দীপেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথোপকথনে মৈনাক বিশ্বাস
Dipesh Chakrabarty Interview

মানুষই যেখানে সংখ্যালঘু

ব্যক্তি মানুষকে আমরা দেখি, সার্বিক মানুষকে দেখতে পাই না। অথচ তার অভিঘাত রীতিমতো টের পাচ্ছি দাবানল, সুনামি, জীববৈচিত্র ধ্বংসের অজস্র কাণ্ড থেকে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৪ ০৮:০৪

— ফাইল চিত্র।

প্রশ্ন: এত দিন যে ধারায় ইতিহাসচর্চা করে এসেছেন, শেষ দুটো বইতে তার থেকে একেবারে নতুন দিকে চলে গিয়েছেন আপনি। এর কারণ কী?

Advertisement

উত্তর: পৃথিবীর উষ্ণায়ন নিয়ে বিজ্ঞানীদের লেখা পড়তে শুরু করেছিলাম। তার থেকে চিন্তাভাবনার একটা পট-পরিবর্তন হয়েছে। আমি যে ইতিহাসচর্চায় শিক্ষিত হয়েছিলাম সেখানে মূল ভাবনা ছিল মানুষের অসাম্যের, দমন-পীড়নের, এবং তার থেকে মুক্তির প্রশ্নকে ঘিরে। পরিবেশের প্রশ্ন সেখানে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। এই প্রসঙ্গে বলি, কেউ যদি সাবঅলটার্ন স্টাডিজ়-এর প্রথম ছ’টা ভলিউম দেখেন, যেগুলো রণজিৎ গুহর সম্পাদনা করা, সেখানে পরিবেশ নিয়ে একটাই লেখা ছিল। মনুষ্য-কেন্দ্রিক ইতিহাস যে গ্রহটিতে বাস্তবায়িত হয় পৃথিবী নামক সেই গ্রহ আমাদের দৃষ্টিতে ছিল একটা প্রেক্ষাপট বা মঞ্চের মতো। বিজ্ঞানীদের যে কথাটা অন্য ভাবে ভাবাতে শুরু করল তা হল, মানুষ তার সংখ্যার কারণে, ভোগের কারণে, প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এক ভূতাত্ত্বিক শক্তি, ‘জিয়োলজিক্যাল এজেন্ট’-এ পরিণত হয়েছে। উল্কাপাতের ফলে যেমন ডাইনোসরেরা মারা গিয়েছিল এই গ্রহের উপর এখন মানুষের অভিঘাত সেই রকম। মানুষ ‘সার্বিক’ ভাবে এক প্রকাণ্ড বস্তুর মতো হয়ে উঠেছে। আমরা শিখেছিলাম, বস্তুর বা প্রকৃতির ইতিহাস থেকে মানুষের ইতিহাস আলাদা। এই ধারণাটা বিরাট ধাক্কা খেল। মানুষের এই নতুন ভূমিকার কথা স্বীকার করলে একটা স্তরে তো প্রকৃতির, বস্তুর আর মানুষের ইতিহাস এক হয়ে যায়। ২০০৩ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে ঘন ঘন যে সব প্রাকৃতিক বিপর্যয় হচ্ছিল, সে বিষয়ে যত পড়তে লাগলাম তত মনেহল শুধু পৃথিবীর জলবায়ু নয়, ইতিহাস নামক বিদ্যাচর্চার জলবায়ুরও পরিবর্তনের কথা ভাবা দরকার। এই ভাবনা থেকেই ক্লাইমেট অব হিস্ট্রি (২০২১) ও ওয়ান প্ল্যানেট, মেনি ওয়ার্ল্ডস (২০২৩) বই দু’টি লেখা।

প্রশ্ন: এক দার্শনিক নৃতত্ত্বের কথা বলছেন, মানুষকে কী ভাবে দেখব সেই কথা।

উত্তর: ব্যক্তি মানুষকে আমরা দেখি, সার্বিক মানুষকে দেখতে পাই না। অথচ তার অভিঘাত রীতিমতো টের পাচ্ছি দাবানল, সুনামি, জীববৈচিত্র ধ্বংসের অজস্র কাণ্ড থেকে। এই সবের পিছনে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন রয়েছে। একটু পিছিয়ে ভাবলে দেখব, আঠারশো শতক থেকে যে শিল্পসভ্যতা শুরু হল সে সময় থেকে মানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকল। আঠারশো শতকে ছিল কম-বেশি ত্রিশ বছর, বাড়তে বাড়তে সেই আয়ু এখন অনেক দেশে সত্তর-আশিতে পৌঁছে যাচ্ছে। মানুষের সংখ্যা ছিল ১৯০০ সালে ১.৬ বিলিয়ন, ২০০০ সালে ৬, আর এখন ৮ বিলিয়ন। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই দুটোই অতি দ্রুত বেড়ে উঠেছে। এবং যাবতীয় দুঃখ অসাম্য সব মেনে নিলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর তুলনায় মানুষ এখন ভাল আছে। আমাদের বাবা-মায়েদের অসংখ্য সন্তান হত তার একটা কারণ তাঁদের জানা ছিল এর মধ্যে অনেকে বাঁচবে না। আমি বা তুমি বাবা-মায়ের দুই সন্তান, কারণ মানুষ ডারউইনের থার্ড চ্যাপ্টার থেকে বেরিয়ে গেছে। এর পিছনে রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, জনস্বাস্থ্য বিধি, মেডিক্যাল ও অন্যান্য প্রযুক্তি। আমাদের দীর্ঘ জীবন, সুস্থ থাকা, আরামে থাকার সঙ্গে সঙ্গে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। ফসল, গবাদি পশু ইত্যাদি সব বাড়াতে হয়েছে। এই সব সাফল্যের শর্ত হিসাবেই মানুষ এক ভূতাত্ত্বিক শক্তি হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস বদলে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: এর ফলে অ্যানথ্রপসিন নামক নতুন যুগ শুরু হয়েছে বলে চতুর্দিকে বলা হচ্ছে। আপনি যে অ্যানথ্রপসিন কথাটা এখন আর ব্যবহার করতে চাইছেন না তার কারণ কী?

উত্তর: প্রথম দিকে শব্দটা ব্যবহার করতাম। তার পর দেখলাম ওটা এমন একটা তর্কের মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে যেটা বন্ধ্যা। যেমন, বামপন্থীরা বলতে শুরু করলেন অ্যানথ্রপসিন বললে মনে হয় সব মানুষই দায়ী। তা কেন হবে। মানুষের এই ভাল থাকার সিংহভাগ তো উপভোগ করেছে ধনী দেশেরা, ধনী শ্রেণিরা। তাই একে ক্যাপিটালোসিন বলা যাক, বা ইকনোসিন। আমার বক্তব্য হচ্ছে, এ কথা যদি সত্যিও হয়, তা হলে এও সত্যি যে, ধনী মানুষের সংখ্যাও গত ছয়-সাত দশকে অনেক বেড়েছে। এখন এত সংখ্যক মানুষ এতটা খাচ্ছে, বাড়ি তৈরি করছে, ভ্রমণ করছে, এত এনার্জি ব্যবহার করছে যা আগে কখনও হয়নি। এবং ফসিল জ্বালানি ব্যবহারের সঙ্গে এটা সম্পর্কিত। এই ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতিতেই তো বেশির ভাগ দেশের রাজনীতি চলছে। তা হলে এক জন হিউম্যানিটিজ়-এর লোক হিসাবে আমার কাছে এই সমস্যাটা উভয়সঙ্কটের, যাকে ‘প্রেডিকামেন্ট’ বলে। যারা একে পুঁজিবাদ বা পাশ্চাত্যের কৃতকর্ম বলে মনে করে তারা একটা নৈতিক ইতিহাস তৈরি করেছে। কিন্তু আমাদের ভাল থাকা, স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার ঐতিহাসিক শর্ত যদি হয়ে থাকে ফসিল জ্বালানি ব্যবহার করা, তবে মানুষের মধ্যেকার অনেক বৈষম্য স্বীকার করেও মানুষ সম্বন্ধে একবচনে কথা বলা যায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হানা আরেন্ট-এর বই দ্য হিউম্যান কন্ডিশন (১৯৫৮)। উনি তো বহুবচনে ‘হিউম্যান কন্ডিশনস’ বলেননি। অথচ উনি মানুষের মধ্যেকার পার্থক্যের এক জন বড় তাত্ত্বিক, মানুষ যে এক নয়, বহু, তা উনি বিলক্ষণ জানতেন। স্পুটনিক যখন মহাকাশে গেল উনি বলছেন এটা একটা সম্ভাবনার সূত্রপাত। চাইলে মানুষ এই গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহে গিয়ে থাকতে পারে। সব মানুষই এক সঙ্গে যেতে পারবে না, কিন্তু বড় সময়কাল ধরে ভাবলে ‘এক’ আর ‘বহু’ মানুষকে এক সঙ্গে ভাবা যায়। অ্যানথ্রপসিন যদি এমন একটা যুগ হয়, যেখানে মানুষ নিজের ভাল থাকার ও সংখ্যাবৃদ্ধির উপায় বার করে ফেলেছে তা হলে এও স্বীকার করতে হয় যে, সেই উপায়ের দ্বারা আমরা সবাই কম-বেশি উপকৃত। গরিব মানুষের পর্যন্ত গড়আয়ু বেড়েছে। আজ কনজ়িউমার বা উপভোক্তার মোট সংখ্যা ধরলে তার বেশির ভাগ পশ্চিমের বাইরে পড়বে।

প্রশ্ন: চিন আর ভারতের পরিসংখ্যান দিয়েছেন। জনসংখ্যা শুধু নয়, এদের মধ্যবিত্ত উপভোক্তার সংখ্যা ১৯৮০-র দশক থেকে বিপুল বৃদ্ধি পেয়েছে।

উত্তর: হ্যাঁ। তাই বৈষম্য, দারিদ্র সব মেনে নিয়েও বলা যায় এই অবস্থাটা সব মানুষের উভয়সঙ্কট। কান্ট বলছেন, যখন গভীর কোনও সমস্যা আসে তখন সার্বিক প্রশ্নটা হবে: মানুষ (এখন) কী। সেখানেই দার্শনিক নৃতত্ত্বের কথা আসে। আমার কাছে মানুষের প্রেডিকামেন্ট শুধু একটা নৈতিক গল্প নয়। এমন নয় যে পুঁজিবাদীরা হচ্ছে সমস্যা, আর আমরা সমাধান। এই সমস্যা সার্বিক সমস্যা। সবাই এক রকম দায়ী নয়, কিন্তু ভাল থাকা বা উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষায় সবাই শামিল। উন্নত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে রাজনীতির কাজ তার জন্য তো আয়ু বাড়ানো, খাওয়াদাওয়া বাড়ানোর প্রযুক্তি চাই। অতএব হানা আরেন্ট যাকে ‘হিউম্যান কন্ডিশন’ বলেছেন সেটা বদলে যাচ্ছে।

প্রশ্ন: দুটো বইতেই ‘গ্লোব’ আর ‘প্ল্যানেট’, এই দুয়ের পার্থক্য টেনে ‘মানুষ আজ কী’ সেই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে বলছেন।

উত্তর: গ্লোব আর প্ল্যানেটের ফারাক করে মানুষের নতুন দশা কী করে বোঝা যায় তার একটা উদাহরণ দিই দার্শনিক হ্বিটগেনস্টাইন থেকে। উনি বলছেন, একটা বাড়ি দেখলে আমরা জিজ্ঞেস করি এর বয়স কত, কিন্তু একটা পাহাড় দেখলে সে প্রশ্ন করি না কেন? এর কারণ পাহাড় নদ নদী সময়ের যে ব্যাপ্তিতে টিকে থাকে তার সঙ্গে মানুষের জীবনকালের তুলনা হয় না। কিন্তু আজ বলা যায়, হিমালয় পাহাড়ের তুলনায় যে মানুষের জীবনকে মাপা হয়ে এসেছে সেই মানুষ আর তত সামান্য নেই। সে এখন এমন এক শক্তি যে হিমালয়কে হত্যা করতে পারে, এবং তাই করছে। আমার মনে হয়েছে মানুষের ইতিহাসকে দুটো পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে হবে। একটা সাম্রাজ্য, ধনতন্ত্র, বৈষম্য, প্রযুক্তির ইতিহাস— সেটাকে আমি গ্লোবের ইতিহাস বলছি। এটা মানুষের তৈরি। গ্লোবের কাহিনি মানুষকে কেন্দ্র করে বলতে হবে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যে অর্থে রহস্য করে ‘গ্লোবায়ন’ বলেছিলেন। এ ঠিক রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্ব’ নয়, তাই ইংরেজি শব্দটাই রাখা যাক। অন্য পরিপ্রেক্ষিতকে প্ল্যানেটারি বা গ্রহজাগতিক বলছি, যেখানে মানুষ যে একটা ভূতাত্ত্বিক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাকে মাথায় রাখা হয়। সেখানে কোনও বিশেষ ধরনের প্রাণ থাকার শর্ত নানা ধরনের প্রাণ থাকা, জীববৈচিত্র। এটাকে বুঝতে গেলে জিয়োলজিক্যাল ইতিহাস, বায়োলজিক্যাল ইতিহাস বুঝতে হবে। লক্ষ লক্ষ বছরের একটা ইতিহাস আমার শরীরের মধ্যে বসে আছে, যে ইতিহাসের কেন্দ্র আমি নই। তা না হলে আমার জন্য ওষুধ তৈরি করে সেটা অন্য প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা যেত না।

— ফাইল চিত্র।

প্রশ্ন: গ্রহজাগতিক প্রেক্ষিত থেকে লেখা ইতিহাস মানুষের আর প্রকৃতির ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য করে না। একে বলছেন ‘ডিপ হিস্ট্রি’। আধুনিক চিন্তার উন্মেষে যে ব্যক্তি মানুষকে কল্পনা করা হয়েছিল এই ইতিহাস তাকে কেন্দ্র করেআবর্তিত নয়।

উত্তর: এক সময় আমি ভুল করে ভাবতাম গ্রহজাগতিক প্রেক্ষিত থেকে মানুষকে কেন্দ্রচ্যুত করে দেখাটা স্কেলের দিক থেকে বিরাট মাপের। এখন বুঝতে পারি, বড় মাত্রা আছে, আবার ছোট ব্যক্তিগত মাত্রাও রয়েছে। ওজ়োন স্তরে ছিদ্র হয়ে যাওয়া বিরাট মাত্রার বাস্তবতা। কিন্তু এখন যে বলা হয়, সুন্দরবনের মেয়েরা যে জলে নেমে কাজ করছেন তার চরিত্র বদলে যাওয়ায় তাঁদের জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটাও গ্রহজাগতিক, কিন্তু ছোট স্কেলের, একেবারে ব্যক্তিগত। মানুষের ভাল খেয়ে-পরে থাকার মধ্যে তো আপত্তির কিছু নেই, কিন্তু যে ডালে বসে আছি সেটাকেই যদি কাটতে থাকি তা হলে ওই উভয়সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হয়। এখানে কি কোনও ‘কালেকটিভ উইসডম’-এর কথা ভাবা যায়?

প্রশ্ন: সেই সহমতের প্রসঙ্গেই কি আপনি চিন্তায় প্রাক্-রাজনৈতিক পরিসরের কথা বলছেন?

উত্তর: ওটা দার্শনিক কার্ল য়াসপার্স-এর থেকে নেওয়া। উনি পরমাণু যুদ্ধ সঙ্কটের কথা মাথায় রেখে বলছিলেন যে, শুরুতেই যদি রাজনৈতিক ভাবে ভাবি তা হলে আমরা ভাগ হয়ে যাব। রাজনীতি বহুত্বের উপর দাঁড়িয়ে, শুধু যুক্তি দিয়ে সেখানে ঐকমত্য তৈরি হয় না। ঐকমত্য সেখানে কাম্যও নয়। কিন্তু উনি বলছেন আমরা কি মনে মনে সাক্ষ্য-প্রমাণগুলো যুক্তি দিয়ে বিচার করতে পারি? তার পরে যে যা রাজনীতিই করুক, ওই সাক্ষ্য-প্রমাণ মাথায় রেখে সেটা করবে। সেই অর্থে এই ঐকমত্যের পরিসর প্রাক্-রাজনৈতিক, কিন্তু রাজনীতি-বিরোধী নয়।

প্রশ্ন: এখন যাদের লেখাপত্র খুব দেখা যায় সেই নিউ মেটিরিয়ালিস্ট বা নব্য বস্তুবাদীদের কথা আপনার বইতে এসেছে। দ্বিতীয় বইতে এঁদের পূর্বসূরি হিসাবে এসেছে জে বি এস হ্যালডেনের মতো চিন্তকের কথা, যাঁরা এক সময় ইতিহাসবিদদের সঙ্গে তর্ক করে বলেছিলেন, শুধু মানুষ নয়, বস্তুজগতেরও ইতিহাস রয়েছে। এখন যাঁরা লিখছেন তাঁরা দর্শনের দিক থেকে মানুষ আর জীবজগৎ শুধু নয়, জীব আর জড়ের মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে পার্থক্য করেন না। এই জন্যই কি আপনি এঁদের সঙ্গে অনেকটা একমত হয়েও আলাদা থাকতে চান?

উত্তর: আমি মানুষের রাজনৈতিক উদ্যোগে বিশ্বাস করি। নিউ মেটিরিয়ালিস্টরা পৃথিবী সম্বন্ধে যেটা বলছেন, সেটা পৃথিবী কী ভাবে কাজ করে তার বিস্তৃত বিবরণ। আগে ভাবা হত, জীব আছে, আর তার বাইরে রয়েছে তার পরিবেশ। এখন বোঝা যাচ্ছে এই ভিতর-বাহির ফারাক মেনে প্রকৃতি কাজ করে না। আমার শরীরের ভিতরেই যেমন বাস করে লক্ষ কোটি জীবাণু। নিউ মেটিরিয়ালিস্টরা মনে করে জীব বা জড়জগৎ বিষয়ে আমরা যা জানি সেই সব কিছু রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমার আপত্তি এই যে, আমার মনে হয় মানুষের একটা ফেনমেনলজি রয়েছে। আমাদের পারসেপশনের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আমরা বুদ্ধি দিয়ে অনেক কিছু বুঝি যা অনেক সময় অনুভবে বা ইন্দ্রিয়ের কাছে ধরা দেয় না। ধরো, প্রেমে পড়লে লোকে যা যা করে বা বলে তার পরিধিটা খুব ছোট। সবাই একই কথা বলে, একই চিঠি লেখে। কিন্তু ফেনমেনলজি বলবে, প্রথম যে প্রেমে পড়ছে তার কাছে সেটা আশ্চর্য নতুন একটা ব্যাপার। এর কারণ প্রত্যেক মানুষ নতুন করে অনুভব করে। এই ফেনোমেনোলজিক্যাল অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ, এবং রাজনীতি একে বাদ দিয়ে হয় না। ব্রুনো লাতুররা অনেক সময় যেটা করেন তাতে সব সমান হয়ে যায়, পাখি আর মানুষের অভিজ্ঞতা এক রকম বলে মনে হয়। তাই এদের সঙ্গে আমার কিছুটা তফাত আছে।

আমি মানুষের উভয়সঙ্কটকে তার সমস্ত মাত্রায় এবং গভীরতায় বুঝতে চাই, কারণ আমি হিউম্যানিটিজ়-এর লোক। শুধু এক রকমের ‘উভয়’ নয়, নানা স্তরে নানা রকম দোটানার মধ্যে পড়েছে মানুষ। মস্ত প্যাঁচে পড়েছে। আমার কাছে সেটা গভীর ভাবে চিন্তা করবার বিষয়। আমার বইগুলো অ্যাক্টিভিস্ট বা বিজ্ঞানী বা ধর্মপ্রচারকের বই নয়। আমি বলতে চাইছি, এই সঙ্কটে পড়েছি বলেই আজ আরও ভাল ভাবে বোঝা যাচ্ছে আমরা কী। আমরা কী, সে সম্পর্কে আমরা নিজেরাই অনেক গল্প বলেছি, যেমন, আমরা ভগবানের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, বা প্রকৃতির নতুন কর্তা। অন্য ভাবে দেখলে দেখবে মানুষ প্রাণী-জগতে এক সংখ্যালঘু প্রাণী, যে আজ পৃথিবীতে জাঁকিয়ে বসে অন্য অনেক প্রাণীর নাভিশ্বাস তুলেছে। এতে আখেরে মানুষের বিপদ।

প্রশ্ন: এই সঙ্কট থেকে বেরোবার নানা পথ নানা লোক সময় সময় বাতলে দেন।

উত্তর: কেউ বলেন ‘উইথড্র’ করতে, কেউ বলেন ‘ডিগ্রোথ’। কেউ বিপর্যয়ের নিদান দেন। যাঁরা দুর্যোগের মধ্যে সমাধান খোঁজেন, প্রকৃতির প্রতিশোধ কামনা করেন, তাঁরা ভুলে যান যে এই প্রতিশোধের প্রথম আঘাতটা আসবে গরিব মানুষের উপরে। কোনও গরিব-বিরোধী চিন্তাকে আমি সমর্থন করি না।

(কলকাতা, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement