অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো থেকেই জাত দুর্নীতি
Government Hospital

বিকল্প চিন্তার ক্ষমতা কই

আজকের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন অনেক বেশি সামাজিক আবেগ জাগিয়েছে (অনেকটাই তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস হত্যার অভিঘাতে), কিন্তু তুলনায় স্বাস্থ্যসংস্কার চিন্তার দিকটা মনে হচ্ছে সঙ্কীর্ণ।

Advertisement
অনুরাধা রায়
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:২০

১৯৮০-র দশকে বামফ্রন্ট আমলে সরকারি জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনমুখী মেজাজের অনুষঙ্গ ছিল চিকিৎসকসমাজে ও জনপরিসরে স্বাস্থ্যচিন্তার বিলক্ষণ মন্থন। সমসাময়িক প্রতিক্ষণ পত্রিকায় তার নমুনা পাওয়া যায় (এপ্রিল-মে-জুন, ১৯৮৫)। এক প্রাক্তন স্বাস্থ্যসচিব (পরে মুখ্যসচিব), এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক, দুই চিকিৎসক (এক জন সরকারি, অন্য জন সরকারি পরিসরের বাইরে)— এই চার ব্যক্তি মিলিত হয়েছিলেন গোলটেবিল বৈঠকে। তাঁদের আলোচনা তিনটি কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকাটিতে। অনেক তর্ক হয়েছিল, কোনও কার্যকর সিদ্ধান্তে আসা যায়নি, সিদ্ধান্ত রূপায়ণের মতো অবস্থানেও কেউ ছিলেন না। কিন্তু বড় কথা, ভাবনাচিন্তা ছিল বিস্তীর্ণ ও বহুমুখী। সর্বোপরি স্বীকৃতি ছিল যে, স্বাস্থ্য প্রতিটি মানুষের অধিকার এবং চিকিৎসা একটা অত্যাবশ্যক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, যার জন্য একটা মূল নীতি ও পরিকল্পনা থাকা জরুরি। আজকের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন অনেক বেশি সামাজিক আবেগ জাগিয়েছে (অনেকটাই তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস হত্যার অভিঘাতে), কিন্তু তুলনায় স্বাস্থ্যসংস্কার চিন্তার দিকটা মনে হচ্ছে সঙ্কীর্ণ।

Advertisement

সে দিন সরকারি হাসপাতালের দুর্দশা বুঝতে গিয়ে যে প্রশ্নগুলি উঠে এসেছিল সেগুলি এ রকম— সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ঝোঁক শহরের উপরেই কেন, গ্রাম কেন অবহেলিত। অনেক অসুখ তো আছে যাদের জন্য হাসপাতালে যাওয়ারই দরকার নেই, পাড়ার ডাক্তারবাবুই চিকিৎসা করতে পারেন। শেষোক্তরা অবশ্য তখনই অদৃশ্যপ্রায়। তবু প্রাথমিক স্তরে চিকিৎসার জন্য শহরে গ্রামে ছোট ছোট হাসপাতাল তৈরি করে, প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে ইতিমধ্যেই বিদ্যমান প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির মানবসম্পদ ও পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের প্রস্তাব উঠেছিল।

চিকিৎসার বেসরকারিকরণ তখনও রমরমিয়ে ওঠেনি। মাদ্রাজের অ্যাপোলো হাসপাতাল সদ্য কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে শেয়ারের টাকা তুলছিল। সরকারি হাসপাতালগুলির সঙ্গতির অপ্রতুলতার কথা ভেবে, তাদের কুশলতা বাড়াতে ও দুর্নীতি কমাতে কেউ প্রাইভেট সেক্টরকে উৎসাহিত করতে চেয়েছিলেন, কেউ বা ধনী ও দরিদ্রদের জন্য যথাক্রমে বেসরকারি ও সরকারি চিকিৎসার দ্বৈত ব্যবস্থা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন সমদর্শী মনোভাব থেকে। চিকিৎসাক্ষেত্রে ক্রমে প্রাইভেট সেক্টর তুলে দেওয়া যায় কি না এ ভাবনাও উঠে এসেছিল (আইসিএমআর-এর কোনও সাম্প্রতিক রিপোর্টে বোধ হয় তার ইঙ্গিত ছিল)। কারও প্রস্তাব ছিল দরিদ্রদের জন্য সরকারি ও ধনীদের জন্য বেসরকারি চিকিৎসার মাঝখানে সমবায়ভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমা চালু করার। রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্যসমবায় প্রচেষ্টার উদাহরণ দেওয়া হয়েছিল এই প্রসঙ্গে। চিনের দৃষ্টান্তও তুলে ধরা হয়েছিল (তখনও চিন সমাজতান্ত্রিক দেশ)। বিকল্প মডেল হিসাবে ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এর কথা উঠেছিল। মারোয়াড়ি রিলিফ সোসাইটি বা রহমতভাই-এর মতো দাতব্য কমিউনিটি হাসপাতাল তো বটেই, এমনকি হোমিয়োপ্যাথি ও ইউনানি হাসপাতালগুলিকেও কতটা কাজে লাগানো যায়, সে আলোচনাও হয়েছিল। তা ছাড়া কোথায় ক’টা বেড খালি, সেই তথ্য-সহ সেন্ট্রাল রেফারাল সিস্টেমের দাবি তো ছিলই।

আর এসেছিল রোগ নিরাময় আর নিরোধকের তুলনামূলক আলোচনা-সহ ‘প্রিভেন্টিভ মেজারস’ নিয়ে ভাবনা। সেই সূত্রে আবার জনস্বার্থ সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার কথা (জঞ্জাল পরিষ্কার, জলের দূষণ রোধ, সর্বোপরি জনশিক্ষার)। অল্প ট্রেনিং দিয়ে কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার্স তৈরি করা, বা জুনিয়র ডাক্তারদের গ্রামে পাঠানোর ব্যাপারে জোর করা উচিত কি না, সে সব নিয়ে তর্ক হয়েছিল। গ্রামের দুর্বল পরিকাঠামোয় সুশিক্ষিত অভিজ্ঞ ডাক্তারের দরকারই তো বেশি, এই ভাবনা ছিল তর্কের মূলে। আর জোর দেওয়া হয়েছিল রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে সমাজমানসের পরিবর্তনের উপর; যেমন নামকরা মেডিক্যাল কলেজের মোহ, প্রচুর খরচ করে চিকিৎসা করানোকে ‘স্টেটাস সিম্বল’ ভাবা।

আলোচনাটির সংক্ষিপ্ত ও সরলীকৃত উপস্থাপনা করলাম। কিন্তু বোঝাই যায়, নিছক সরকারের সমালোচনা নয়, অনেক গঠনমূলক ভাবনা ছিল সেই সময়ে। সে দিনের প্রসঙ্গগুলির মধ্যে শুধুমাত্র সেন্ট্রাল রেফারাল সিস্টেমের কথাই আজ উঠে আসছে। অথচ, বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টা আজও প্রাসঙ্গিক। আজকের গ্রামাঞ্চলের তথাকথিত সুপারস্পেশ্যালিটি এবং মাল্টিস্পেশ্যালিটি সব হাসপাতালকে উন্নত করার দাবি তো চিকিৎসকদের দশ দফা দাবির সঙ্গে যুক্ত হতে পারত, যাতে অনেক রোগীকেই শহরের দিকে আদৌ আসতে না হয়। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য, চল্লিশ বছর আগেকার সেই আলোচনা শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রসঙ্গে— বৈষম্য ও দারিদ্রের সমস্যার কথা এসেছিল অনিবার্য ভাবেই। আজ বোধ হয় সেটা অভাবনীয়। কিন্তু আমরা কি সত্যিই ভাবছি, কয়েক জন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে শাস্তি দিলে, কয়েকটি কমিটি পুনর্গঠন করলে আর ডাক্তারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?

আজ ব্যবসাদারদেরই যুগ, সরকারও তাঁদের প্রতি সদাশয়। দুনিয়ার ১% মানুষের হাতে ৫০% সম্পদ থাকা স্বাভাবিক বলেই জানি। মধ্যবিত্ত মাঝে মাঝে অসুবিধেয় পড়লেও এবং তার জন্য একটু ক্ষুব্ধ হলেও হাসিমুখেই মেনে নিয়েছে এই ব্যবস্থা। অন্য সব জায়গার মতো স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও বেসরকারি ব্যবস্থা উজ্জ্বলতম। আমাদের বোঝানো হয়েছে যে, ঝলমলে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মানের। তাই কোনও ক্রমে মেডিক্লেমটা করিয়ে রাখতে পারলে মধ্যবিত্ত মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকে। নেহাত গরিবদের জন্য ক্ষমাঘেন্না করে টিকে আছে সরকারি ব্যবস্থা। তবে বিশ্বজোড়া সীমাহীন লোভ-লালসার প্রভাব সেখানে পড়বে না, তা কি হয়! রোগীকে শোষণ করার নানা কৌশলে যখন বেসরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্র ফুলেফেঁপে উঠছে, সরকারি ডাক্তাররা সবাই না হলেও অনেকেই যে পিছিয়ে থাকতে চাইবেন না, সে তো জানা কথাই। তাঁরাও নানান বেআইনি উপায় অবলম্বন করে ধনসম্পদ বাড়িয়ে নিচ্ছেন। চল্লিশ বছরে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বেশ কিছু সদর্থক সংযোজন হয়েছে। যেমন শুনি, ওষুধের সরবরাহ ভাল। কিন্তু মোটের উপর সরকারি ব্যবস্থা নীতিগত ভাবেই অবহেলিত এবং প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। শুধু বাংলা বা ভারত নয়, অন্যত্রও মোটামুটি এই ছবি।

অথচ কিছু দিন আগে কোভিড অতিমারি সারা পৃথিবীতে বৈষম্যমূলক নিয়ো-লিবারাল স্বাস্থ্যপরিষেবার বীভৎসতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। যে দেশে জিডিপির যত কম স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ, সেখানে করোনার প্রকোপ পড়েছিল তত বেশি। এ ব্যাপারে ভারতকে টেক্কা দেওয়া মুশকিল ছিল— ১.২ শতাংশ। আসলে কোভিডের আগে থেকেই দেশ-বিদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত। কোভিডের সময়, নৈরাজ্য। বলা বাহুল্য, কোপটা সবচেয়ে বেশি পড়েছিল গরিবদের উপর। আমেরিকার এক মহামারি-বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন— যা হচ্ছে সেটা ‘জেনোসাইড বাই ডিফল্ট— মাস ডেথ বাই পাবলিক পলিসি’। অর্থাৎ, গরিবদের সচেতন ভাবে মারার নীতি। আমেরিকা-প্রবাসী ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “এক জন চিকিৎসক ও গবেষক হিসাবে আমি শঙ্কিত যে, স্বাভাবিকত্ব ফিরে এলে সেটা শিক্ষা নেওয়ার ব্যর্থতা বোঝাবে।” কারণ, স্বাভাবিকত্বটাই ছিল খুব অস্বাভাবিক। কিন্তু অতিমারির অবসানেও সেই অস্বাভাবিকত্ব রয়ে গেল। আমরা আজ আর তা নিয়ে ভাবিত নই। নব্য উদার অর্থনীতি এবং তজ্জাত সমাজমানস আমাদের বিকল্প চিন্তার ক্ষমতাকেড়ে নিয়েছে।

আজ সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা তাঁদের নিজেদের অব্যবহিত পরিবেশটাকে সুস্থ-স্বাভাবিক করার দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন— সে তাঁদের খুব ন্যায্য দাবি। আর তাঁদের প্রতীকী শিরদাঁড়া শুধু পুলিশ কমিশনার নয়, আমাদের অনেকেরই দরকার ছিল। কিন্তু সিনিয়র ডাক্তারবাবু বা অন্য বুদ্ধিজীবীরাও (অনেকে শুনি ‘বামপন্থী’) তো এই সুযোগে প্রশস্ততর স্বাস্থ্যচিন্তা ও ব্যাপকতর কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের পরিকল্পনা করলেন না। তরুণ চিকিৎসকদের উদ্ভাবিত প্রতীকী মগজটা গেল কোথায়!

কেউ বলতে পারেন, আগে দুর্নীতি সাফ হোক, তার পর অন্য সংস্কারের কথা ভাবা যাবে। মুশকিল হল, দুর্নীতি তো সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো থেকেই জাত। আর আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশ থেকেও— সেখানে আবার আসে আমাদের ‘মানসিক কাঠামো’র প্রশ্ন। বাস্তববাদী হতে গিয়ে আমরা যদি বাস্তবের কাঠামো পরিবর্তনের চিন্তা না করি, বাস্তবতর এবং শ্রেয়তর সমাজজীবনের স্বপ্ন না দেখি, কোনও ‘দ্রোহ’ই কি খুব সার্থক হতে পারে?

আরও পড়ুন
Advertisement