Malnutrition

প্রকল্পে অধরা সুষম আহার, বহু কর্মী পদ শূন্য

শিশু অপুষ্ট, মা কি জানেন

Advertisement
অরিজিতা দত্ত
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৪৮

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের পতন নিয়ে ক’দিন ধরে দেশবাসী বিব্রত। এ বছরের রিপোর্ট অনুসারে, শিশুপুষ্টির নিরিখে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭— নেপাল (৮১), বাংলাদেশ (৮৪) এবং পাকিস্তানের (৯৯) চেয়েও পিছনে। এমনকি গত বছরের তুলনাতেও ভারত পিছিয়ে গিয়েছে কয়েক ধাপ। যবে থেকে এই সূচকের খবর প্রকাশিত হয়েছে, তবে থেকেই বিতর্ক বেধেছে, রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে সর্বস্তরে। কেন্দ্রীয় সরকার সূচকের পদ্ধতিগত ত্রুটির উল্লেখ করে রিপোর্টের উপর অনাস্থা দেখিয়েছে। অথচ, সরকারি তথ্য (জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা ৫) থেকে শিশু-অপুষ্টির যে ভয়ানক ছবি পাওয়া যায়, তাতেও হতাশা গাঢ় হয়ে আসে। সম্প্রতি এই পাতায় তা নিয়ে আলোচনা করেছেন অচিন চক্রবর্তী (‘গরিব, তাই উচ্চতা কম’, ২৮-১০)। এই ব্যাপক অপুষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের তাকাতে হবে ভারতের এত দিনের পরিকল্পনা আর নীতির কাঠামোর দিকে। কেন এত প্রকল্প, এত বরাদ্দ সত্ত্বেও এত অপুষ্টি?

শিশু অপুষ্টির কথা মাথায় রেখেই ১৯৭৫ সালে ‘ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভলপমেন্ট স্কিম’ বা আইসিডিএস প্রকল্পটি আনে ভারত সরকার, যা কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরনো এবং দীর্ঘমেয়াদি। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল, ০-৬ বছরের শিশুদের মধ্যাহ্নভোজনে একটি সুষম আহার দেওয়া, যাতে পুষ্টিতে ঘাটতি পূরণ হয়। নীতি অনুযায়ী, ওই বয়সের সব শিশুকে আনাজ, সয়াবিন-সহ খিচুড়ি আর ডিম দেওয়ার কথা। সারা দেশে প্রায় ১৪ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে এই খাবার দেওয়া হয় শিশুদের, গর্ভবতী আর স্তন্যদাত্রী মায়েদের। কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে এর খরচ বহন করে, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে কেন্দ্র ও রাজ্যের খরচের অনুপাত ৯০:১০, পশ্চিমবঙ্গ-সহ বেশ কিছু রাজ্যে ৫০:৫০। বাজেটের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৯-২০ সালে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ২০১৪-১৫’র বরাদ্দের প্রায় সমান থেকে গিয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর মূল্যবৃদ্ধির হিসাব ধরলে আসলে বরাদ্দ কমেছে। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই প্রথম দু’বছরে এই কার্যক্রমে বরাদ্দ প্রায় অর্ধেক করে দিয়েছিল, তার পর ধীরে ধীরে বাড়িয়ে ২০১৪-১৫ সালের সমান জায়গায় নিয়ে এসেছে। আবার ২০২০-২১’এ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বরাদ্দ। ফলে কোপ পড়েছে শিশুদের খাবারে। ডিম হারিয়ে যেতে বসেছে পাত থেকে। প্রতি শিশুর জন্যে বরাদ্দ খরচ হল ৬ টাকা, আর যারা খুব অপুষ্ট, তাদের জন্যে ৯ টাকা!

Advertisement

বিশেষজ্ঞরা এ দিকে বার বার বলেছেন, এ দেশে অপুষ্টির মূল কারণ একেবারে খেতে না পাওয়া নয়, সুষম খাবার না পাওয়া। শিশুদের প্রয়োজন প্রোটিন-যুক্ত এবং বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল-এর মতো ‘মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট’-যুক্ত খাবার। তাই চাল-ডালের খিচুড়ির চেয়ে বেশি দরকার ডিম বা সয়াবিনের মতো প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার, সঙ্গে আনাজপাতি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে সব শিশু অন্তত ৬ মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে তিন-চারটে করে ডিম খায়, তাদের অপুষ্টির হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। অথচ, সম্প্রতি অনেক রাজ্য ফতোয়া জারি করছে যে, শিশুদের খাবারের সঙ্গে ডিম দেওয়া হবে না। এদের লক্ষ্য, ভারতকে ‘শুদ্ধ শাকাহারী’ প্রমাণ করা। মধ্যপ্রদেশ অপুষ্টিতে প্রথম সারিতে, তা সত্ত্বেও ডিম বর্জনের ঘোষণা করা হয়েছে ২০২০ সালে। যদিও এটা সবার জানা যে, ডিমের মতো প্রোটিন-সমৃদ্ধ এবং (তুলনামূলক ভাবে) সস্তা খাবার আর নেই।

আইসিডিএস প্রকল্পের অধীনে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে দেওয়া হয় সারা দিনের মাত্র একটি খাবার; বাকি খাবার শিশুরা খায় বাড়িতেই। তাই শিশুর পুষ্টি এবং পরিচ্ছন্নতার দিকে লক্ষ রেখে ঠিক কী ভাবে খাওয়ানো উচিত, সেই সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন খুবই বেশি। সমীক্ষা করতে গিয়ে দেখেছি, শিশুদের মায়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জানেনই না যে, তাঁদের সন্তান অপুষ্টিতে ভুগছে, বা শিশুদের পুষ্টির জন্য কেমন খাবার দেওয়া উচিত। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর খাতায় প্রতি শিশুর উচ্চতা ও ওজন নথিবদ্ধ করা হয় ঠিকই, কিন্তু মা-ঠাকুমারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জানেন না, বাড়ির শিশুটির ওজন কম। তাকে সকালে, বিকেলে বা রাতে কেমন খাবার দেওয়া দরকার। তাই অনেক সময় টাকা খরচ করেও তাঁরা শিশুদের রাস্তার কচুরি-তরকারি দিতে পছন্দ করেন (সুস্বাদু বলে), বাড়িতে তৈরি হাতে-গড়া রুটি না দিয়ে। ২০১৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা যখন শিশুদের পুষ্টিগত অবস্থানের কথা মাসিক মিটিং-এ জানাচ্ছেন, তখন পুষ্টির অনেকটা উন্নতি হয়। অতএব শিশুর পুষ্টির সুরক্ষায় আরও বেশি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর প্রয়োজন। কার্যক্ষেত্রে বহু কর্মী ও সহায়কের পদ শূন্য।

শিশু, কিশোর-কিশোরীদের অপুষ্টি কমানোর আর একটি প্রকল্প হল স্কুলের মিড-ডে মিল। সেখানেও বরাদ্দ বেড়েছে যৎসামান্য, সুষম আহারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তাতে জুটবে না। ২০১৮ সালে ‘পোষণ অভিযান’ বলে নতুন প্রকল্প চালু হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল অপুষ্টি কমানোর সব কার্যক্রমকে এক সঙ্গে সংহত করা, এবং অনলাইনে পর্যবেক্ষণ। কিন্তু ২০২১ সালে দেখা গেল, এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হল বছরে মাত্র ৩৭০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে আসলে খরচ করা হয় মাত্র সাঁইত্রিশ শতাংশ। আবার, এই পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষকের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ নিয়োগ করা হয়, বাকি পদ সব খালি রেখে। ২০২১ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ অভিযান’-এর ছাতার তলায় মিড-ডে মিল প্রকল্পকে পুরোপুরি নিয়ে আসা হয়, এবং আরও অনেক পরিষেবা দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়। ২০২২-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে এই সুসংহত অভিযানের জন্য বরাদ্দ হয় ১০,২৩৩ কোটি টাকা। অথচ বাজেটের তথ্যে দেখা যায়, এই পুরো টাকাটাই দেওয়া হয়েছে স্কুলগুলিতে মিড-ডে মিল-এর বরাদ্দ হিসেবে! তা হলে নতুন, অতিরিক্ত পরিষেবা দেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল, তা কী ভাবে দেওয়া হবে? সেটা ধোঁয়াশাই রয়ে গেল! অর্থাৎ, নতুন মোড়কে নতুন প্রকল্প এলেও, কর্মক্ষমতা সেই সীমিতই রইল।

আমাদের দেশের সরকার খুব ভাল করেই জানে যে, ভারতে শিশুদের অপুষ্টির হার খুবই বেশি, সরকারি তথ্যই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দেয়। সরকারি সহায়তা ছাড়া, কেবল পরিবারগুলির পক্ষে সুষম আহার জুগিয়ে শিশুপুষ্টির লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়, তা-ও সরকার জানে। কিন্তু শিশুপুষ্টির দায় সরকার গ্রহণ করলেও, তা পালন করার সদিচ্ছা দেখতে পারেনি এখনও। নতুন আঙ্গিকে সুসংহত প্রকল্প আনার কথা ঘোষণা করেও বরাদ্দ ক্রমাগত কমিয়েছে, ফলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আর স্কুলের শিশুদের পাত থেকে ক্রমাগত উধাও হয়েছে সুষম খাদ্যের সমাহার। সচেতনতা বৃদ্ধি ও পর্যবেক্ষণের কথা বললেও, আসলে আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকা, সুপারভাইজ়ার-এর মতো ফ্রন্টলাইন কর্মীদের পদ ফাঁকা পড়ে থাকে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা সার্বিক ভাবেই খুব কম)। দিনের পর দিন ভারতও তাই নীচে নেমে যায় ক্ষুধা সূচকে, আর সেই রিপোর্ট আসার পরে দেশের নির্বাচিত সরকার ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাড়া করে। দেশব্যাপী অপুষ্টির দায়কে অস্বীকার করা যত সহজ, শিশুদের ওজন-উচ্চতা বাড়ানো ততটাই কঠিন।

অর্থনীতি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন
Advertisement