এক সময় যন্ত্র ছিল বিশাল। দৈত্যের মতো লাগত তাকে। জাপানে গিয়ে যন্ত্রসভ্যতার এই রূপ দেখে আঁতকে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “...এ তো লোহার জাপান... চীনেরা যেরকম বিরাট মূর্তির ড্রাগন আঁকে— সেইরকম। আঁকা বাঁকা বিপুল দেহ দিয়ে সে যেন সবুজ পৃথিবীকে খেয়ে ফেলছে... লোহার হাত দিয়ে মুখে তুলছে, লোহার দাঁত দিয়ে চিবচ্ছে, ... লোহার শিরা উপশিরার ভিতর দিয়ে তার জগত জোড়া কলেবরের সর্বত্র সোনার রক্ত স্রোত চালান করে দিচ্ছে।” প্রথম জাহাজ দেখে স্বর্ণকুমারীর মনেও গেঁথে গিয়েছিল তার দৈত্যাকার চেহারা।
কিন্তু ডাইনোসরের মতো প্রথম যুগের ভারী চেহারার যন্ত্রগুলোও টিকল না। বিশেষত, বিনোদন আর তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ার, ঘরোয়া গ্যাজেট আর দূর যোগাযোগের যন্ত্রগুলিতে এসে গেল ছোট, হালকা আর ট্রেন্ডি হওয়ার ঢেউ। ‘স্মল ইজ় বিউটিফুল’, এই আপ্তবাক্যটি গণহিস্টিরিয়ায় পরিণত হল। প্রযুক্তির জগৎ থেকে সমাজ, সংসার, সৌন্দর্যদুনিয়া— সর্বত্রই ছোটর জয়জয়কার। সাইজ় জ়িরো হওয়ার হিড়িক।
ইলেকট্রনিক্স একটা ছোট্ট চিপের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড ঢুকিয়ে ফেলেছে। বিপ্লব এনেছে ন্যানোটেকনোলজি। ‘টেন টু দ্য পাওয়ার মাইনাস নাইন’! সে কত ছোট ভেবে তল মেলে না। বালক রবি যেমন ভেবেছিল, সিঁড়ি আরও সিঁড়ি আরও সিঁড়ি। ছোট হতে পারলে নাকি পদার্থের আশ্চর্য সব গুণপনা দেখা যায়।
১৯৪৭-এ আমেরিকান গোলন্দাজ বাহিনীর লক্ষ্যভেদের সময়কে আরও নিখুঁত করতে তৈরি হয় এনিয়াক। এনিয়াক থাকত প্রকাণ্ড ঘরজুড়ে। একে সচল রাখতে ছ’হাজার মোটা তারের এক জটিল বিন্যাস তৈরি করতে হত। ভ্যাকুয়াম টিউব ভর্তি গাড়ি নিয়ে তৈরি থাকত আর্টিলারির সৈন্যরা। তাপ আর আলোর বিচ্ছুরণে আকৃষ্ট হয়ে শয়ে শয়ে মথ ঢুকে পড়ত যন্ত্রের মধ্যে, ফলে ঘন ঘন শর্ট সার্কিটে পুড়ে যেত ভ্যাকুয়াম টিউব। সেই মথদের মনে রেখেই আজ কম্পিউটারের ভাইরাসের নাম ‘বাগস’।
সেই জবড়জং এনিয়াক থেকে আজকের ল্যাপটপ, পামটপ। ধীরে ধীরে হালকা, ছোট ও বহনযোগ্য হয়েছে কম্পিউটার। যন্ত্রের চেহারার বদল দেখে বিশেষজ্ঞরা যন্ত্রের লিঙ্গও নির্ণয় করেছেন। গোবদা, কৌণিক আকারের ভারী যন্ত্র মানেই পুরুষালি, আর হালকা পাতলা ছিমছাম যন্ত্র হলেই তা নারী। এই ফর্মুলায় ভারী চেহারার ডেস্ক কম্পিউটার ও বক্স টিভি ছেলে। হালকা ল্যাপটপ, আধুনিক দেওয়াল জোড়া ফ্ল্যাট টিভি মেয়ে। আগেকার কালো গোবদা হেডমাস্টার-সুলভ ল্যান্ডফোন পুরুষালি, আর হালের স্লিক স্মার্টফোন মেয়েলি। সব বৈদ্যুতিন পণ্যেই রঙের ছোঁয়া, করে তোলা হচ্ছে দেখনদার।
কম্পিউটারের ছোট চেহারার পিছনে মুখ্য ভূমিকা ট্রানজ়িস্টরের। ১৯৫৮ সালে প্রথম ট্রানজ়িস্টর নিয়ে তৈরি হল ইউনিভ্যাক কম্পিউটার। ১৯৬৫ সালে শুরু হয় ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসির স্বর্ণযুগ। ৫ বর্গমিলিমিটারের সিলিকন চিপের মধ্যে ভরে ফেলা হল হাজার হাজার ইলেকট্রনিক সার্কিট, ফলে এল দু’টি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিপুল তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা, অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তথ্য বিশ্লেষণ ক্ষমতা।
১৯৭১-এ এল লার্জ স্কেল ইন্টিগ্রেটেড চিপ। পরের বছরেই ঘটে গেল যুগান্তকারী ঘটনা— মাইক্রোপ্রসেসর আবিষ্কার হল। খুদে সিলিকনের পাতে জায়গা হল ২২৫০টি ট্রানজ়িস্টরের।
অধুনা গতির হারে এই প্রযুক্তি অন্য সব প্রযুক্তিকে পিছনে ফেলেছে। বিল গেটসের কথায়, কম্পিউটারের মতো গতিতে মোটরশিল্প যদি এগিয়ে যেত, তবে আজ নতুন গাড়ি কিনতে খরচ হত মাত্র ২৫ ডলার! ১৯৬৫-তে গর্ডন মুর বিবৃত মুর’স ল অনুযায়ী, একটি নির্দিষ্ট আকারের কম্পিউটারের চিপে ট্রানজ়িস্টরের সংখ্যা প্রতি ১৮ মাসে দ্বিগুণ হবে, ফলে কর্মক্ষমতাও একই হারে বাড়বে। তাই আকারে ছোট যন্ত্রের কার্যক্ষমতা হয় অবিশ্বাস্য দ্রুত।
কিন্তু সব কিছুর তো সীমা আছে একটা। মুর’স ল-র মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছে কি? ট্রানজ়িস্টরের আকার আরও ছোট করতে গেলে তা কি অলাভজনক হয়ে যাবে? অর্থাৎ খরচে পোষাবে তো?
বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট কিন্তু বলছে, এখনও মুর’স ল বাতিল হচ্ছে না। সেমিকনডাক্টর সংস্থাগুলো ট্রানজ়িস্টরের ঘনত্ব বাড়াতে চিপের মধ্যে শুধু পাশাপাশি নয়, একটার উপর আর একটা করে ট্রানজ়িস্টর সাজায়। ভার্টিক্যাল স্কেলিং, ন্যানোওয়্যার, আরও কত নতুন পথ তৈরি হচ্ছে।
বদল ঘটেছে অন্য জায়গায়। যন্ত্র ছোট আর হালকা হওয়ায়, ইতিহাসে এই প্রথম মেয়েরা এত বেশি কোনও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। ভবিষ্যতের প্রযুক্তি যে শ্রমনির্ভর নয়, মেধানির্ভর, তা আমরা টের পাচ্ছি। ‘পুরুষালি’ কায়িক বলের সঙ্গে, নারীর ধী, মেধা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “একদিন যে জয়ী হবে তার আকার ছোট, তার কর্ম প্রণালী সহজ, মানুষের হৃদয়কে, সৌন্দর্যবোধকে, ধর্মবুদ্ধিকে সে মানে, সে নম্র, সে সুশ্রী, সে কদর্য ভাবে লুব্ধ নয়; তার প্রতিষ্ঠা অন্তরের সুব্যবস্থায়, বাইরের আয়তনে না।” আর এখানেই মেয়েদের সুবিধে। এই প্রথম যন্ত্র সত্যি তাঁদের হাতের মুঠোয় চলে আসছে।