ম্যাজিক ও মিথের নেপথ্যে
Narendra Modi

সারা বছর দিন-রাত এক করে নির্বাচনে জেতার রণকৌশল

বিরোধী দলের রাজনীতিকরা যেটা স্বীকার করেন না, তা হল, ‘মোদী ম্যাজিক’ বা ‘নরেন্দ্র মোদী’ নামক জাদু যাতে কাজ করে, তার জন্য নরেন্দ্র মোদী প্রবল পরিশ্রম করেন।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:১৮
সফল: মেট্রো রেলের দ্বিতীয় পর্যায়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে প্রধানমন্ত্রী মোদী মেট্রো নিবেদন করলেন ‘জাতির উদ্দেশে’, নাগপুর, ১১ ডিসেম্বর।

সফল: মেট্রো রেলের দ্বিতীয় পর্যায়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে প্রধানমন্ত্রী মোদী মেট্রো নিবেদন করলেন ‘জাতির উদ্দেশে’, নাগপুর, ১১ ডিসেম্বর। ছবি পিটিআই।

শাহরুখ খান প্রায়ই বলেন, তিনি আসলে ‘শাহরুখ খান’ নামক ‘ব্র্যান্ড’-এর একনিষ্ঠ কর্মচারী। ‘শাহরুখের ম্যাজিক’ বা তাঁকে ঘিরে ‘মিথ’-এর জন্যই তিনি কাজ করেন। রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা খাটে। বিজেপি গুজরাতে রেকর্ড আসনে জিতে টানা সাত বার ক্ষমতায় ফেরার পরে নতুন করে ‘মোদী ম্যাজিক’ নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। উল্টো দিকে কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি-সহ বিরোধী নেতারা বার বার বলার চেষ্টা করছেন, ‘মোদী ম্যাজিক’ বলে বাস্তবে কিছু নেই। থাকলে হিমাচলের বিধানসভা ভোট বা দিল্লি পুরভোটেও বিজেপি জিতত।

বিরোধী দলের রাজনীতিকরা যেটা স্বীকার করেন না, তা হল, ‘মোদী ম্যাজিক’ বা ‘নরেন্দ্র মোদী’ নামক জাদু যাতে কাজ করে, তার জন্য নরেন্দ্র মোদী প্রবল পরিশ্রম করেন। তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে অমিত শাহ, জগৎপ্রকাশ নড্ডা, বি এল সন্তোষ-সহ গোটা বিজেপি নেতৃত্বকেই পরিশ্রম করতে হয়। শুধু ভোটের আগে কয়েক দিন নয়। সারা বছরই তাঁরা দিন-রাত এক করে দলের নির্বাচনে জেতার রণকৌশল তিনি করেন। কোন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করতে হবে, কোথায় কাকে আর প্রার্থী করা চলবে না, কোন রাজ্যে কোন সম্প্রদায়ের মানুষ বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন না, তাঁদের মন জিততে কী করা উচিত, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে চলেন। সামনে মোদীর মুখ, পিছনে এই ‘হোমওয়ার্ক’, হিসাবনিকাশ সব ঠিকঠাক মিললেই বিজেপি ভোটে জেতে। এই সবটা মিলিয়েই ‘মোদী ম্যাজিক’ তৈরি হয়।

Advertisement

এ দেশের রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদী একটা অলিখিত নিয়ম প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তা হল, ‘পার্টটাইম’ রাজনীতির আর কোনও জায়গা নেই। মোদী তথা বিজেপি-আরএসএস’এর সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে শুধু ভোটের আগে নয়, সারা বছর রাজনীতিতে থাকতে হবে। পোশাক থেকে দাড়ির দৈর্ঘ্য, বাড়ির বৈঠকখানায় মায়ের সঙ্গে দেখা করা থেকে গুহায় বসে ধ্যান করার সময়ও রাজনীতি ভুললে চলবে না।

গুজরাতের কথাই ভাবা যাক। ২০১৭-তে ১৮২টি আসনের মধ্যে বিজেপি মাত্র ৯৯টি আসনে জেতার পরেই নরেন্দ্র মোদী বিপদ টের পেয়েছিলেন। গত পাঁচ বছরে বিজেপি শুধু কংগ্রেসে ভাঙন ধরায়নি। মুখ্যমন্ত্রী বদল করেছে। প্রবীণ মন্ত্রী, বিধায়কদের মধ্যে কাদের আর প্রার্থী করা চলবে না, তার তালিকা তৈরি করেছে। মোদী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে আমদাবাদে হাজির হয়েছেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভোট হবে বলে মার্চ থেকে প্রতি মাসে অন্তত এক বার করে গুজরাতে গিয়েছেন। এক লক্ষ কোটি টাকার বেশি অর্থমূল্যের প্রকল্প শিলান্যাস বা উদ্বোধন করেছেন। ভোট ঘোষণার পরে নয় বার গুজরাতে গিয়ে ২৭টি জনসভা করেছেন।

যদি ভাবেন, এটাই ‘মোদী ম্যাজিক’, তা হলে ভুল করবেন। অমিত শাহ ভোটের আগে সপ্তাহের পর সপ্তাহ দিল্লি ছেড়ে আমদাবাদে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। রাজ্যের বিজেপি সভাপতি চন্দ্রকান্ত পাটিল দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত আড়াই বছরে সংগঠনের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন। রাজ্যে দলের ৮২ লক্ষ সদস্যের ঠিকুজি-কোষ্ঠী তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল। জনজাতি থেকে ওবিসি, প্রতিটি সম্প্রদায়ের ভোট পেতে পৃথক রণকৌশল তৈরি হয়েছিল।

শুধু জনজাতি সম্প্রদায়ের কথাই ধরা যাক। প্রায় তিন দশক ক্ষমতায় থেকেও বিজেপি কোনওদিনই গুজরাতের জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় ভাল ফল করেনি। মোদী-শাহ গত পাঁচ বছর ধরে সে জন্য কাজ করেছেন। দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি করেই হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। গুজরাতের জানজাতিদের ভোট পেতে মোদী রাজস্থানের মানগড়ে গিয়েছিলেন। যেখানে জনজাতিরা ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। রাজ্যে রাজ্যে জনজাতি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে। বীরসা মুন্ডার জন্মদিনকে জনজাতীয় গৌরবদিবস হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। তার সঙ্গে আরএসএস’এর দীর্ঘ দিন ধরে জনজাতিদের মধ্যে কাজের ভিত ছিলই। এরই ফল হল, ২৭টি জনজাতি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে বিজেপি এ বার ২৪টিতে জিতেছে। এর পরে ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের ভোটে জনজাতি এলাকাতেও এর সুফল মিলতে পারে।

বিজেপি জানে, সব দান সব সময় ঠিক পড়বে না। প্রতি বার মানুষ সব ভুলে শুধু মোদীকে দেখে ভোট দেবেন না। সব রাজ্যে মেরুকরণ কাজ করবে না। হিমাচলে অনেক বিজেপি নেতাকে টিকিট না দেওয়ার তার খেসারত দিতে হয়েছে। মোদী হিমাচলে গিয়ে শুধু তাঁকে দেখে ভোট দিতে বলেছিলেন। সেই কৌশল কাজে লাগেনি। হিমাচলে বিজেপির সরকার, দিল্লির পুরসভায় বিজেপির কাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বড় বিষয় হয়ে উঠেছে।

তা বলে মোদী কিংবা শাহরা বসে থাকেন না। গুজরাত-হিমাচল-দিল্লির ভোটের ফল প্রকাশের আগেই বিজেপি আগামী বছর নয়টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ও ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। ভোটের ফলের পরেই নরেন্দ্র মোদী মহারাষ্ট্র থেকে গোয়ায় একগুচ্ছ প্রকল্প উদ্বোধন সেরে ফিরেছেন।

উল্টো দিকে রাহুল গান্ধীকে দেখা যাক। ২০১৪-তে কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতা হারালেও দলের মধ্যে হাহাকার উঠে যায়নি। রাহুলের ঘনিষ্ঠ নেতারা দলে দলে কংগ্রেস ছাড়তেও শুরু করেননি। ২০১৪-য় লোকসভা ভোটে হারলেও কংগ্রেস ২০১৮-য় তিনটি রাজ্যে একার জোরে ক্ষমতা দখল করেছিল। তার আগে মোদী-শাহর গুজরাতেই বিজেপিকে প্রায় হারের মুখে টেনে এনেছিল। কর্নাটকে জেডিএস-কে সঙ্গে নিয়ে এবং মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, এনসিপি-কে সঙ্গে নিয়ে বিজেপির ক্ষমতায় ফেরা আটকে দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৯-এ লোকসভা ভোটে হেরে যাওয়ায় রাহুল গান্ধী ভোটের রাজনীতির ময়দান থেকেই সরে গেলেন। ছোটবেলায় পাড়ার মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে গিয়ে বাচ্চা ছেলেরা ‘রইল তোর ব্যাট, রইল তোর বল, রইল তোর উইকেট, আমি আর খেলব না’ বলে চলে যায়। রাহুল তেমনই কংগ্রেসের সভাপতি পদ ছেড়ে দিলেন। রাহুল বা কংগ্রেস নেতারা মানতে চান না। আসলে ভোটের হার নয়। রাহুলের ওই পদত্যাগের পর থেকেই তরুণ নেতাদের দলত্যাগ, প্রবী‌ণ নেতাদের বিক্ষোভ মিলিয়ে কংগ্রেসের আসল সঙ্কটের সূচনা। এখন রাহুলকে সেই মোদীর সঙ্গে যুঝতেই রাস্তায় নামতে হয়েছে।

রাজনীতিতে খেলার ময়দান ছাড়তে নেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৪ বছরের বাম শাসনে ধস নামিয়েছিলেন। মোদী, শাহরাও জানেন, কোনও রাজ্যে বিধানসভা ভোটে হারলেই খেলা শেষ হয় না। পরের লোকসভা ভোটে জেতার জন্য ঝাঁপাতে হয়। সে কারণেই ২০১৮-য় ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের বিধানসভা ভোটে হেরেও, পরের বছরই লোকসভা ভোটে তিন রাজ্যের অধিকাংশ আসন বিজেপি নিজের পকেটে পুরেছিল।

বিরোধীরা আশা করতেই পরেন, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বা গুজরাতের বিধানসভা ভোটে বিজেপি জয়ের রেকর্ড গড়লেও ভবিষ্যতে তাদের হারানো সম্ভব। কংগ্রেসই তো ১৯৮৪-তে লোকসভায় ৪১৪টি আসনে জিতে পাঁচ বছর পরে হেরে গিয়েছিল। গুজরাতেও ১৯৮৫-তে কংগ্রেস রেকর্ড আসনে জিতে পরের ভোটে হেরেছিল।

পার্থক্য একটাই। নরেন্দ্র মোদী শুধু একের পর এক ভোটেই জিতছেন না। নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে ফেলছেন। তাঁর ভোটাররা সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সত্ত্বেও মোদীকে ভোট দিয়ে ভাবেন, তাঁরা দেশের নিরাপত্তা, উন্নয়ন, সার্বভৌমত্বের পক্ষে ভোট দিচ্ছেন। তাঁরা নির্বাচনকে হিন্দু ধর্ম, ভারতীয় সংস্কৃতি, জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রাখার লড়াই হিসেবে দেখেন। দৈনন্দিন জীবনে বেকারত্ব বা বাজারদরের সমস্যা সেখানে গৌণ হয়ে যায়।

এটাই ‘মোদী ম্যাজিক’। নরেন্দ্র মোদী তাঁকে ঘিরে এই ‘মিথ’-এর জন্যই কাজ করে চলেন।

আরও পড়ুন
Advertisement