Bangladesh Unrest

সংখ্যালঘু শান্তি পাক

বাংলাদেশে যা চলছে তাকে কি গণহত্যার রিহার্সাল বলা যায় না? দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম নামে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি জে বাস-এর দুরন্ত একটি বই আছে।

Advertisement
সুবোধ সরকার
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:১৫

আপনি যে দিন ঢাকায় এসে নামলেন, বোধ হয় সে দিন থেকেই ‘বিপ্লব’ হয়ে উঠল মৌলবাদ, মৌলবাদ হয়ে উঠল হিন্দু নির্যাতন। আগুনে ঘি পড়ল। সেই ঘি-এর নাম ভারত-বিদ্বেষ।

Advertisement

বাংলাদেশে যা চলছে তাকে কি গণহত্যার রিহার্সাল বলা যায় না? দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম নামে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি জে বাস-এর দুরন্ত একটি বই আছে। সেখানে পড়েছি খানসেনারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেছে বেছে কিছু বাড়ির দেওয়ালে ‘এইচ’ লিখে যেত। এইচ ফর হিন্দু। তার পর নিধন পর্ব শুরু হত। এখনও আমার নিজের আত্মীয়রা পাবনায় থাকেন। গত ত্রিশ বছর মা দুর্গার মুখ দেখবে বলে আশ্বিন মাসে কলকাতায় আসেন, আশ্বিনেই বাড়ি ফিরে যান। কত বার বলেছি, থেকে যান। ‘কেন থাকব রে, নিজের মাটি কেন ছেড়ে আসব?’ দাদার উত্তর ছিল। এ বারের নিধন-নির্যাতন পর্বে কেমন আছেন তাঁরা?

একটা কলেজের ছেলেকে বাঁশ দিয়ে যখন অনেকে মিলে পেটায়, কারা কেন তা করছে, তার চেয়ে অনেক বড় কথা, প্রশাসনের কেউ কেন বাঁশগুলি কেড়ে নিতে পারে না। কে মারে এ ভাবে? মারে মৌলবাদ। মৌলবাদ কী? মৌলবাদ হল বাঁশ। এই ভাবে যদি মারতে হয় বাংলাদেশের বাঁশবনে আর বাঁশ থাকবে না, গণতন্ত্র হয়ে উঠবে বাঁশবন তন্ত্র। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, উন্মত্ত জনতাকে এই কথাটা বলতে হবে। প্রশ্ন হল, বলবে কে?

বলবে রাষ্ট্র। যে যে রাষ্ট্র বলতে পারেনি, সেই রাষ্ট্র দাঁড়াতে পারেনি। সাম্রাজ্য-উত্তর এই উপমহাদেশের ইতিহাসে নিজের ভাষার জন্য আপনারা যে ভাবে প্রাণ দিয়েছেন, কম স্থানেই তা ঘটেছে। শিলচরকে প্রণাম জানিয়েও বলব বাংলাদেশের জন্যেই আমরা মাতৃভাষা দিবস পেয়েছি, বাংলা ভাষা পৃথিবীতে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। আপনি যে দিন নোবেল পেয়েছিলেন— মুহাম্মদ ইউনূসের (ছবি) সূত্রে আমরা বাঙালিরা আর একটি নোবেল পেয়েছি বলে এ পারেও সমারোহে উদ্‌যাপন করেছিলাম।

মিলান কুন্দেরার উপন্যাসে আছে দুই কিংবদন্তি নেতা এ ওর টুপি পরে ছবি তুলল, ছবি ছাপা হল স্কুলের সব ক্লাসের পাঠ্যবইয়ে, দশ বছর বাদে এ ওর শত্রু হল, ক্ষমতায় থাকা বন্ধু রাষ্ট্রচ্যুত বন্ধুকে ছবি থেকে কেটে বাদ দিতে বলল। তাই হল। কিন্তু রাষ্ট্রচ্যুত বন্ধুর টুপি তার মাথায় থেকে গেল। ইতিহাস হল ওই টুপি। মানুষকে সরিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তার একশো গ্রাম ওজনের টুপি সরাতে যে ক্রেন লাগবে, সেই ক্রেন এখনও আবিষ্কার হয়নি।

আমার তরুণী মা যুবক বাবার হাত ধরে দৌড়তে শুরু করেছিলেন পাবনা জেলার শিতলাই গ্রাম থেকে। উঠোনে তুলসীচারা লাগানো নিয়ে উঠোনেই উঠে এসেছিল হাতা খুন্তি লাঠি শাবল। ‘হল্ট’ শব্দে বাবা মা দাঁড়িয়ে পড়লেন সীমান্তে। মা চটের ব্যাগ থেকে একটি তুলসীচারা বার করে প্রহরীকে বললেন, ‘বাবা তোমরা এ পারে তুলসী লাগাতে দেবে তো’? গত সপ্তাহে আমার এক মুসলিম কবিবন্ধু বললেন, ‘ভাগ্যিস তোমার মা দৌড়েছিলেন।’ আমরা এখন তাকিয়ে আছি ভারতের দিকে। মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী যা বলবেন, শুনে চলব। ডোনাল্ড ট্রাম্প কী বলবেন, সে দিকেও তাকিয়ে আছি। একেই বলে ইতিহাসের চৈত্রসেল, কতটা ডিসকাউন্ট পেলে হঠকারী ট্রাম্পের দিকেও আশা নিয়ে তাকাতে হয়।

একাত্তরে কবি রফিক আজ়াদরা হাতে রাইফেল তুলে নিয়ে সীমান্তে গিয়েছিলেন। সে দিন শত্রু ছিল বহিরাগত, আজ নিজের ঘর নিজের প্রশাসন, নিজের সরকার, নিজের পুলিশ, নিজেদের নেতারাই প্রতিপক্ষ। কবি ফরহাদ মজ়হার বললেন, ‘সন্ন্যাসীকে কেন গ্রেফতার করলেন? তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী মনে হয়নি আমার।’ ক্রান্তিকালে সেই এক কবিই উঠে দাঁড়ালেন, যে ভাবে অক্তাভিয়ো পাজ় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, অ্যালেন গিনসবার্গ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, নাজ়িম হিকমত উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।

গুলি খেয়ে গান্ধী লুটিয়ে পড়েছিলেন। মুজিবুর রহমান লুটিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীও মারা যাননি, মুজিবও নন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁরা হেঁটে চলেছেন আজও। গুলি করে মুজিবকে মারা যায়, মুজিবের স্বপ্নকে মারা যায় না। মুজিবের মাথায় উঠে গাঁইতি চালালে পাথর খসে পড়ে, মুজিব খসে পড়েন না। আমাদের গান্ধীও রইলেন, মুজিবও রইলেন। দফা এক দাবি এক, সংখ্যালঘু শান্তি পাক।

Advertisement
আরও পড়ুন