স্বৈরাচারের বন্ধু ছদ্মবিজ্ঞান
Autocracy

বিজ্ঞানের নামে যখন ফিরে আসে অপশাসন ও বিদ্বেষনীতি

ইউজেনিক্স কি বিজ্ঞান ছিল? আদৌ না। তাকে বড় জোর ছদ্ম-বিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞান বলা যেতে পারে, যার জন্ম হয়েছিল রাজনীতির আঁতুড়ঘরে।

Advertisement
স্বাগতম দাস
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২১ ০৬:০৯
অমানবিক: পোল্যান্ডের শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে নাৎসি-জার্মান আধিকারিকরা, ১৯৩৯। ছবি: উইকিপিডিয়া

অমানবিক: পোল্যান্ডের শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে নাৎসি-জার্মান আধিকারিকরা, ১৯৩৯। ছবি: উইকিপিডিয়া

একটি নিয়ম চালু হয়েছিল জার্মানিতে, ১৯৩৯ সালের অগস্ট মাসে। তিন বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে যাদের কোনও বিকলাঙ্গতা বা ডাউন সিনড্রোমের মতো জিন-ঘটিত সমস্যা রয়েছে, তেমন সন্তানের মা-বাবার উপর রাষ্ট্র হুকুম জারি করেছিল যে, সন্তানের নাম নথিভুক্ত করতে হবে সরকারি দফতরে। হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগগুলোতেও জারি হয়েছিল নির্দেশিকা— যে কোনও বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মানো সদ্যোজাতকে সরকারি তালিকায় নথিভুক্ত করতে হবে।

তার এক মাসের মধ্যেই এই শিশুদের বাড়ি থেকে তুলে আনা হতে লাগল কিছু বিশেষ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। মা-বাবারা আপত্তি করলেন, বিশেষত ক্যাথলিক-প্রধান অঞ্চলগুলোতে। কিন্তু সরকারি আধিকারিকরা তাঁদের বোঝালেন যে, শিশুটির বিশেষ চিকিৎসার জন্যই মহামান্য ফুয়েরারের নির্দেশে স্বাস্থ্য দফতর এই ব্যবস্থা করছে। এতেও না বুঝলে, রাতারাতি গোটা পরিবারকেই গায়েব করে দিত গেস্টাপো পুলিশের দল।

Advertisement

এই ভাবে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে, একটি নীরোগ জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শুরু হল পৃথিবীর নির্মমতম শিশুমেধ যজ্ঞ। অসহায়, অসুস্থ বাচ্চাদের বিষ-ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলতে ফেলতে কিছু নাৎসি ডাক্তার পিতৃভূমির প্রতি কর্তব্য পালন করতে লাগলেন। হিটলারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক কার্ল ব্রেন্টের অধীনে ‘অ্যাকশন ফোর প্রজেক্ট’-এর সেই শুরু। পরবর্তী ছ’বছরে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত রাষ্ট্রের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন ৩ লক্ষ মানুষ— শুধু বিকলাঙ্গ হওয়ার বা জিন-ঘটিত কোনও রোগ থাকার অপরাধে। এই রোগের তালিকায় ছিল সমকামিতাও। আর কী আশ্চর্য, সেই হননবেলায় জার্মানির বহু শিক্ষিত মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন, এই ভাবেই হিটলারের নেতৃত্বে গড়ে উঠবে এক রোগমুক্ত জার্মান জাতি। সেই বিশ্বাসের বুনিয়াদ গঠন করেছিল রাজনীতি ও কায়েমি স্বার্থের মিশেলে তৈরি হওয়া এক ছদ্মবিজ্ঞান— যার নাম ইউজেনিক্স।

স্যর ফ্রান্সিস গ্যালটন প্রবর্তিত ‘ইউজেনিক্স’ শব্দটা এসেছে ল্যাটিন ‘ইউজেনেস’ থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ— সুপ্রজাত। ইউজেনিক্সের মূল বিষয় হল, কোনও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলো থেকে যাবতীয় অনভিপ্রেত জিন দূর করা। ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কের ‘আমেরিকান মিউজ়িয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’-তে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বংশগতি এবং ইউজেনিক্সের প্রথম নজরে পড়ার মতো বৃহৎ সমাবেশটি। অংশ নিয়েছিলেন প্রায় তিনশো বিজ্ঞানী এবং সরকারি নীতি-নির্ধারকের দল। এই সমাবেশের অন্যতম উদ্যোক্তা হ্যারি লাফলিন ছিলেন মডেল ইউজেনিক্যাল স্টেরিলাইজ়েশন ল নামক বইটির লেখক। তিনি ‘বৈজ্ঞানিক’ যুক্তি খাড়া করে সওয়াল করতেন, আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নির্বীজনের ব্যবস্থা হোক। কাদের? একটি তথাকথিত সুস্থ সবল জাতি গঠনের মতো যথেষ্ট অভিপ্রেত বৈশিষ্ট্য যাঁদের মধ্যে নেই, যাঁরা হয়তো ভুগছেন বিকলাঙ্গতা বা বামনত্বে, যাঁদের আছে কোনও জিন-ঘটিত সমস্যা— এমন কোনও ব্যক্তিরই আর প্রজননের অধিকার থাকবে না। এই ভাবেই এঁদের জিন ক্রমশ অবলুপ্ত হবে। বইটি অনতিবিলম্বে ইংরেজি থেকে জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়, নাৎসি জার্মানির কর্তাব্যক্তিদের অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠে।

ইউজেনিক্সের এই আলোচনাসভার কোষাধ্যক্ষ ম্যাডিসন গ্রান্ট বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর দ্য পাসিং অব দ্য গ্রেট রেস বইটির জন্য। মানবজাতির মধ্যে শ্বেতাঙ্গরাই যে সব দিক থেকে শ্রেষ্ঠ, জীববিজ্ঞান ও বিবর্তনবাদের কিছু তত্ত্বকে দুমড়ে মুচড়ে এই মতটিকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এই বইটির বিষয়বস্তু। এই ধরনের অতিসক্রিয় ইউজেনিস্টদের প্রভাবে পরের চারটি দশকে আমেরিকাতে বলপূর্বক নির্বীজনের শিকার হয়েছিলেন প্রায় সত্তর হাজার মানুষ, যাঁদের অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান আমেরিকান, দরিদ্র এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর। এই ধারণাগুলোই হিটলারের ইহুদি-নিধন যজ্ঞ বা হলোকস্টে নিয়েছিল অনুঘটকের ভূমিকা।

ইউজেনিক্স কি বিজ্ঞান ছিল? আদৌ না। তাকে বড় জোর ছদ্ম-বিজ্ঞান বা অপবিজ্ঞান বলা যেতে পারে, যার জন্ম হয়েছিল রাজনীতির আঁতুড়ঘরে। সেই রাজনীতি, যার কেন্দ্রে ছিল সমাজের শক্তিশালী ও সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতায়ন। বংশগতিবিজ্ঞান বা জেনেটিক্স-এর সে দিনের জায়মান অবস্থার সুযোগে তথ্যনিষ্ঠ গবেষণার দ্বারা আদৌ সমর্থিত নয়, এমন কতকগুলো মনগড়া তত্ত্বকে বিজ্ঞানের ছদ্মবেশে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতান্ধ কয়েকটা রাষ্ট্রের সামনে। আজকের দিনে, নিরপরাধ ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে ঘিরে ধরে পিটিয়ে মারতে গিয়ে, অজুহাত হিসাবে যে ভাবে জল্লাদেরা তুলে ধরে মনুস্মৃতি বা হাদিস-এর উদ্ধৃতি, সে দিনও সে ভাবেই ‘অ্যাকশন ফোর’ কর্মসূচির ভিত্তি হিসাবে তুলে ধরা হত ইউজেনিক্সের তত্ত্ব।

প্রকৃত বিজ্ঞানসাধকরা প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু তাতে কিছু আটকায়নি, তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশগুলোতে ইউজেনিক্স ও রেশিয়াল হাইজিন-এর মতো বিষয়ে গবেষণার জন্যে সরকারি অর্থানুকূল্যের অভাব হয়নি। ঠিক যেমন, আজকের ভারতে ক্যানসার নিরাময়ে গোমূত্রের উপযোগিতা বা করোনা রোগীদের গায়ত্রীমন্ত্র শোনানোর ফলাফল নিয়ে গবেষণায় রাষ্ট্রীয় অর্থের অভাব হয় না। এই ধরনের গবেষণায় বিজ্ঞানচর্চা হোক বা না হোক, একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শকে বিজ্ঞানের মোড়কে মুড়ে পরিবেশন করতে চিরকালই এগুলো ভীষণ কাজে লাগে।

১৯৪৮ সালে জার্মানির ন্যুরেমবার্গে নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলাকালীন হলোকস্টের পৈশাচিক ইতিহাস সামনে আসে। এর ফলে ইউজেনিক্সের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। বহু বিজ্ঞানী এই বিষয়টির চর্চা ছেড়ে দেন। অনেক ইউজেনিক গবেষণাগার রাতারাতি পাল্টে যায় জেনেটিক্স বা পপুলেশন বায়োলজির গবেষণাগারে। কিন্তু একশো বছর পরের এই পৃথিবীতে সত্যিই কি ইউজেনিক্সের চর্চা বন্ধ হয় গিয়েছে, না কি নব্য-নাৎসিদের মতো সেও নিয়েছে কোনও যুগোপযোগী নতুন সাজ? মনে রাখতে হবে, আজ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভাবনীয় উন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কৃত হয়েছে ‘প্রিসিশন জিন এডিটিং’-এর মতো এমন প্রযুক্তি, যার মধ্যে রয়েছে মানুষের জৈবিক চরিত্রটির খোল-নলচে পাল্টে দেওয়ার অপরিসীম সম্ভাবনা। কিন্তু ব্যবসার স্বার্থে, বিজ্ঞান যা পারে তার চেয়েও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বেশ কিছু কোম্পানি আমেরিকা এবং দক্ষিণ কোরিয়া জুড়ে খুলে বসেছে বিভিন্ন জেন্ডার সিলেকশন ক্লিনিক। হবু মা-বাবাদের বলা হচ্ছে, সন্তানধারণের পর ‘বৈজ্ঞানিক’ পদ্ধতিতে তাঁরা তার লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারবেন তো বটেই, সেই সন্তানের গায়ের রং থেকে বুদ্ধির পরিমাণ, সবই সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই নির্ধারণ করা যাবে।

২০১৭ সাল থেকে আরএসএস-এর স্বাস্থ্য শাখা আরোগ্য ভারতী জোরকদমে প্রচার চালাচ্ছে তাদের ‘গর্ভ বিজ্ঞান সংস্কার’ নামক প্রকল্পটির। এই প্রকল্প দাবি করছে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের হাত ধরে গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ থেকে শুরু করে বুদ্ধ্যঙ্ক, সবই আমূল সংস্কার করা সম্ভব। আরোগ্য ভারতী জোর দিচ্ছে ভারতের প্রতিটি রাজ্যে যত সম্ভব এ রকম ‘উত্তম সন্ততি’ উৎপাদনের উপর— জানাচ্ছে, এই পথেই গড়ে উঠবে এক সুস্থ ও সক্ষম ভারত। অতীব উদ্বেগজনক এই ঘটনা। ব্যবসার মোড়কে, ধর্ম আর রাজনীতির মিশেলে, আধুনিক বিজ্ঞানের ছদ্মবেশ চাপিয়ে ফিরে আসছে না তো ইউজেনিক্স?

যে দেশের কপালে রক্তের দাগের মতো লেগে থাকে বাৎসরিক কন্যাভ্রূণ হত্যার এক ভয়াবহ পরিসংখ্যান, সেখানে এ রকম চিন্তাধারা লিঙ্গ-বৈষম্যকে ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। এবং, সচেতন থাকা দরকার, যাতে ১৩৫ কোটির এই দেশে, অদূর ভবিষ্যতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে কোনও জনগোষ্ঠীকে নিশানা না করতে পারে রাষ্ট্র।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট

আরও পড়ুন
Advertisement