উচ্চবর্ণ হিন্দুর প্রবল আধিপত্য আজও টিকে রয়েছে এই রাজ্যে
Caste

জাতিগণনাই কি সমাধান

পশ্চিমবঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে ওবিসি-র উপস্থিতি এত কম কেন? যাঁরা বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস কিছুটা জানেন, তাঁদের কাছে এর উত্তর খুব সহজ।

Advertisement
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২৪ ০৮:৪৬

—ফাইল চিত্র।

সম্প্রতি নির্বাচনের হট্টগোলে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খবর সবার নজর থেকে সরে গেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সেটি শীঘ্রই আবার চর্চায় ফিরে আসবে। কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের সাম্প্রতিক একটি রায়ের ফলে এই রাজ্যে ওবিসি সংরক্ষণ ১৭ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নেমে গেছে। সেই সঙ্গে ওবিসি তালিকাভুক্ত জাতি ১৮০ থেকে এক ধাক্কায় কমে দাঁড়িয়েছে ৬৬। তার মধ্যে মুসলিম ওবিসি জাতির সংখ্যা ১২২ থেকে নেমে হয়েছে ১২। মহামান্য বিচারপতিরা বলেছেন, বর্তমানে যাঁরা এই সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করছেন, তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে রাজ্যের শিক্ষা ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এই রায়ের প্রভাব কী হতে পারে, সহজেই অনুমান করা যায়।

Advertisement

বিষয়টা কী? ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ যখন মণ্ডল কমিশন রিপোর্টের ভিত্তিতে ‘অন্যান্য অনুন্নত শ্রেণি’ (আদার ব্যাকওয়র্ড ক্লাসেস বা ওবিসি)-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ ঘোষণা করলেন, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার তা নিয়ে খুবই নিরুৎসাহ ছিল। কিন্তু অচিরেই দেখা গেল, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানে নতুন ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সুযোগ থেকে এই রাজ্যের প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ১৯৯৩ সালে তাই আইন করে কমিশন ফর ব্যাকওয়র্ড ক্লাসেস গঠন করে পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি তালিকা তৈরি করা শুরু হল। পরবর্তী ষোলো বছরে মোট ৬৬টি অনুন্নত জাতি তালিকাভুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন কারুজীবী জাতি, যেমন সূত্রধর, কর্মকার, কুম্ভকার, স্বর্ণকার, তেলি, নাপিত, গোয়ালা, ময়রা, কাঁসারি, তাঁতি ইত্যাদি। আরও ছিল পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের কুর্মি। ছিল একাধিক নেপালি-ভাষী জাতি। আরও ছিল জোলা, কসাই, শেরশাবাদিয়া, হাজাম ইত্যাদি বারোটি মুসলিম জাতি এবং তফসিলি জাতি থেকে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান।

এই ওবিসি জাতিগুলির সামগ্রিক জনসংখ্যা হিসাব করা কঠিন। কারণ, স্বাধীনতার পর যত জনগণনা হয়েছে, তাতে তফসিলি জাতি ও জনজাতি ছাড়া আর কোনও জাতিগত গণনা হয়নি। ওবিসি জাতির হিসাব আজও হয়ে চলেছে ১৯৩১ সালের জনগণনা অনুসারে। গত নয় দশকে বিস্তর ধর্মীয়-সামাজিক-অর্থনৈতিক ওঠাপড়ায় সে-সব সংখ্যা যে এ-দিক ও-দিক হয়ে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তার উপর আছে দেশভাগের ফলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর। ফলে এ রাজ্যে মোট ওবিসি জনসংখ্যা জানতে হলে আন্দাজের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। সাচার কমিটির হিসাব অনুযায়ী ২০০৪-০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ওবিসি ছিল মোট জনসংখ্যার ৮.৪ শতাংশ, মুসলিম ওবিসি ২.৪ শতাংশ। বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়, ওই সময় সামগ্রিক ভাবে ভারতে ওবিসি-র সংখ্যা ছিল ৪৩ শতাংশ। দেশের অন্যান্য বড় রাজ্যে ওবিসি-র অনুপাত ছিল অন্ধ্রে ৫০, উত্তরপ্রদেশে ৫১, কেরলে ৫৬, বিহারে ৬০ ও তামিলনাড়ুতে ৭২ শতাংশ।

পশ্চিমবঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে ওবিসি-র উপস্থিতি এত কম কেন? যাঁরা বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস কিছুটা জানেন, তাঁদের কাছে এর উত্তর খুব সহজ। ভারতের অন্যত্র যে-সব সংখ্যায় ভারী কৃষক জাতি দেখা যায়, বাংলায় তার সমগোত্রীয় ছিল মুসলিম কৃষক। দেশভাগের সময় তার একটা বড় অংশ ছিল পূর্ববঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মাহিষ্য, সদ্গোপ, গোয়ালা বা তেলি ছাড়া অন্যান্য হিন্দু কৃষিজীবী জাতি ছিল ছড়ানো-ছেটানো এবং জনসংখ্যায় অল্প। বাকি জেলায় প্রধান কৃষক জাতি হল মুসলিম যার একটা বড় অংশ অন্য রাজ্যের ওবিসি শ্রেণির সমগোত্রীয়। কিন্তু ১৯৯৩-এর পর এই রাজ্যে যে বারোটি মুসলিম জাতি ওবিসি তালিকাভুক্ত হয়, তার জনসংখ্যা ছিল মোট মুসলিম জনসংখ্যার সামান্য অংশ।

২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক, আর্থিক ও শিক্ষাগত অবস্থা নিয়ে রাজিন্দর সাচার কমিটির রিপোর্ট। কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োজিত এই কমিটির সমীক্ষায় দেখা যায়, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, দারিদ্র, প্রতিটি ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের অবস্থা বেশির ভাগ রাজ্যের তুলনায় অনেক খারাপ। এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ২০১০ সালে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেন, রাজ্যের ওবিসি সংরক্ষণ ৭ থেকে বাড়িয়ে ১৭ শতাংশ করা হবে। ১৯৯৩ সালের আইনের কিছু রদবদল করে পরবর্তী কয়েক মাসে রাজ্যের ওবিসি তালিকায় ৪২টি জাতির নাম যোগ করা হয়। তাদের মধ্যে ৪১টি মুসলিম জাতি, যার মধ্যে আছে সর্দার, নিকারি, মিদ্দে, লস্কর, দর্জি, রাজমিস্ত্রি ইত্যাদি। সেই সঙ্গে ওবিসি তালিকাকে অতি অনুন্নত (এ) ও অনুন্নত (বি), এই দু’টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। ২০১২ সালে তৃণমূল সরকার ফের আইনের কিছু সংশোধন করে এবং শেখ, সর্দার, তরফদার ইত্যাদি ৩৫টি মুসলিম জাতিকে তালিকাভুক্ত করে। এর ফলে রাজ্যের মুসলিম জনসংখ্যার আনুমানিক ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ মানুষ ওবিসি সংরক্ষণের সুযোগ পেতে শুরু করলেন।

২০১০ সালের তালিকাবৃদ্ধি এবং মুসলিম সংরক্ষণ নিয়ে পরের বছর থেকে একাধিক রিট পিটিশন জমা পড়তে থাকে কলকাতা হাই কোর্টে। সে-সব মামলার নিষ্পত্তি করে ২২১ পৃষ্ঠার রায়ে গত ২২ মে বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী ও রাজাশেখর মান্থা ২০১০-এর ওবিসি তালিকাবৃদ্ধি আর তৎপরবর্তী ওবিসি আইন সংশোধন, ওবিসি তালিকা দ্বিখণ্ডিত করা এবং তাতে আরও জাতির নাম সংযোজনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি সংরক্ষণ এখন ২০০৯-এর অবস্থায় ফিরে গেল।
বিচারপতিরা যে এই সিদ্ধান্ত নিলেন, তার প্রধান কারণ, ১) ২০১০-এর তালিকাবৃদ্ধি প্রশাসনিক অর্ডার মারফত করা হয়েছিল, নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়নি, ২) তালিকা দ্বিখণ্ডিত করার ব্যাপারে ব্যাকওয়র্ড ক্লাসেস কমিশনের পরামর্শ নেওয়া হয়নি, এবং ৩) তালিকায় সংযোজন নিয়ে সুপারিশ করার আগে কমিশন যথেষ্ট তথ্যনির্ভর সমীক্ষা করেনি। বিচারপতিদের মতে, প্রতিষ্ঠিত আইন অনুযায়ী কমিশনের সুপারিশ ছাড়া এবং বিধানসভাকে পাশ কাটিয়ে রাজ্য সরকার ওবিসি তালিকায় পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। যে প্রক্রিয়ায় আইনের সামান্য অদলবদল করে ২০১০ সালে ৪২টি জাতি তালিকাভুক্ত করা হয় এবং তালিকায় দু’টি ভাগ করা হয়, তা ছিল ‘সাংবিধানিক জালিয়াতি’।

প্রশ্ন উঠতে পারে, পদ্ধতিগত ত্রুটি দেখিয়ে ওবিসি সংরক্ষণ বাতিল করা কি লঘু পাপে গুরু দণ্ড হল না? বিচারপতিরা যুক্তি দিয়েছেন কেন সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি একান্ত আবশ্যক। লিবারাল দার্শনিক জন রলস-কে উদ্ধৃত করে তাঁরা বলেছেন, ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে হলে সর্বাগ্রে দেখতে হবে ন্যায়পদ্ধতি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকছে কি না। অন্তিম ফল ভাল হল কি মন্দ হল, তা গৌণ। রলস-এর এই মত কিন্তু যথেষ্ট বিতর্কিত। অনেক পণ্ডিত, যাঁদের মধ্যে অমর্ত্য সেন অন্যতম, মনে করেন, ন্যায়বিচারের বাস্তব ফল মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হল কি না, তা পদ্ধতির তুলনায় সমান তো বটেই, এমনকি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক লিবারাল দর্শনের এই অসম্পূর্ণ উল্লেখ রায়ের আদর্শগত ভিত তৈরি করতে পারল কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

কিন্তু শুধু আদর্শগত নয়, ২০১০ সালের ওবিসি তালিকায় সংযোজনের তথ্যগত খামতির কথাও বিচারপতিরা বিশদ ভাবে আলোচনা করেছেন। সে সময় ব্যাকওয়র্ড ক্লাসেস কমিশন ৪১টি মুসলিম জাতির ক্ষেত্রে যে সুপারিশ করেছিল, ডিভিশন বেঞ্চের মতে তার তথ্যগত সমীক্ষা ছিল অসম্পূর্ণ এবং অবৈজ্ঞানিক। দীর্ঘ তালিকায় প্রতিটি জাতি সম্বন্ধে মন্তব্য করে তাঁরা বলেছেন, কতগুলি পরিবার সমীক্ষা করা হয়েছে তা বলা হলেও বহু ক্ষেত্রে জাতির মোট জনসংখ্যা জানানো হয়নি, হলেও মাত্র পাঁচ-সাত শতাংশ সমীক্ষা করা হয়েছে। প্রকৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হলে তাঁদের মতে প্রতিটি জাতির মোট জনসংখ্যাকেই সমীক্ষা করা উচিত ছিল। আদালতের মর্যাদাকে সম্মান জানিয়েও এই মন্তব্য সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা গুরুতর প্রশ্ন তুলতে পারেন। প্রথম কথা, রাশিবিজ্ঞান অনুযায়ী যথার্থ নমুনা বাছাই করতে পারলে পাঁচ শতাংশ কেন, তার চেয়ে ঢের ছোট স্যাম্পলেই যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য ফল পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, হিন্দু ওবিসি জাতির ক্ষেত্রে ১৯৩১-এর জনগণনার হিসাব ব্যবহার করা গেলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনও জাতিগত গণনা কখনও করা হয়নি। মুসলিম ওবিসির মোট জনসংখ্যা জানা যাবে কোথা থেকে? তাদের প্রত্যেককে শনাক্তই বা করা হবে কী ভাবে? তার জন্য গোটা পশ্চিমবঙ্গে সম্পূর্ণ জাতিগণনা করাতে হয়।

এই মামলার শুনানির সময় পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ওবিসিদের সামাজিক পশ্চাৎপদতা বোঝাতে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সাচার কমিটির নথিবদ্ধ তথ্য পেশ করা হয়। সেই প্রসঙ্গে বিচারপতিরা বলেছেন, সাচার কমিটির রিপোর্ট বেরিয়েছিল ২০০৬ সালে। ২০১০-এর মধ্যে তা পুরনো হয়ে গিয়েছিল, তাই তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেখানে নব্বই বছরের পুরনো জনগণনা ভিত্তি করে তামাম ভারতে ওবিসি সংরক্ষণ পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে চার বছরে সরকারি কমিটির সমীক্ষার তথ্য তামাদি হয়ে গেল কী ভাবে, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিক নয় কি?

বিচারপতিদের মূল সিদ্ধান্ত, কমিশন আসলে কোনও সমীক্ষা করায়নি, সবটাই লোকদেখানো। সামাজিক অনুন্নতি নয়, শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতেই ৪১টি মুসলিম জাতিকে ওবিসি তালিকায় ঢোকানো হয়, যা অসাংবিধানিক। মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ‘বিদ্যুৎগতিতে মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যে’ কমিশনের সুপারিশ আদায় করে বিশেষ ভোটব্যাঙ্ককে তুষ্ট করা হয়েছে। বিচারপতিরা বলেছেন, ‘রাজনৈতিক স্বার্থে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি পণ্যসামগ্রীতে পরিণত করা হয়েছে’। এখানেও প্রশ্ন ওঠে, আদর্শগত ও তথ্যগত ত্রুটির জন্য ৪১টি মুসলিম জাতিকে ওবিসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ ঘোষিত হল, তার আগের তালিকার ৬৬টি প্রধানত হিন্দু জাতিদের ক্ষেত্রে সেই একই ত্রুটি ছিল কি না, তা অনুসন্ধান করে দেখা দরকার ছিল না কি?

দীর্ঘ দিন ধরে লক্ষ করা গেছে, জাতিগত সংরক্ষণের ব্যাপারে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন বিরোধিতা প্রকাশ করে থাকলেও, কোনও নির্বাচিত সরকার কখনও কোনও সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে বাতিল করেনি। সংরক্ষণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি উঠেছে আদালতের বিচারপতিদের দিক থেকে। তার ফলে, আদালতের নির্দেশে সামগ্রিক সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা ৫০ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, ওবিসি জাতিদের মধ্যে ‘সর-মাখন স্তর’ বা ক্রিমি লেয়ার শনাক্ত করে তাদের সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দিতে বলা হয়েছে, নিয়ম হয়েছে যে চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ প্রযোজ্য নয়। মুসলিম ওবিসি সংরক্ষণের ব্যাপারে দেশের অধিকাংশ আদালতের বিচারপতিরা পদ্ধতির দিকটা পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিয়ে দেখেছেন। প্রসঙ্গত, তফসিল-বহির্ভূত অর্থাৎ উন্নত জাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ‘আর্থিক ভাবে দুর্বল অংশ’ (ইডব্লিউএস)-এর জন্য সম্প্রতি যে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন পেয়ে গেছে।

নানা ওজর-আপত্তি সত্ত্বেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মুসলিম জাতিরা ওবিসি তালিকাভুক্ত হয়ে সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। অন্ধ্রপ্রদেশের উদাহরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ২০০৪ সালে চন্দ্রবাবু নায়ডুর সরকার আইন পাশ করিয়ে কেবল মুসলিম ওবিসি জাতির জন্য স্বতন্ত্র ৫ শতাংশ সংরক্ষণ করে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আনা মামলাতে অন্ধ্রপ্রদেশ হাই কোর্ট সেই আইন বাতিল করে দেয়, কারণ সরকার ব্যাকওয়র্ড ক্লাসেস কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ করেনি। কিন্তু আদালত এ কথাও বলে যে, স্বতন্ত্র মুসলিম সংরক্ষণ ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী নয়, অতএব সংবিধানবিরোধী নয়। পরের বছর ওয়াই এস রাজশেখর রেড্ডি সরকার আবার সেই আইন পাশ করালে হাই কোর্ট আবার তা বাতিল করে। এ বারের কারণ, যথোপযুক্ত সমীক্ষা করা হয়নি। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থিতাবস্থা বজায় রাখার অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়ায় অন্ধ্র আর তেলঙ্গানাতে মুসলিম ওবিসি-র স্বতন্ত্র সংরক্ষণ এখনও চালু আছে। সুপ্রিম কোর্টের শুনানি আজও হয়নি। সম্প্রতি নির্বাচন জেতার পর চন্দ্রবাবু নায়ডু বলেছেন, তেলুগু দেশম দল এনডিএ সরকারে যোগ দিলেও অন্ধ্রের মুসলিম সংরক্ষণে কোনও বদল হবে না।

মনে হতে পারে, হাই কোর্টের আপত্তির কথা মাথায় রেখে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি এ বার ব্যাকওয়র্ড ক্লাসেস কমিশনকে দিয়ে নতুন করে সমীক্ষা করিয়ে নতুন আইন পাশ করায়, তা হলে রাজ্যের মুসলিম ওবিসি-র সংরক্ষণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু তা হবে কি? পদ্ধতিগত ত্রুটি যে আবার পাওয়া যাবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? সমীক্ষা ঠিক হয়নি, আর্থ-সামাজিক অনুন্নতি প্রমাণিত হয়নি, শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আসল উদ্দেশ্য ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি— এই সব যুক্তি দেশের নানা আদালতে শোনা গেছে।

ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে এই সব ওজর-আপত্তি নিরসনের জন্য সারা দেশে সম্পূর্ণ জাতিগণনা এবং আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার দাবি করা হয়ে আসছে। সে জন্য ২০১১-র জনগণনার সময় একটি সমান্তরাল আর্থ-সামাজিক জাতিগণনা করা হয়, যার রিপোর্ট ২০১৪ সালে নতুন বিজেপি সরকারের কাছে জমা পড়ে। কিন্তু সেই গণনা ত্রুটিপূর্ণ, এই কারণে বা অজুহাতে তা আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। ইতিমধ্যে ২০২৩ সালে বিহার সরকার সেই রাজ্যে জাতিগণনা করায়। তাতে দেখা যায় রাজ্যের জনসংখ্যার ৬৩ শতাংশ ওবিসি, ১৯.৬ শতাংশ তফসিলি জাতি, ১.৬ শতাংশ তফসিলি জনজাতি ও বাদবাকি অসংরক্ষিত জাতি ১৫.৫ শতাংশ। ১৯৩১-এর গণনার তুলনায় উচ্চজাতির অনুপাত যে বিশেষ ভাবে কমেছে এবং অনুন্নত জাতির অনুপাত অনেকটাই বেড়েছে, তা স্পষ্ট। সাধারণ জনগণনাতেই দেখা গেছে, বেশ কয়েক দশক ধরে অপেক্ষাকৃত উচ্চবিত্ত অংশের জন্মহার দ্রুত নীচে নামছে, নিম্নবিত্তের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে তা কিছুটা নামলেও ততটা নামেনি। সুতরাং জাতিগণনার নাম শুনলে উচ্চবর্ণের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। পশ্চিমবঙ্গে তো তা আরও প্রবল হওয়ার সম্ভাবনা। এ রাজ্যের সরকারি ও পেশাদারি কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চবর্ণ হিন্দুর যে আধিপত্য আজও টিকে রয়েছে, ভারতের অন্যত্র তা কল্পনা করা সম্ভব নয়। সেই আধিপত্য যে কত ক্ষুদ্র জনসংখ্যার উপর দাঁড়িয়ে আছে, জাতিগণনা হলে তা প্রমাণ হয়ে যাবে। তাই পশ্চিমবঙ্গে যে জাতিগণনা হবে, এমন সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

অথচ তা না হলে আদালতের আপত্তির কোনও নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ইতিমধ্যে আর ক’দিনের মধ্যে স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি শুরু হবে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ না পাওয়া গেলে সেই ভর্তি নিয়ে আইনি জটিলতা, মামলা-মকদ্দমার হয়তো শেষ থাকবে না। হাই কোর্টের ন্যায়বিচারের বাস্তব পরিণাম এ ক্ষেত্রে কী দাঁড়াল, তা নিয়ে অতএব অনেক প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement