম্পিকস-এ ৪১ বছর পর ভারতীয় হকি দলের অলিম্পিক পদক জয়ের কারিগর নবীন পট্টনায়কের ওড়িশা সরকার। ২০১৪ থেকে ওড়িশা সরকার পুরুষ ও নারী হকি দলের আর্থিক ভার নিতে শুরু করে। ২০১৮ সালে ১৫০ কোটি টাকা ভারতীয় হকি দলের জন্য ঘোষণা করে ওড়িশা সরকার। একটি রাজ্য জাতীয় দলের আর্থিক সহায়ক হচ্ছে, এ কথা আগে কেউ শোনেনি। আরও দশ বছর এই সহায়তা দানের কথা ঘোষণা করেছে ওড়িশা সরকার। হকির উন্নতির জন্য স্টেডিয়াম, অ্যাস্ট্রোটার্ফ মাঠ সবই করেছে তারা, এই বিশ্বকাপের দলে ছ’জন খেলোয়াড় ওড়িশার।

এ বার পেট্রোরসায়ন। হকির মতোই, ভারতে রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদ্যার প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতায়— যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ (কেমিক্যাল এঞ্জিনিয়ারিং)। ভারতে রাসায়নিক শিল্প গড়ার অন্যতম পথিকৃৎ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সহায়তাতেই ১৯২১ সালে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে (যা পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হয়) শুরু হয় রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদ্যার পাঠ। খনিজ তেল ও সেই তেল থেকে বিভিন্ন জ্বালানি (পেট্রল, কেরোসিন, গ্যাস ইত্যাদি) তৈরি ও পরে সেই তেলের বিভিন্ন অংশ থেকে অনেক প্রয়োজনীয় রাসায়নিক (পেট্রোরাসায়নিক) উৎপাদনের বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদ্যার হাত ধরে। দেশের জ্বালানি তেল সরবরাহে গতি আনতে ষাটের দশকে ভারত সরকার ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন গঠন করে ভারতের পেট্রোলিয়াম শিল্পের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। সত্তরের দশক থেকে বেশ কয়েকটি নতুন তৈল শোধনাগার স্থাপিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া রিফাইনারি। এই দেশীয় পেট্রোলিয়াম শিল্পের উত্থানে যাদবপুরের রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী সময়ে দেশের বেশ কয়েকটি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানার তৈল শোধনাগারের অধিকর্তা হয়েছেন ও আছেন যাদবপুরের রাসায়নিক প্রযুক্তিবিদরা।

পেট্রোলিয়াম শোধনাগারের পরের ধাপ পেট্রোরাসায়নিক শিল্প। শোধনাগারে প্রক্রিয়াজাত মূলত ন্যাপথা থেকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় অনেক জৈব রাসায়নিক, যা থেকে তৈরি হয় দৈনন্দিন জীবনের বিবিধ সামগ্রী। হলদিয়া তৈল শোধনাগার ঘিরে গড়ে উঠল হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, ভারতের অন্যতম বৃহৎ পেট্রোরাসায়নিক কারখানা। এল জাপানের খ্যাতনামা মিত্‌সুবিশি কেমিক্যাল। বাম আমলের শেষ দশকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের মরুভূমিতে হলদিয়ায় পেট্রোরাসায়নিক শিল্প আশা জাগিয়েছিল আবার শিল্পের পুনরুজ্জীবনের। ২০০৭ সালে ভারত সরকার দেশের ও বিদেশের লগ্নি আকর্ষণ করে ভারতকে খনিজ তেল ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের প্রধান কেন্দ্র করে তুলতে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি তৈল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের অঞ্চল গড়ে তুলতে বিভিন্ন রাজ্যকে আহ্বান জানায়। এই অঞ্চলগুলিতে পাশাপাশি বড় তৈল শোধনাগার ও তার উৎপাদন থেকে পেট্রোরাসায়নিক শিল্প স্থাপিত হবে, হবে তার অনুসারী শিল্পের কারখানা। এ সবের জন্য উন্নত করতে হবে সমুদ্র বন্দর, নতুন বন্দর তৈরি করতে হবে। উন্নত করতে হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন সহায়ক পরিষেবা। এই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে কেন্দ্র সরকার রাজ্যকে সাহায্য করবে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শিল্প সংস্থা যাতে এখানে শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হয়, সে জন্যও কেন্দ্র সহায়তা করবে। রাজ্যগুলিকে জমির জোগান, জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ও স্থানীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।

স্বাভাবিক ভাবেই হলদিয়া এই পেট্রোরাসায়নিক শিল্পের অঞ্চল গড়ার আদর্শ স্থান; রাজ্য সরকার তার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে কাজ শুরু করে। হলদিয়া সংলগ্ন প্রয়োজনীয় জমি নেওয়ার পরিকল্পনায় ঘটে নন্দীগ্রামের প্রতিরোধ ও পুলিশ-সিপিএমের গুলিচালনায় ১৪ জন স্থানীয় মানুষের মৃত্যু। ফলে নতুন জমির খোঁজের দরকার পড়ল। উঠে এল নয়াচরের নাম। নয়াচর হলদিয়া বন্দরের ঠিক বিপরীতে গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা একটি নবীন দ্বীপ। হলদিয়া শিল্পাঞ্চল ও নয়াচরকে নিয়ে তৈল শিল্পের পেট্রোরাসায়নিক বৃহৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা হল। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপনের সবচেয়ে বড় সমস্যা জমি অধিগ্রহণ ও জমি মালিকদের পুনর্বাসন, যা সদ্য গড়ে ওঠা নয়াচরে ছিল না। নতুন দ্বীপ হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র ধ্বংসের ব্যাপারও ছিল না। উপকূল নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু বিশেষ সংশোধন দরকার হতে পারত, ব্যস এটুকুই। কিন্তু একেবারে প্রথম থেকেই ভারতে উন্নয়ন-বিরোধী এনজিওগুলি এর বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করল। আর মাঠে নেমে পড়লেন উন্নয়ন-বিরোধী বিদ্যেবোঝাইরা— মূলত শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কহীন অধ্যাপক ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিকরা। তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য সরকারের প্রকল্পের বিরোধিতা করে। শ্লথ গতিতে হলেও প্রকল্পের পরিকল্পনা তবু এগোচ্ছিল, কিন্তু ইতিমধ্যে বামফ্রন্টই রাজ্য থেকে বিদায় নিল। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ, রাজ্যের এঞ্জিনিয়ারিং-পলিটেকনিকের ছাত্রদের চাকরির সুযোগ, অনুসারী শিল্পে স্থানীয় উদ্যোগের সুযোগ— সব পরিবর্তনের ঝড়ে ভূপতিত হয়ে গেল। নয়াচর এখন চলে গিয়েছে বহিরাগতদের দখলে, যারা পরিবেশ বা অন্য নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে দ্বীপের খাঁড়ি বুজিয়ে, মাছের ভেড়ি বানিয়ে, গ্রাম বসিয়ে চর দখল করে নিয়েছে। সমাপ্তি ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার।

হকির মতোই ওড়িশা সরকার কেন্দ্রের পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পাঞ্চল গড়ার প্রস্তাবে এগিয়ে এল। ওড়িশায় পারাদ্বীপে রয়েছে পারাদ্বীপ তৈল শোধনাগার, কিছু অন্যান্য শিল্প এবং পারাদ্বীপ বন্দর। হলদিয়ার মতোই। কেন্দ্রের প্রস্তাব অনুযায়ী ওড়িশা সরকারের উদ্যোগে সেখানে প্রায় দেড়শো গ্রাম ও পারাদ্বীপ শিল্পাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠতে চলেছে বিশাল পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পাঞ্চল। এখানে ছোট-বড় শতাধিক শিল্প যেমন গড়ে উঠবে তেমনই স্থানীয় নাগরিকদের জন্য বাসস্থান ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও থাকবে। এখানে তিন লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি ও সাড়ে তিন লক্ষ কর্মসংস্থানের আশা রয়েছে। এই প্রকল্পের প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি এবং পরিবেশ প্রভাব সমীক্ষণের কাজ প্রায় শেষ। জমি অধিগ্রহণ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। পূর্ব ভারতে এটিই হবে বৃহত্তম পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পকেন্দ্র।

একদা পশ্চিমবঙ্গ হকিতেও ছিল, পেট্রোরসায়নেও ছিল। বামপন্থার সার্বিক ব্যর্থতা, তৃণমূলের শুধুই ক্ষমতা দখলের রাজনীতি ও বাঙালি চিন্তাজগতে শিল্প-বাণিজ্যের প্রতি নিদারুণ অবহেলা আমাদের ধর্ম ও জিরাফ, দুটোকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল আবার হকিতে ফিরেছে, পশ্চিমবঙ্গে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পাঞ্চল গড়ার কেন্দ্রীয় প্রস্তাব এখনও রয়েছে। প্রত্যাবর্তনের লজ্জা কাটিয়ে এ বার ফেরা যাক নয়াচরে।

আরও পড়ুন
Advertisement