রাশিয়ার হানায় পুড়ছে ইউক্রেন। ছবি রয়টার্স।
ইউক্রেনের উপরে রাশিয়ার আক্রমণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে রাশিয়ার সাফল্য আংশিক ভাবে হলেও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে তাকালে বোঝা যাচ্ছে, ২০২২ সালে ইউক্রেন যে সব ভূখণ্ড হারিয়েছিল (২০১৪-র কথা ভুলে যান), সেগুলি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাও ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কিভ-এ পাঠাতে থাকা সামরিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইউক্রেনের পক্ষে এক সামরিক অচলাবস্থা আশা করাই সব চেয়ে ইতিবাচক হবে। আর সব থেকে খারাপ অবস্থা হতে পারে যদি রাশিয়া আরও বেশি ভূখণ্ড নিজের দখলে নিয়ে আসে। ইউক্রেনের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন সে ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তার জন্য দরকার পড়বে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক সাহায্য, যা আদৌ পাওয়া যাবে কি যাবে না, তার কোনও স্থিরতা নেই।
এই সমরাভিযানের জন্য রাশিয়ার ব্যয়ের অঙ্কটি কেমন? মস্কোর উপর একের পর এক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক অবরোধের তরঙ্গ আছড়ে পড়েছে। এই অবরোধের ধাক্কায় রাশিয়ার অর্থনীতি দ্রুত দুমড়ে যাবে বলে আশা করেছিল পশ্চিমী দেশগুলি। কিন্তু তাদের সেই আশা সফল হয়নি। নিঃসন্দেহে রাশিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষতি সীমাহীন অবস্থার মধ্যে কখনওই চলে যায়নি। ২০২২-এ রুশ অর্থনীতিতে ২.১ শতাংশ পতন দেখা গিয়েছিল। ২০২৩-এ তা ২.৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত ত্রৈমাসিকে রাশিয়ার অর্থনীতিতে বৃদ্ধির পরিসংখ্যান ছিল ৫.৫ শতাংশ। বাণিজ্যিক অবরোধ সত্ত্বেও তাদের বাণিজ্য তহবিলে উদ্বৃত্ত অর্থের পরিমাণ বিপুল বলেই জানা গিয়েছে।
সামরিক খাতে দ্রুত এবং বিপুল ব্যয় বৃদ্ধি ২০২৪-এ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। যা সে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর ৬ শতাংশও হতে পারে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২.৮ শতাংশ। কিন্তু এই ধাক্কা সামলে ওঠা রাশিয়ার পক্ষে তেমন কঠিন হবে না। কারণ, সে দেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ অনেকটাই কম, জিডিপির মাত্র ২০ শতাংশ। বিপুল পরিমাণ কর্মনিযুক্তি, ব্যাপক হারে পরিযান এবং সরকারের তরফে সামরিক উৎপাদনে সুবিশাল ব্যয়ের কারণে সেখানে বেকারত্বের হারও মাত্র ২.৯ শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি ৭.৫ শতাংশ উচ্চতায় রয়েছে এবং সুদের হার রয়েছে ১২.৪ শতাংশে। এর পিছনে খানিকটা কাজ করছে রুবলের মূল্যমান রক্ষা করার প্রচেষ্টা। ২২ মাস আগে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় রুবলের মূল্য ২০ শতাংশ পড়ে গিয়েছিল। তাকে অনেকটাই সামলানো গিয়েছে। কিন্তু শেয়ার বাজারে তেজি ভাব এক বছর আগেও ৭ শতাংশ বাড়তির দিকেই ছিল।
যুদ্ধ শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো আরও ভালর দিকেই যেত, তা এই পরিসংখ্যানগুলি থেকে অনুমান করা যায়। যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতির একটি দিক আবার মানবিক মূল্যের দিক। কিন্তু ২০২২-এর ফেব্রুয়ারি মাসে যখন অবরোধ শুরু সময় পশ্চিমের ক্ষমতাশালী দেশগুলি যে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল (অবশ্যই তেমনটা তারা চায়নি), তা আদৌ ঘটেনি। তখন এমন কথাও বলা হয়েছিল যে, এক সময়ের ‘রুশ দুর্গ’ শীঘ্রই ‘রুশ খন্ডহর’-এ পরিণত হবে এবং তার অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। তার উপরে রটানো হয়েছিল ভ্লাদিমির পুতিন সাংঘাতিক রকমের অসুস্থ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পুতিন ও তাঁর দেশ বহাল তবিয়তেই রয়েছেন এবং যুদ্ধ অব্যাহতই থাকছে।
যদি হঠাৎ করেই অবরোধের স্রোতে ভাটির টান দেখা না দিত, তবে রাশিয়া চিন ও ভারতে তার খনিজ তেলের ক্রেতা খুঁজে বার করে অর্থনীতিকে সামাল দিতই। বিগত কয়েক মাসে পশ্চিমের দ্বারা নির্ধারিত ব্যারেল প্রতি ৬০ আমেরিকান ডলার দামের বাঁধন থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া বিষয়টিকে সামলে নিতে পেরেছে। পাশাপাশি, ভোগ্যপণ্যের দামে হঠাৎই একটা ঊর্ধ্বগামিতা তাদের রফতানি বাণিজ্যকে চাঙ্গা করে তোলে। আবার তুরস্ক, লিথুয়ানিয়া, মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ, ইরান ও চিনের মতো প্রতিবেশিদের মাধ্যমে আমদানিও বজায় থাকে। এমন ক্ষেত্রে কখনও কখনও বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ইউয়ানকেও ব্যাবহার করতে হয়েছে। এ ভাবেই মস্কোর অর্থনীতি টিকে থেকেছে, অন্যথায় সরবরাহ বন্ধ হয়ে বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে পরার সম্ভাবনা যথেষ্ট পরিমাণে ছিলই।
এ সব সত্ত্বেও কিন্তু মোটরগাড়ি নির্মাণশিল্পে লক্ষণীয় রকমের পতন কিছুতেই এড়ানো যায়নি। অন্যান্য সূক্ষ্মতর পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলি সিলিকন চিপের অভাবে ধুঁকতে থাকে এবং বহু পশ্চিমী সংস্থা রাশিয়ায় তাদের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়াতেও সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু সাধারণ জনগণ জানাচ্ছেন যে, তাঁরা অবরোধের ফলে তেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েননি। কারণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উপরে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। ফলে দেশের ভিতরে যুদ্ধের পক্ষ নিয়ে গলা ফাটানোর লোকের অভাব হয়নি।
কিন্তু এ বিষয়েও নিশ্চিত থাকা যায় যে, রাশিয়াকে দীর্ঘ মেয়াদে বেশ কঠিন মূল্যই দিতে হবে। রাশিয়াকে তার প্রাকৃতিক গ্যাস বিপণনের জন্য বিকল্প বাজার (যার একমাত্র ক্রেতা ছিল চিন। ফলত তারা তুমুল দরকষাকষি করে) খুঁজতে হয়েছে। পশ্চিমী প্রযুক্তির সহায়তা বন্ধ হওয়ায় কী ক্ষতি হল, তা সময়ে টের পাওয়া যাবে। দেশত্যাগের ফলে কর্মদক্ষ মানুষের অভাবও যথেষ্ট মাত্রায় দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ক্ষেত্রে কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ায় অর্থনীতি আরও বেশি করে সরকার-নির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দক্ষতার অভাব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে ইরানের উদাহরণ থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে। ইরান দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমী অবরোধের মধ্যে ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার অর্থনীতির বৃদ্ধিকে ৩ শতাংশের উপরে দীর্ঘকাল সে ধরে রাখতে পেরেছিল। উন্নয়নের কালে এমন গতি হয়তো খুব ভাল কিছু নয়। কিন্তু বৃদ্ধির এই হারই দেশটিকে তার অস্তিত্ব-সঙ্কটের সঙ্গে লড়তে সাহায্য করেছে।
ইউক্রেন নিজে থেকে রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই করার অবস্থায় কখনওই ছিল না। পশ্চিমী সমর্থন যদি আটকে দেওয়া হয়, তা হলে ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘাত হয়তো এড়ানো যাবে। সে দেশে ঘটে-চলা মৃত্যু আর ধ্বংসের দাপট হয়তো কমানো যাবে। এই সব সম্ভাবনার সঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে— ইউরোপের চৌহদ্দির আশপাশে কি পশ্চিমী শক্তিগুলি আদৌ যুদ্ধ করতে চায়? অবরোধের প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে দেখা যাবে যে, সেগুলিই কিন্তু রাশিয়াকে আঘাত করতে যথেষ্ট মাত্রায় সফল হয়েছে।