হস্তান্তর: রাজ্য সরকারের জনকল্যাণ প্রকল্পের খাতায় নাম লেখাতে নাগরিকদের ভিড়, বেলগাছিয়া, কলকাতা। ছবি: সুমন বল্লভ
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা ছাড়াও অনেকগুলি দিক থেকে দেখলেই বিদায়ী বছরটি স্মরণে রাখার মতো। বহু পরিবারকেই স্বজন হারানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা পেরোতে হয়েছে। অন্য দিকে লকডাউন-পরবর্তী আয়-সঙ্কোচন অনেক পরিবারকে বিধ্বস্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এরই মধ্যে সাম্প্রতিকতম বিধানসভা নির্বাচনটি দেখলেন। অতিমারির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের উদ্যাপন। তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ইস্তাহারে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মেনে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু করল। ব্যাপ্তি এবং প্রভাবের দিক থেকে দেখলে প্রকল্পটির গুরুত্ব যদিও কম নয়, এর ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা তেমন দেখিনি। যা দেখেছি তা এক অতি সরলমনা অবস্থান— রাজকোষ উজাড় করে দানখয়রাতি করে সরকার দেউলিয়া হওয়ার পথে হাঁটছে। বিরোধী দলগুলির এই সমালোচনায় অবশ্য রাজ্যবাসীর গরিষ্ঠ অংশের বিশেষ মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না, কারণ পরিবার দেউলিয়া হলে কী হতে পারে তার খানিক আন্দাজ আমরা করতে পারি, কিন্তু দেশের একটি অঙ্গরাজ্য দেউলিয়া হলে ঠিক কী পরিণতি হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।
নির্বাচনী প্রতিযোগিতার স্বাভাবিক নিয়মেই প্রায় সব রাজনৈতিক দলই তাদের ইস্তাহারে কর্মসংস্থান থেকে নগদ হস্তান্তর— এমন নানান সুযোগসুবিধার প্রতিশ্রুতি কমবেশি দিয়েছিল। সরাসরি নগদ অর্থ বণ্টন রাজনীতিকদের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই ভারী আকর্ষণের বস্তু। কারণ তাঁরা মনে করেন এ ভাবে আনুগত্য নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু শুধু এই কারণে নগদ হস্তান্তরের বিরোধিতা করারও মানে হয় না। যে মহিলার নিজের রোজগার নেই, অথবা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর দিনান্তে সামান্য কিছু জোটে যাঁর, তাঁর কাছে এই পাঁচশো টাকার গুরুত্ব যে অসীম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মজা পাই যখন দেখি, কোনও বিরোধী দল এই ধরনের প্রকল্পের সমালোচনা করতে গিয়ে যে যুক্তিটি এনে ফেলে, তা সমাজের উচ্চবেতনভুক সম্প্রদায়ের অধিকাংশের মানসিকতার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। গরিবরা ‘এমনি এমনি’ টাকা পাচ্ছে দেখলে এই শ্রেণির মানুষ অস্থির হয়ে ওঠেন। তিরিশ দিন অন্যের বাসন মেজে তবেই এক জন হাজার টাকা পেতে পারেন, এটাই যখন নিয়ম, সেখানে কিছু না করেই পাঁচশো? শিল্প নেই, চাকরি নেই, শুধুই টাকা বিলিয়ে ভোট কেনা! যেন লক্ষ্মীর ভান্ডারের ওই টাকাটুকু মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে না ঢুকলে শিল্পের রথ গড়গড়িয়ে চলত।
এটি হচ্ছে বলেই ওটি হতে পারছে না— এই সহজ কার্য-কারণ সম্পর্কে উপনীত হওয়ার আগে একটু তলিয়ে ভেবে দেখা যাক। শিল্প হচ্ছে না কেন তার ছত্রিশটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সরাসরি কল্যাণমুখী ব্যয়ের কারণে যে তা হচ্ছে না তা প্রমাণ করা শক্ত। মনে রাখতে হবে, নগদ টাকা হস্তান্তরে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়— কেউই আপত্তির কারণ দেখেন না। তবু সদা-সন্দেহাকুল বুঝদার মানুষের মনে প্রশ্ন একটা থেকেই যায়, এত টাকা আসবে কোত্থেকে? সরকার কি এ জন্যে ‘দেউলিয়া’ হয়ে যাবে না? ২০২১-২২ আর্থিক বছরের বাজেটে লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সাত হাজার কোটি টাকা। ওই টাকায় সমস্ত শর্ত মেনে প্রায় দু’কোটি মহিলার অ্যাকাউন্টে মাসে মাসে ৫০০ (তফসিলি জাতি ও জনজাতির জন্য ১০০০) টাকা দেওয়া যাবে আগামী মার্চ পর্যন্ত। এ পর্যন্ত এই প্রকল্পে নথিভুক্তির অগ্রগতির হার যে রকম দেখছি, মোট প্রাপকের সংখ্যা দু’কোটির অনেকটা কমই হবে বোধ হয়। অতএব খরচও সাত হাজার কোটি হবে না। ২০২১-২২’এ রাজকোষে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৬০,৮৬০ হাজার কোটি টাকা, যা রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (যাকে জিএসডিপি বলা হয়) ৪.০৩ শতাংশ। লক্ষ্মীর ভান্ডারের সাত হাজার কোটি বাদ দিলে ঘাটতি দাঁড়াত ৫৩,৮৬০ হাজার কোটি। বছরের শেষে যখন হিসাব কষে দেখা হবে, তখন মোট ঘাটতির পরিমাণ একে ছাপিয়েও যেতে পারে— কোভিড-পরবর্তী এ রকম অস্বাভাবিক সময়ে যা স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্যই যে ঘাটতির পরিমাণ লাগামহীন বেড়ে উঠে সরকারকে ঋণে জর্জরিত করে দেউলিয়ায় পরিণত করবে, তা বলা যায় না। কারণ, মোট ঘাটতি বাড়লেও লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ চলতি বছরে সাত হাজার কোটি ছাড়াবে না কিছুতেই। আগামী বছর থেকে অবশ্য লক্ষ্মীর ভান্ডার বাবদ প্রয়োজন হবে বারো হাজার কোটি টাকা।
কন্যাশ্রীর সঙ্গে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মূল একটি পার্থক্য রয়েছে, যা আমাদের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্পকে বলা হয় ‘শর্তাধীন হস্তান্তর’। কারণ প্রকল্পের সুবিধা পেতে হলে অল্প বয়সে বিয়ে করে পড়া ছেড়ে দিলে চলবে না। আর লক্ষ্মীর ভান্ডার ‘শর্তহীন’। এই দু’রকম নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের দৃষ্টান্তই উন্নয়ন বিশ্ব জুড়ে রয়েছে, এবং এদের গঠনেও বিশেষ সমস্যা নেই। কিন্তু এদের মূল্যায়ন করতে গেলে অভীষ্ট লক্ষ্যের সাপেক্ষে তা করতে হয়। কন্যাশ্রীর সুবিধা সত্ত্বেও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের স্কুলছুট এবং অল্প বয়সে বিয়ে যে দ্রুত কমানো যাচ্ছে না, এটা ভাবার বিষয়। কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডারের মূল্যায়নে তেমন অস্বস্তির সম্ভাবনা নেই, কারণ এর লক্ষ্য কন্যাশ্রীর মতো তেমন নির্দিষ্ট নয়। এর লক্ষ্য, বলা যেতে পারে, মহিলাদের করণ-স্বক্ষমতা-নিজ বিবেচনা অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা।
এক দিকে বড় শিল্প, বড় বিনিয়োগ, আর্থনীতিক বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, আর অন্য দিকে ব্যয়বহুল সরাসরি কল্যাণমূলক প্রকল্প— এই দুইয়ের মধ্যে পাল্লাটা কোন দিকে ঝুঁকবে, তা নিয়ে বিতর্ক উন্নয়নচর্চায় নতুন নয়। ফলে, সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসাও সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কটি যে মূলত দ্বন্দ্বমূলক নয়, তা চর্চার জগতে মোটামুটি স্বীকৃত। বস্তুত, উন্নয়নশীল দেশে এই কল্যাণমূলক ব্যয়ের পথ ধরে যে আর্থনীতিক বৃদ্ধি সম্ভব, তাও স্বীকৃত। তাই শেষমেশ প্রশ্নটা দাঁড়ায় কোন ধরনের কল্যাণমূলক প্রকল্প অর্থনীতির ভবিষ্যৎকে কতটা পোক্ত করতে পারে। গবেষণায় দেখা যায়, মহিলাদের হাতে খরচ করার ক্ষমতা থাকলে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকে নজরদারি বাড়ে, যা মানবোন্নয়নের মধ্যে দিয়ে অর্থনীতির স্বাস্থ্যকেও উন্নত করে। হাতের কাছেই উদাহরণ রয়েছে— বাংলাদেশ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের মধ্যে অর্থকরী কাজে যোগদানের হার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। তাই সরাসরি নগদ হস্তান্তরে যে এ রাজ্যের বিপুল সংখ্যক মহিলার হাতে অল্প হলেও কিছু টাকা আসছে, তার সামাজিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কোন দল এর থেকে কী ফয়দা ওঠাল, সে প্রশ্ন তাই অবান্তর হয়ে যায়।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়। নগদ হস্তান্তর, না মানব উন্নয়নমূলক পরিষেবা প্রদান? যেমন স্বাস্থ্য বা শিক্ষা। কোন কোলে বাজেটের ঝোলটুকু বেশি টানা উচিত? প্রযুক্তির সুবিধার কারণে এখন প্রশাসনিক কেন্দ্র থেকে সরাসরি মানুষের কাছে নগদ পৌঁছে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। তাই লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পকে বলা যায় ‘নাগালে ঝুলন্ত ফল’। কিন্তু মানুষের কাছে শিক্ষা কিংবা স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার শর্টকাট নেই। বরাদ্দ অর্থকে পরিষেবায় রূপান্তর ও তা গ্রহীতার কাছে পৌঁছনোর পথটি দীর্ঘ ও জটিল। কারণ, এই প্রক্রিয়াটিতে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে ব্যবস্থাপনা আর বিপুল সংখ্যক মানুষ যাঁরা পরিষেবা দেওয়ার কাজে যুক্ত। তাই আশঙ্কা হয়, নাগালে ঝুলন্ত ফলের আকর্ষণে অন্য পরিষেবার ব্যবস্থাপনার দিকটি আড়ালে না চলে যায়। লক্ষ্মীর ভান্ডারের কারক ভূমিকাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়, যা এক জন মহিলাকে করণ-স্বক্ষমতা দিতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এ রকম প্রকল্পের সঙ্গে লেপ্টে যায় দাতা-গ্রহীতার অনুষঙ্গটি। প্রকল্পের কারক ভূমিকাটি পূর্ণ বিকশিত হতে পারে এর পরিপূরক মানব উন্নয়নমূলক পরিষেবাগুলির মধ্যে দিয়ে। বিদ্যালয় শিক্ষার কথাই ধরা যাক। কোভিড-পরবর্তী কালে শিক্ষা পরিষেবার ব্যবস্থাপনায় যে রকম ইতস্তত ফুটে উঠছে দিশাহীনতার লক্ষণ, আশঙ্কা হয় লক্ষ্মীর ভান্ডার-সৃষ্ট করণ-স্বক্ষমতার সুযোগের এ দিকটা হয়তো অধরাই থেকে যাবে। জানি, লক্ষ্মীর ভান্ডার যে দ্রুততায় ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে পারে, বিদ্যালয় শিক্ষা তা পারে না। তবু লক্ষ্যটি তো রাখতে পারি।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা