চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। —ফাইল চিত্র।
চিনের অর্থনীতির গতিতে শ্লথতা এবং ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল নিয়ে বিতর্কের মাঝখানেই একটি বিষয়ে খানিক চিন্তার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। আগামী বেশ কয়েক দশকে সৌর ও বাতাস-জাত শক্তি, বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, ব্যাটারি, নতুন গুরুত্ব পাওয়া বিভিন্ন পদার্থ ও পণ্য এবং সম্ভবত সেমি-কন্ডাক্টরের ব্যবসা সে দেশ কতখানি দখলে রাখতে পারে, সে সম্পর্কে উদাসীন থাকা অবশ্যই বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এই সম্ভাব্য আধিপত্যের সঙ্গে কী ভাবে মানিয়ে নেওয়া যায় বা তার সঙ্গে কেমন ব্যবহার রেখে চলা যায়, তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশই মাথা ঘামাচ্ছে। এ কথা বোঝা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, চিনের বর্তমান আধিপত্য কি ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার রেশমাত্র, না কি শিল্পোৎপাদনে ইতিমধ্যেই দখল-করা অবস্থানের প্রতিফলন। এ বিষয়ে যে দেশগুলি মাথা ঘামাচ্ছে, চিনের সঙ্গে অবস্থানের কৌশল নিয়ে ভাবছে, তাদের দূরদর্শিতাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, না কি পশ্চিম গোলার্ধের দেশগুলি তার বদলে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সব ক’টি অবস্থানকেই সঠিক বলে মনে হতে পারে। গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে শিল্পজগতে চিনের যে অভ্যুত্থান ঘটে গিয়েছে, বিশেষত খেলনা এবং পোশাকশিল্পে তারা যে সাফল্য পেয়েছে, তাকে অনুসরণ করার জন্য আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকেরা উপদেশ দিচ্ছেন। সার্বিক ভাবে দেখলে বোঝা যায়, গোটা বিশ্বের ঘুমই একটু দেরিতে ভেঙেছে। সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি-উদ্যোগপতি এবং তাঁদের প্রজন্মের লক্ষ কোটিপতিদের সাফল্য উদ্যাপনে আমেরিকা এক সময় বিভোর হয়ে থেকেছে, তখন চিন ছিল তাদের পণ্য সরবরাহের ভিত্তি। কিন্তু সেই কালপর্বে চিন প্রায় নিঃশব্দেই কিছু নতুন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে।
চিন এখন বিশ্বের অন্যত্র ব্যবহার্য বিদ্যুৎচালিত গাড়ি, সৌরশক্তি উৎপাদনের প্যানেল, বায়ুশক্তি উৎপাদনের টার্বাইন নির্মাণ এবং সেই সব যন্ত্রের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরির ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। হয়তো এখনই বাজারকে ভাসিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থানে আসতে তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু চিনা পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ কাজ হবে না। সেই প্রচেষ্টা সফল হতে বহু বছর লেগে যাবে। আর সেই অবকাশে বেজিং বাণিজ্য অবরোধ সংক্রান্ত হুমকি দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলবে। সম্প্রতি চিন গ্যালিয়াম এবং জার্মেনিয়াম সরবরাহের উপর তার নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে চিপ নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রে সিঁদুরে মেঘ দেখিয়ে রেখেছে।
এমন পরিস্থিতির জন্য পশ্চিমের তরফে নিজেকে দায়ী করা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় রয়েছে বলে মনে হয় না। বিংশ শতকের শেষ দিকে এবং একুশ শতকের গোড়ায় রুফটপ সোলার প্যানেল বসানোর কাজের ক্ষেত্রে জার্মানি চিনকে উৎসাহ দেয়। কারণ, সেই সময় যে করেই হোক দ্রুত চাহিদা মেটানো একান্ত ভাবে প্রয়োজন ছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশ জার্মানিকেই অনুসরণ করে। নিজের দিকে পাল্লা ভারী করতে চিন দ্রুত তৎপর হয়। নির্মাণব্যয় কম রেখে (রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির পরেও) চিন পশ্চিমের প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রায় হটিয়ে দেয়। পলিসিলিকন থেকে চুড়ান্ত পর্যায়ে সোলার প্যানেল নির্মাণের গোটা প্রক্রিয়ার উপরেই চিন তার আধিপত্য কায়েম করতে সমর্থ হয়েছে। বিশ্বের উইন্ড টার্বাইনের বাজারের ৬০ শতাংশ চিনই নিয়ন্ত্রণ করে। অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই)-এর বাজার তাদেরই দখলে। মনে রাখা দরকার, ভারতের ওষুধ প্রস্তুত শিল্প সব রকম ভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এপিআই বাজারের উপর।
ইতিমধ্যে চিনের গাড়ি নির্মাণ সংস্থাগুলি বিদ্যুৎচালিত গাড়ির বাজারের প্রসারণকে একদা ইন্টারন্যাল কম্বাশন ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির উত্তরাধিকারীদের জন্য ব্যবহার করে। বিদ্যুৎচালিত গাড়ির প্রাণভ্রমরা ব্যাটারি নির্মাণের ক্ষেত্রেও চিন এমন কিছু প্রযুক্তিগত সাফল্য লাভ করে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যাটারির দাম বিপুল পরিমাণে কমিয়ে আনে। চিনের গাড়িনির্মাণ সংস্থাগুলি কম দামি বিদ্যুতচালিত গাড়ি নির্মাণ শুরু করলেতার বিক্রি অবিশ্বাস্য রকম বেড়ে যায়। শাংহাইয়ের এক গিগাফ্যাক্টরিতে (যে কারখানায় বিদ্যুৎ সংক্রান্ত এবং কার্বন নির্গমন কমানোর যন্ত্রপাতি তৈরি হয়) বিনিয়োগ করতে টেসলাকে উৎসাহ দেওয়া হয়।
কৌশলগত দিক থেকে এই দূরদৃষ্টি (অন্যত্র এমন দেখা যায়নি) বিশেষ ভাবে শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ব্যবসার ক্ষেত্রে দেখা যায়। কঙ্গোর কোবাল্ট এবং বলিভিয়ার লিথিয়ামকে এক সূত্রে গাঁথার কাজে চিন অনেক আগে থেকেই উদ্যোগী হয়েছিল। যখন ইন্দোনেশিয়া অপরিশোধিত নিকেল রফতানি নিষিদ্ধ করে, চিনের পরিশোধনাগারের কর্তারা ঝাঁক বেঁধে সে দেশে প্রবেশ করতে শুরু করেন। চিন অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ইউরোপেও এমন সব জায়গায় কারখানা কেনে, যেখানে হয় প্রযুক্তিগত সুবিধা বিপুল, নয়তো সেই সব অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ তৈরি হয়।
চিন যে কাজটি করে দেখাতে পেরেছে, তা কি অন্য দেশগুলি পারত না? এ কথা অচিরেই শোনা যাবে যে, আমেরিকা এবং ইউরোপ (এমনকি, ভারতও) চিনের সাফল্য-কাহিনিকে নিজেদের দেশেও ঘটাতে চাইছে। এই উদ্দেশ্যে সরকারের তরফে ভর্তুকি এবং বিভিন্ন রকমের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, চিনের সাফল্য দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের কৌশলের উপর, ক্রমাগত চরিত্র পাল্টাতে-থাকা শিল্পক্ষেত্রগুলিতে তাদের নিরলস গবেষণার উপর, বিনামূল্যে জমি দেওয়ার মতো উদ্যোগ মারফত উৎপাদনব্যয় হ্রাসের উপর, রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট ঋণের উপর এবং সস্তায় সরবরাহকৃত বিদ্যুতের উপর। সেই সঙ্গে রয়েছে বিপুল পরিমাণ দূষণের বিষয়টিকে মানিয়ে নিয়ে চলার বিষয়, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবহার করে বাণিজ্য বাড়ানোর সদিচ্ছা, কাঁচামাল হাতে পাওয়ার জন্য কৌশল নির্ণয়ের দক্ষতা। বেজিংয়ের এই একগুঁয়ে মনোভাবই তার সাফল্যের কারণ। পশ্চিমের অধিকাংশ দেশ সামগ্রিক ভাবে বিষয়টিকে নকল করতে গিয়ে টের পেয়েছে যে, তাদের পক্ষে এই কাজ করে ওঠা সম্ভবই নয়।
এখনও পর্যন্ত পশ্চিমের দেশগুলি যা করে উঠতে পেরেছে, তা হল— উত্তর-রেগন/ থ্যাচার কালপর্বে বাজারে ‘করে খাওয়া’র দলগুলিকে বিদায় জানানো। এর ফলে অবশ্যই বাজারের কর্মকাণ্ড অবাধ হয়েছে। ২০১৪ সালে ভারতেও নরেন্দ্র মোদী ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট’ বা সরকারি হস্তক্ষেপ কমানোর নীতি ঘোষণা করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সরকারি বাণিজ্য কোনও ভাবে বাণিজ্য পদবাচ্যই ছিল না। কিন্তু তাঁর সরকার সার্বিক ভাবে এমন এক হস্তক্ষেপের নীতি নিয়েছে, যেখানে উৎপাদনে ইনসেন্টিভ, পুঁজিতে ভরতুকি, শুল্ক সংক্রান্ত সুরক্ষা (সোলার প্যানেলের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ) দেওয়া হবে। এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই দেশের ভবিষ্যতের সফল উদ্যোগপতিরা উঠে আসবেন। চিন যা করে উঠতে পেরেছে, তা সারা বিশ্বের সামনে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের এক অনন্য উদাহরণ। এই দৃষ্টান্তকে অন্য দেশগুলি কী উপায়ে রূপদান করবে, সেটাই এখন দেখার।