কুণাল কামরাকে নিয়ে প্রবল আলোড়ন হল কয়েক দিন। তার পর ওই প্রসঙ্গে ফের সব শান্ত। শান্তি ফিরে আসার আগে অবশ্য বেশ কয়েকটা প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল কামরার রাজনৈতিক ব্যঙ্গ।
প্রথম যে প্রশ্ন তা হল— এক জন রঙ্গশিল্পীর সমালোচনায় কেন নেতারা এতটা উতলা হলেন? বিশেষত কামরার কৌতুক যখন সমাজের এমন এক শ্রেণির কাছে পৌঁছয় যাঁরা ঠিক আমজনতা নন। কলকাতায় কোন ধরনের প্রেক্ষাগৃহে কুণালের অনুষ্ঠান হয় ও কারা দেখতে যান এটা একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে, প্রধানত ভারতের যেটা দক্ষিণপন্থা-বিরোধী ‘এলিট’, সেই অংশটিই কামরার দর্শক বা শ্রোতা, বিশেষত যখন তা প্রেক্ষাগৃহে হয়।
এই শ্রেণির কথা বাদ দিয়ে রাজনীতিকে ভাবা যেতেই পারত, কারণ এঁদের ভোট খুব বেশি নয়। কিন্তু সেটা যাচ্ছে না কয়েকটি কারণে।
প্রথমত, হিন্দুত্ববাদী দলের নেতাদের একটা ‘ফুল স্পেকট্রাম ডোমিনেন্স’ বা সর্বস্তর নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য রয়েছে। এটা ঠিক কংগ্রেস ঘরানার রাজনীতি— মানে যে রাজনীতির ভিতরে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো দলও রয়েছে— সেটার থেকে আলাদা। কংগ্রেস ঘরানার রাজনীতিতে সর্বস্তরে, সবাইকে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা হয় না। তাদের লক্ষ্য নির্বাচন জেতা, ক্ষমতায় যাওয়া, মানুষের জন্য কাজ করা ও ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় থাকা। নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসা এবং দুর্নীতি করা— এই দু’টি যে হিন্দুত্ববাদী দলের লক্ষ্য নয়, তা একেবারেই বলা যাবে না। কিন্তু তাদের এ সবের উপরেও একটা বাড়তি ‘লক্ষ্য’ আছে, যেটা কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেসের নেই।
এই লক্ষ্য হল সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্য। অর্থাৎ, সমাজ তাদের চিন্তায় ও কাজের দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং তাদের আদর্শে কাজ করবে। এই জিনিসটা কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী দল, রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা বিজেপির শরিক প্রায় কোনও দলেরই নেই। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী দলের এই লক্ষ্য রয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে বিজেপি একটি বিপ্লবী দল। দক্ষিণপন্থী বিপ্লবী, কিন্তু বিপ্লবী।
অর্থাৎ, ক্ষমতায় থাকা তাদেরও উদ্দেশ্য। কিন্তু আবার শুধু ক্ষমতায় থাকা-ই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সমাজ পরিবর্তনও তাদের উদ্দেশ্য। এই কারণে তারা এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বা চায়, যেগুলি সরাসরি নির্বাচনকে প্রভাবিত করে না, কিন্তু তাদের আদর্শটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যেমন ‘নয়া শিক্ষানীতি’, যা তাদের আদর্শ আরও গভীরে নিয়ে যাবে, নির্বাচনে বিস্তৃতি না দিলেও।
তারা নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও ভয় পায় না। নানান ঝুঁকিও তারা নিতে পারে— যেমন হিন্দি ভাষাকে সর্বত্র চাপানোর চেষ্টা। এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সাহস এখন তারা আরও বেশি দেখাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেখাবে। কেননা আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নেতা-সমর্থকদের এরা উজ্জীবিত করতে চায়। এর জন্য ওই ‘ফুল স্পেকট্রাম কন্ট্রোল’ জরুরি। এখন এই ‘ফুল স্পেকট্রাম কন্ট্রোল’ করতে গেলে কুণাল কামরার মতো লোককে ছেড়ে রাখলে চলে না। তাঁকে যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁর বক্তব্য সমাজমাধ্যমে তুলে ধরেন তাঁদের ছেড়ে রাখলেও চলে না। ফলে, যত দিন যায় কামরার মতো শিল্পীদের উপরে আক্রমণ আরও জোরালো হয়।
দ্বিতীয়ত, কুণাল কামরার মতো জনপ্রিয় ‘পারফর্মার’কে একক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল। কারণ, তিনি প্রবল প্রভাবশালী এবং অর্থবান শিল্পী নন। তিনি বিরাট টাকা খরচ করে ছবি বানাচ্ছেন না বা গান গাইছেন না। ফলে তিনি সহজেই প্রভাবশালীদের নিয়ে হাসাহাসি করতে পারেন।
মোহনলাল পারেন না। সম্প্রতি দক্ষিণের এই মহাতারকা তাঁর আংশিক ভাবে হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী ছবি মুক্তির পরে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন, নতুন করে ছবি ছেঁটেছেন। এটা বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের আক্রমণের কারণে হতে পারে। আবার যাকে বলে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ’ বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার তাড়না থেকেও হতে পারে। আসলে মোহনলালের মতো শিল্পী বা যে সমস্ত শিল্পীর উপরে বাজারের এত প্রভূত বিনিয়োগ আছে— তাঁদের এ কাজ না করে উপায় নেই। প্রাণে বাঁচার থেকেও বড় কথা ‘কেরিয়ার’ বাঁচানোর তাগিদে। ফলে মোহনলাল বা শাহরুখ খানকে নিয়ন্ত্রণ করা সোজা।
কিন্তু কুণালকে নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়, কারণ তাঁর একমাত্র বিনিয়োগ তাঁর নিজের শরীর ও মন। মাথা, গলা, রাগ না করে ব্যঙ্গ করে যাওয়ার বা লেখার ক্ষমতা এবং সাহস। এখন সমস্যা হল ভারতে প্রায় দেড়শো কোটি লোক থাকার ফলে, সব ক্ষেত্রেই দেশে প্রতিভাবান মানুষের অভাব নেই। কুণালের মতো অনেকে আছেন। এই মুহূর্তে ভারতে অসংখ্য ছেলেমেয়ে সমাজমাধ্যমে হিন্দুত্ববাদ বা নির্দিষ্ট নেতা-বিরোধী ভিডিয়ো নানা ভাষায় বানিয়ে ছাড়ছেন এবং রোজগারও করছেন। এটা যদি মহামারিতে পরিণত হয়, তবে সব রাজনৈতিক দলেরই বিপদ। ব্যঙ্গ-শিল্পীদের তাই ভয় দেখানোটাও জরুরি। সেই কারণেও কুণালকে রুখে দেওয়া প্রয়োজন।
এ ছাড়াও আর একটা ভয় আছে। সেটা যে কোনও রাজনৈতিক দলেরই আছে। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার শক্তিকে ভয়। এই ভয় যত দিন যাবে, ততই বাড়বে, কারণ গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যত বেশি দিন একটি দল ক্ষমতায় থাকে, তার বিরুদ্ধে তত ক্ষোভ জমা হয়। কুণালের মতো সমালোচকেরা সেই ক্ষোভে ইন্ধন জোগান।
কুণাল আরও বিপজ্জনক, কারণ তিনি নেতাদের দিকে তাকিয়ে হাসেন। সংসদের ভিতরে দাঁড়িয়ে কোনও নেতার কড়া ভাষায় নিন্দা করা এক জিনিস। সেখানে আপনি তাঁকে অবজ্ঞা করছেন না। কিন্তু কেউ যদি নেতার দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত হাসে, তবে তাঁকে অবজ্ঞা করা হয়। হাসি ও অবজ্ঞার দ্রুত সংক্রমণ ঘটে। যদি এক দিন দলীয় সমর্থকরা নেতার দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করেন তবে তো সমূহ সর্বনাশ। ফলে, যিনি হাসাহাসি করছেন, অন্যদেরও কাতুকুতু দিতে ছাড়ছেন না, তাঁকে রাজ্য ছাড়া বা প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থে দেশছাড়া করতে হবে, জোরালো আঘাত করতে হবে।
আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। কুণাল কামরা বা অন্যান্য রঙ্গ-শিল্পীদের উপরে কোনও বড় বিনিয়োগ না থাকলেও, সমাজমাধ্যম অবলম্বন করে তাঁরা অনেক দূর চলে যাচ্ছেন। এটা নিয়ন্ত্রণও রাজনৈতিক দলের জন্য জরুরি। তবে সমাজমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে এখনই কোনও আইন আসার কথা শোনা যাচ্ছে না। বর্তমানে যে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন আনার চেষ্টা চলছে, সেখানে সমাজমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়নি। কিন্তু প্রায় একই সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তবান মানুষ ইলন মাস্ক সম্প্রতি একটি মামলা করে বলেছেন, বেশ পুরনো তথ্যপ্রযুক্তি আইন ব্যবহার করে সমাজমাধ্যমে তাঁর সংস্থা ‘এক্স’-এর বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তবে কিনা, এটা করা হচ্ছে কিছুটা ঘুরপথে, আইনের নানা মারপ্যাঁচ ব্যবহার করে।
যে-হেতু যত দিন যাবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়া তত বেগ পাবে, তাই ভবিষ্যতে সরাসরি ‘কনটেন্ট’ সরিয়ে নিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সমাজেরও মৌলিক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী দলের নেতারা বুঝে গিয়েছেন, বর্তমান আবহে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে যে কোনও ধরনের সমালোচককে গ্রামছাড়া, রাজ্যছাড়া, দেশছাড়া, পৃথিবীছাড়া করতে পারলে সমাজ আসলে তাঁদের পুরস্কৃত করবে। সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গিয়েছে, নিম্নবিত্তের মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার পরে অভিযুক্তকে তাঁর সমাজ গলায় মালা পরাচ্ছে, পুরস্কৃত করছে।
ফলে শুধুমাত্র কুণাল কামরার উপরে আক্রমণ হল কি হল না, সেটা বড় কথা নয়। যে কেউই আক্রান্ত হতে পারেন— অতএব, নিজের ভাল বুঝে, কম কথা বলবেন, ‘সেল্ফ-সেন্সরশিপ’এর দিকে নজর দেবেন, যেমন দিয়েছেন মোহনলাল। আরও অনেকেই বিষয়টা অভ্যাস করছেন। আশা করতে হবে, যুগ সন্ধিক্ষণে জানমাল ও কেরিয়ার এ ভাবে সুরক্ষিত হবে। আপাতত বেশি হাসাহাসি করার দরকার নেই।