Indian Economy

এখন আমরা কেমন আছি

তবু একটা কথা স্বীকার করে নিতে হয় যে, দেশে সামগ্রিক ভাবে দারিদ্রের হার অনেকটাই কমে এসেছে। যদিও সরকারি হিসাব নিয়ে অনেক প্রশ্নই উঠতে পারে, কিন্তু বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ভারতে ১৬ শতাংশ মানুষ দরিদ্র।

Advertisement
সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:১০

মাথাপিছু আয়ের নিরিখে বিশ্বের ১৯৭টি দেশের মধ্যে ভারত ১৩৬তম। আমাদের মাথাপিছু আয় এখন ২৪৮৫ আমেরিকান ডলার। আয়ের তুলনা করার মান্য পদ্ধতি অবশ্য পারচেজ়িং পাওয়ার প্যারিটি (পিপিপি) বা ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে বিচার করা। আমেরিকায় এক ডলার ব্যয় করলে যে পণ্যসামগ্রী কেনা যায়, ভারতে সেই একই সামগ্রী কিনতে যত ডলার খরচ হয়, তা হল পিপিপি অনুসারে ভারতীয় টাকার বিনিময়মূল্য। আমেরিকার বাজারে এক ডলারে যে পণ্যসামগ্রী পাওয়া যায়, ভারতে তা কিনতে খরচ মোটামুটি ২০ টাকা বা ০.২৪ ডলার। সেই হিসাবে, পিপিপি অনুসারে ভারতে মাথাপিছু আয় ১০,১৭৫ ডলার। যদিও তাতেও আত্মশ্লাঘার কারণ নেই— এই মাপকাঠিতে ভারতের অবস্থান বিশ্বে ১২৫তম।

Advertisement

তবু একটা কথা স্বীকার করে নিতে হয় যে, দেশে সামগ্রিক ভাবে দারিদ্রের হার অনেকটাই কমে এসেছে। যদিও সরকারি হিসাব নিয়ে অনেক প্রশ্নই উঠতে পারে, কিন্তু বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ভারতে ১৬ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। সরকার বলছে ১৪ শতাংশের মতো। যাঁরা পুরোপুরি মেনে নিতে চাইছেন না, তাঁরা ২০ শতাংশের কাছাকাছি বলছেন। ২০২৩-এর নমুনা সমীক্ষার তথ্য অনুসারে বলা হচ্ছে যে, বর্তমান সরকারের শাসনকালে দারিদ্র বিশেষ ভাবে কমে এসেছে। সেটা অবশ্য বলা শক্ত। একটু হিসাব করলেই দেখা যাবে যে, সংস্কার-পরবর্তী ভারতে মোটামুটি ভাবে ২০০০ সালের পর থেকে বার্ষিক যে হারে দারিদ্রের পরিমাণ কমে আসছিল, ২০১৪ সালের পর সেই কমে আসার হার তেমন ভাবে পরিবর্তিত হয়নি। খানিকটা শ্লথ হয়েছে। নিশ্চয়ই কোভিড অতিমারির এ বিষয়ে খানিকটা ভূমিকা আছে।

১৯৯০ সাল থেকে ২০১৩ সাল, ভারতে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ১৪ শতাংশের মতো। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালে সেই বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশের মতো। দ্বিতীয় সময়কালটিতে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার তিন শতাংশ-বিন্দু কমে যাওয়ার পিছনে কোভিডের প্রকোপও একটি কারণ হতে পারে। তবে, রীতিমতো চড়া বৃদ্ধির হার হলেও ওই সময়ে বৈষম্যের হার যদি বেশ বৃদ্ধি পায়, তা হলে আসলে কত মানুষ এতে উপকৃত হলেন, আয়বৃদ্ধির হিসাব থেকে সে কথা বোঝা যাবে না। এ কথা অনস্বীকার্য যে, অতীতেই হোক বা বর্তমানে, ভারতে কোনও সময়েই একটানা চড়া মূল্যবৃদ্ধি ঘটেনি। এ দেশে কৃষিক্ষেত্রেও কোনও দিনই তেমন দুঃসময় আসেনি। যদিও প্রকৃতির উপরে কৃষির নির্ভরতা যথেষ্ট কমেনি।

যদি আমরা ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারী হিসাব বাদ দিয়ে সাদামাঠা মাথাপিছু আয়ের হিসাব দেখি, তা হলে দেখা যাবে যে, ১৯৯০-২০১৩ এই সময়ে বার্ষিক ১২ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি হয়েছিল, কিন্তু ২০১৪-২০২৩— এই ৯ বছরে সেই হার কমে হয়েছে ৬.৫ শতাংশ। তা হলে অন্তত এটা বোঝা যাচ্ছে, বিগত জমানায় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার আর ক্রয়ক্ষমতা অনুসারী মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হারে তেমন তফাত ছিল না, দুই শতাংশ-বিন্দুর মতো। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এই ফারাকটি প্রায় সাড়ে চার শতাংশ-বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে।

কোভিড অতিমারির মতো আরও একটি ঘটনা আমাদের এবং সারা পৃথিবীকে ব্যতিব্যস্ত করে চলেছে, তা হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার ফলে তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি। উচ্চবিত্ত পাশ্চাত্যে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির হার, বেকারত্ব, সামাজিক অবস্থা এ সব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমরা। কিন্তু সরকারের কূটনৈতিক মুনশিয়ানার কিছু সুফল, সঙ্গে প্রকৃতির আশীর্বাদ এ সব কারণে আমাদের মূল্যবৃদ্ধির হার কমই ছিল বলা যায়। আর সেটা হয়েছে বলে ক্রয়ক্ষমতার জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছি আমরা। আমরা জানি যে, অনেক দিন রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল পেয়েছি আমরা এবং এর জন্য আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সখ্য তেমন একটা কমেনি।

তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়— ক্রয়ক্ষমতা অনুসারী মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার ১৯৯০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত যা ছিল, তার চেয়ে এই সরকারের আমলে কম। যদি বহির্বিশ্বের তুলনায় আপেক্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার কম থাকায় কিছু বাড়তি সুবিধা সাম্প্রতিক কালে আমরা পেয়ে থাকি, যা আমরা গত দশ বছর আগের দশ বছরে পাইনি, তা হলে মাথাপিছু আয়ের বাড়তি বৃদ্ধি এই সময় বেশি হারে হল না কেন? কোভিড এক জন অপরাধী। কিন্তু এই ফারাকটি কেন হল সেটা অবশ্যই বিচার্য বিষয়।

ভারতের অর্থনীতি কেমন চলছে, সে প্রশ্ন উঠলেই শুনতে হয়: এখন যা হচ্ছে আগে কোনও দিন হয়নি। এখন ভাল চলছে বা তেমন খারাপ চলছে না— এই খবরে অনেকে সন্তুষ্ট থাকতে চান না। আমরা অনেক অনেক দিন আগে অসাধারণ ভাল ছিলাম— এই দাবিটিতে আমার আপত্তি আছে। এ কথাও খানিকটা বলা প্রয়োজন যে, সব অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান এক দিনে হয় না। ১৯৯০-এর অর্থনৈতিক সংস্কারের সময় জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার বৃদ্ধির উপর এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি আমদানির উপর জোর দেওয়া হয়েছিল। তার দীর্ঘকালীন কিছু ফল আমরা পেয়েছি। দারিদ্রের হার বেশ কমেছে। এখন বৈষম্যের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। মূল সমস্যা দুটো। এ দেশে বিনিয়োগের হার বড় কম, সরকারি বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই। আর বহির্বিশ্বের প্রযুক্তি উত্তরোত্তর শ্রমিককে ব্রাত্য করে তুলেছে। অনেক লোকের তেমন কাজ না থাকলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে কী করে?

আরও পড়ুন
Advertisement