কত হাজার মরলে তবে...
AFSPA

যখন জবাব দেওয়ার দায় নেই, গণনিধনও অপরাধ নয়

‘ভুল করে’ও যাদের হাতে এতগুলো মানুষের প্রাণ চলে যায়, তাদের সুরক্ষায় আমরা, নাগরিকরা, কতটা নিশ্চিন্ত হতে পারি, সেটাই প্রশ্ন।

Advertisement
তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:৫৫
বিক্ষোভ: নাগাল্যান্ডে সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৩ জন নাগরিকের মৃত্যুর প্রতিবাদে মন জেলায় প্রতিবাদ মিছিল, ৫ ডিসেম্বর।

বিক্ষোভ: নাগাল্যান্ডে সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৩ জন নাগরিকের মৃত্যুর প্রতিবাদে মন জেলায় প্রতিবাদ মিছিল, ৫ ডিসেম্বর। পিটিআই।

আমরা দুঃখিত”, এটুকু বলে থেমে যাননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সঙ্গে যোগ করছেন একটি অমোঘ ‘কিন্তু’। “আমরা দুঃখিত, কিন্তু...।” এবং, এই একটা শব্দ চিরকাল যা করে, সেটাই করেছে— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যবহৃত প্রথম দু’টি শব্দ যে সম্পূর্ণ অবান্তর, অর্থহীন এবং নিতান্ত মৌখিক, সেটা প্রকট করে দিয়েছে।

নাগাল্যান্ডে সেনাবাহিনীর প্যারা স্পেশাল ফোর্সের নির্বিচার গুলিতে ১৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীর অসহায় মৃত্যু গোটা দেশের বিবেককে নাড়িয়ে দিলেও শাসকের কণ্ঠ অকম্পিত থাকবে— কোনও সর্বাধিপত্যকামী শাসকের কাছে সেটাই স্বাভাবিক। তাঁরা জানাবেন যে, এই ঘটনায় তাঁরা ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত, কিন্তু...। কিন্তু, নির্দেশ সত্ত্বেও গাড়ি না থামানোতেই তো নাগাল্যান্ডে ঘরমুখো শ্রমিকদের জঙ্গি ভেবে গুলি চালিয়েছিল কমান্ডোরা। এই মৃত্যুর দায় কি তাদের উপর বর্তাতে পারে? যদি না-ই বর্তায়, তা হলে রাষ্ট্রই বা দুঃখিত হবে কেন?

Advertisement

এমন ঘটনাকে শেষ অবধি তাই বলতে হয় গণহত্যা। এবং সেই হত্যা রাষ্ট্র অনুমোদিত, কারণ রাষ্ট্র এই সেনাবাহিনীকে সুরক্ষাকবচ দেয়, তার কুকর্মকে নির্দ্বিধ ভাষায় অন্যায় বলে না। তৈরি করে উপদ্রুত এলাকা আইন, কিংবা সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন বা আফস্পা। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর পায়ে বেড়ি পরানো দুরূহ কাজ। সেনাবাহিনী যে দেশবাসীর রক্ষক, তাকে হত্যা করা তার কাজ হতে পারে না— এই কথাটা তো রাষ্ট্রেরই তাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু তেমন ঘটে না। আগেও ঘটেনি। এ বারও ঘটল না।

তা হলে কি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও এক অর্থে ভরসা করে সামরিকীকরণে? গোটা সমাজে এই বার্তাই দিতে চায় যে, সেনাবাহিনী দেশরক্ষা করে বলে তাদের ‘ছোটখাটো ভুল’ মেনে নিতে হবে! জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ উঠলে আদালতও তাতে চটজলদি হস্তক্ষেপ করতে চায় না। নাগাল্যান্ডের মন জেলার ওটিংয়ে গুলিচালনার পরে সঙ্গত কারণেই আবার উঠে এসেছে আফস্পা রদের প্রসঙ্গ। কারণ, এই আইনে সেনাবাহিনীর হাতে এমনই অগাধ ক্ষমতা দেওয়া আছে যে, সেনাবাহিনী নিজে শাস্তি না চাইলে তাকে স্পর্শ করে, আইনেরও সেই সাধ্য নেই।

প্রশ্ন হল, যদৃচ্ছ ব্যবহার করেও নিস্তার পেয়ে যেতে অভ্যস্ত সেনা এই একচ্ছত্র আধিপত্য ছাড়বে কেন? কেনই বা উপদ্রুত এলাকা আইনকে ঢাল বানাবে না? সেনা বা আধা সেনা দেশের অভ্যন্তরে কাজ করতে এসে মনে করে, এ যেন সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রই। নাগরিক আর জঙ্গির মধ্যে পার্থক্যটা মাথায় রাখতে ভুলে যায়। যে কাজ আইনশৃঙ্খলা-রক্ষকদের দিয়েই করলে হয়, সেই কাজে সেনার দ্বারস্থ হতে হয়। মনে করা হয়, ‘উপদ্রুত’ এলাকায় অসামরিক শাসন তত কাজ করে না, গণতান্ত্রিক আবহ তো দূরের কথা— তা সে কাশ্মীরই হোক বা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল।

অতএব, এই সব জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর দায়বদ্ধতা বা দায়িত্ব লোপ পাওয়ার অভিযোগ ওঠে বার বার। থাংজাম মনোরমার কথা মনে পড়তে পারে। তাঁর বাড়ি ছিল মণিপুরে। ২০০৪-এর ১১ জুলাই অসম রাইফেলস-এর এক দল জওয়ান ওই তরুণীর বাড়ি গিয়ে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করে। পরে তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে মনোরমার ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। অভিযোগ ওঠে, তীব্র অত্যাচারের পর মনোরমাকে গণধর্ষণ করে গুলিতে তাঁর দেহ ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণের প্রমাণ লোপ করতে তাঁর গোপনাঙ্গে গুলি করা হয় বলেও অভিযোগ ওঠে।

এই ঘটনা সামনে আসতেই গোটা মণিপুর উত্তাল হয়ে ওঠে। এর পরেই ঘটে সেই ঐতিহাসিক ঘটনা! মনোরমা-কাণ্ডের প্রতিবাদে সে বছরের ১৫ জুলাই মণিপুরের কাংলা দুর্গের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে গর্জে ওঠেন সেখানকার জননীরা। কাংলা দুর্গের সামনে প্রতিবাদের কারণ, তা ছিল অসম রাইফেলসের সদর দফতর! দু’হাতে ফেস্টুন তুলে তাঁরা চিৎকার করতে থাকেন, ‘ভারতীয় সেনা, এসো, আমাদের ধর্ষণ করো।’ প্রতিবাদে সরব হয় গোটা দেশ।

কিন্তু তার পর কী হল? এক জন সেনারও কি শাস্তি হয়েছে? ওই ঘটনার পরে, ২০০৪-এর ১৯ নভেম্বর আফস্পা-র নানা দিক খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় সরকার পাঁচ সদস্যের এক কমিটি গঠন করে। এর নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জীবন রেড্ডি। ২০০৫-এর ৬ জুন রেড্ডি কমিটি তাদের রিপোর্ট সরকারকে জমা দেয়। জানা যায়, ওই কমিটি আফস্পা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এরই পাশাপাশি, বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনেও (ইউএপিএ) বেশ কয়েকটি সংশোধনীর প্রস্তাব দেয় ওই কমিটি। কিন্তু, জীবন রেড্ডি কমিটির সেই রিপোর্ট এত বছরেও সংসদে পেশ করেনি সরকার, তাদের সুপারিশ মানা তো দূরের কথা।

সেই সময়ে কেন্দ্রে ছিল ইউপিএ সরকার। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে মনমোহন সিংহ। উত্তাল মণিপুরে গিয়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন যে, আফস্পার প্রয়োজনীয় সংশোধনের পরে তাকে আরও মানবিক রূপ দেওয়া হবে। এমনকি, শান্তি ফিরলে এই আইন স্থায়ী ভাবে তুলে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিশ্রুতি দেওয়া এ দেশে বড় সহজ, তাকে রক্ষা করার দায় নেই যে!

মনোরমার হত্যাকাণ্ডের পরে মণিপুর সরকারের নির্দেশে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সি উপেন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে। কমিটিকে বলা হয় এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে। যদিও এই তদন্তে অসম রাইফেলস যথাযথ সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ করেছিলেন বিচারপতি সিংহ নিজেই। ২০০৪ সালের ২২ নভেম্বর ওই কমিটি তাদের রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু তাতে কী? সেই রিপোর্ট তো প্রকাশ্যেই আসেনি!

নাগাল্যান্ডের সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ির অন্য এক নমুনা মনে করানো যাক। মণিপুরে ভুয়ো সংঘর্ষের ১৫২৮টি ঘটনার উল্লেখ করে ২০১৬-তে সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হয় এক্সট্রা জুডিশিয়াল এগজ়িকিউশন ভিক্টিম ফ্যামিলিজ় অ্যাসোসিয়েশন, মণিপুর। এই সংগঠনের সদস্যদের পরিবারের কেউ না কেউ ভুয়ো সংঘর্ষের শিকার হয়েছিলেন। ওই সব ঘটনার তদন্তের জন্য ওই বছরের ৮ জুলাই কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর পরে ২০১৭-র ১৪ জুলাই সিবিআইয়ের পাঁচ অফিসারকে নিয়ে এক বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গড়ে দেয় সর্বোচ্চ আদালত। প্রাথমিক ভাবে ১৫২৮টির মধ্যে ৯৫টি ঘটনার তদন্ত করে চার্জশিট পেশ করার নির্দেশ দেয় কোর্ট। কিন্তু পরের বছরেই সরকার যে তালিকা কোর্টে পেশ করে, তাতে ৯৫টির বদলে ছিল ৪১টি ঘটনা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মদন বি লোকুর এবং বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতকে নিয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ জানতে চায়, গত কয়েক মাসে মোট ঘটনা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা কমে যায় কী করে? বিচারপতি লোকুরের একটি মন্তব্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, “আমরা নিছক আরও একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছি না। আমরা মৃত্যুর কথা বলছি, যা খুনও হতে পারে!”

আসল সমস্যা এখানেই! সেনার ভূমিকা নিয়ে রাষ্ট্রের ভাবনায়। সে কী চায় তা বোঝার জন্য গভীর গবেষণার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন কেবল তথ্যগুলি খেয়াল রেখে একটু তলিয়ে ভাবার। যে অটলবিহারী বাজপেয়ীর দর্শন ও অনুপ্রেরণার কথা বিজেপি এখন অহরহ বলে, সেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী সেনাবাহিনী সম্পর্কে কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, “সেনাকে সাংবিধানিক ভাবে অসামরিক কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ মানা প্রয়োজন। তাদের ভূমিকা রক্ষকের, শাসকের নয়।” ২০০১-এর ১৭ মার্চ দিল্লিতে ‘গণতন্ত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনাসভায় বাজপেয়ী ওই মন্তব্য করেছিলেন।

‘ভুল করে’ও যাদের হাতে এতগুলো মানুষের প্রাণ চলে যায়, তাদের সুরক্ষায় আমরা, নাগরিকরা, কতটা নিশ্চিন্ত হতে পারি, সেটাই প্রশ্ন।

আরও পড়ুন
Advertisement