বঙ্গাব্দে জড়িয়ে আছেন আকবর এবং মহম্মদ
Mughal Empire

যুক্তসাধনার নববর্ষ

ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে। রাষ্ট্রযন্ত্র যাঁদের হাতে, ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে তাঁদের রাজনৈতিক মতামত ও অভিসন্ধির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে।

Advertisement
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৭
A Photograph of  Mughal Empire

সমন্বয়: আকবরের দরবারে ইউরোপ থেকে সমাগত জেসুইট অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত।

দেশের স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের বই থেকে মোগল যুগের ইতিবৃত্ত বহুলাংশে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাটি আগেই রচিত হয়েছিল, এ-বার বুলডোজ়ার নামানো হল। কেবল কেন্দ্রীয় স্তরে নয়, রাজ্য স্তরেও অভিযান প্রসারিত হচ্ছে এবং হবে। যোগী আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশ ঝটিকা ব্রিগেডের তৎপরতায় সেই প্রক্রিয়ায় শামিল হয়েছে। ২০২৪ যত কাছে আসবে, এমন আরও অনেক কিছুই ঘটবে। শাসকরা আট ঘাট বেঁধে হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের সর্বাত্মক প্রকল্প চালাচ্ছেন, চালাবেন। এনসিইআরটি ইত্যাদিরা নিমিত্তমাত্র, তাদের মন্ত্র: যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি। ইতিহাস এই সংখ্যাগুরুবাদী প্রকল্পের স্বাভাবিক এবং অবধারিত নিশানা।

ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে। রাষ্ট্রযন্ত্র যাঁদের হাতে, ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে তাঁদের রাজনৈতিক মতামত ও অভিসন্ধির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। এই অভিজ্ঞতা এ দেশেও নতুন নয়। তবে ৮ বছর ১০ মাস ১৭ দিন যাবৎ ভারতে যে সুবর্ণযুগ কায়েম রয়েছে, তার মহিমা সর্ব অর্থেই অতুলনীয়। সেই জমানায় ক্ষমতার অধীশ্বরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজ চলেছে অক্লান্ত তৎপরতায়। স্কুলপাঠ্য ইতিহাস সংশোধন প্রকল্পটি এই অভিযানের নতুন পর্ব। এমন প্রকল্প অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ ভাবী নাগরিকদের মস্তিষ্কগুলিকে দখলে আনতে পারলে সামাজিক চিন্তায় ও চেতনায় হিন্দু রাষ্ট্রের ভিত আরও অনেক বেশি জোরদার হয়ে উঠতে পারে।

Advertisement

এই অভিযানের বিরুদ্ধে বিরোধী শিবিরের কোনও কোনও রাজনৈতিক দল অল্পবিস্তর সরব হয়েছে, তবে তাদের অনেকেরই কণ্ঠস্বর স্তিমিত, সতর্ক, ধরি মাছ না ছুঁই পানি। ‘মুসলমান’ সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে বেশি কথা বললে ‘হিন্দু’ ভোট হাতছাড়া হওয়ার ভয়েই হয়তো এই দ্বিধান্বিত নীরবতা। পাঠ্যসূচি পাল্টে দেওয়ার বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন ইতিহাসবিদ ও অন্য শিক্ষাব্রতীদের একাংশ, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং সামাজিক গোষ্ঠী। কিন্তু বড় আকারের প্রতিবাদ এখনও অবধি দেখা যায়নি। সমাজমাধ্যমে অবশ্য যথারীতি কথার পাহাড় রচিত হয়ে চলেছে, কিন্তু তার পনেরো আনাই— যথারীতি— পবিত্র ক্রোধ, শূন্যগর্ভ আক্ষেপ এবং চটুল রসিকতার খোলামকুচি।

আমাদের সমাজমানসে হিন্দুত্ববাদের প্রচ্ছন্ন (ও প্রকাশ্য) সংক্রমণ নিশ্চয়ই এই পরিস্থিতির একটা কারণ। অনুমান করা যায়, ইতিহাস থেকে মোগল যুগের বিতাড়নে বহু নাগরিকই বিচলিত নন, বরং পুলকিত, কারণ তাঁরা মনে মনে হিন্দু ভারতের গর্বিত নাগরিক। কিন্তু সেটা একমাত্র কারণ নয়। গভীরতর সমস্যা লুকিয়ে আছে আমাদের শিক্ষার, বিশেষত ইতিহাস-শিক্ষার ভুবনে। ইতিহাসকে আমরা পাঠ্যবইয়ের খোপেই পুরে রেখেছি, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে তার সংযোগ বেবাক হারিয়ে গিয়েছে। তার ফলে ইতিহাসের বিকৃতি আমাদের মনে কোনও অভিঘাত সৃষ্টি করে না। নানা স্বার্থগোষ্ঠীর মতলব হাসিল করতে সিনেমার পর্দায় ঐতিহাসিক কাহিনি বা চরিত্রের উপস্থাপন নিয়ে থেকে থেকেই অন্তঃসারশূন্য শোরগোল ওঠে, সমাজমাধ্যমে রকমারি বিকৃত ইতিহাস প্রচারের পিছনেও থাকে একই ধরনের অভিসন্ধি, অথবা নিখাদ অজ্ঞতার সবজান্তা আস্ফালন। ইতিহাস-বিচ্ছিন্ন সমাজে সেই সব আবর্জনার স্তূপই জ্ঞানভান্ডার হিসেবে স্বীকৃত হয়। ইতিহাসের বই থেকে মোগল যুগ বাদ পড়লে এই সমাজের কী আসে যায়? তাজমহলের সামনে সেলফি তোলা গেলেই হল।

এই ঔদাসীন্য না ভাঙলে বহুবর্ণ ইতিহাসের উত্তরাধিকার আমরা রক্ষা করতে পারব না। সেই উত্তরাধিকারকে গুঁড়িয়ে দিতে সমুদ্যত সংখ্যাগুরুবাদের বুলডোজ়ারকে যদি প্রতিরোধ করতে হয়, তবে তাকে সত্যকারের সামাজিক প্রতিরোধ হয়ে উঠতে হবে। কেবল নাগরিক সমাজের সীমিত পরিসরে নয়, সেই প্রতিরোধ দরকার বৃহত্তর জনসমাজে। তার জন্য দরকার সামাজিক চেতনা ও বোধের একটা বড় আকারের জাগরণ। সে-কাজে আমাদের ইতিহাসই হতে পারে সোনার কাঠি। কিন্তু সে কেবল পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস নয়। জীবনযাত্রার পরতে পরতে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, শিল্পকলায়, ভাষায়, পোশাক-পরিচ্ছদে, আহারে ও বিহারে, পারস্পরিক আদানপ্রদানের রীতিনীতিতে ইতিহাসের যে অজস্র সম্পদ— নানা যুগের, নানা ভাষার, নানা ধর্মের, নানা মতের, নানা জীবনধারার বহুবর্ণ সম্পদ মিশে আছে, তার অনুসন্ধান ও অনুশীলন চাই, সেই কাজে শিশু কিশোর তরুণ-সহ সমস্ত নাগরিককে শামিল করা চাই, তার ফল জনসমাজের কাছে সহজ ভাষায় পৌঁছে দেওয়া চাই মুখের কথায়, লিখিত অক্ষরে, ছবিতে, গানে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, আরও সহস্র উপায়ে। এ-কাজের এক আনাও যদি আমরা সাধন করতে পারি, তা হলে স্বৈরশক্তির হানাদারি থেকে ইতিহাসকে বাঁচানোর কাজে সমাজ নিজেই অগ্রণী হবে।

কল্পনাবিলাস? না, এটাই একমাত্র বাস্তব উপায়। তার কারণ, আমাদের বাস্তবের মধ্যেই আছে লড়াইয়ের হাতিয়ার গড়ার প্রকৃত উপকরণ। কেমন উপকরণ? একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। দৃষ্টান্তটি সময়োপযোগীও বটে, কারণ তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের নববর্ষের কথা ও কাহিনি।

বাংলা ১৪৩০ সন দুয়ারে সমাগত। কিন্তু কেন ১৪৩০? কোন হিসাবে? আমাদের এই বঙ্গাব্দ কোথা থেকে এল? অমর্ত্য সেনের ‘ইন্ডিয়া থ্রু ইটস ক্যালেন্ডারস’ নামক একটি প্রবন্ধে এই প্রশ্নের প্রাঞ্জল উত্তর আছে। তাঁর দি আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান (২০০৫) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত সেই অসামান্য প্রবন্ধটি জানায় যে, বঙ্গাব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দু’টি ইতিহাস। প্রথমটির নায়ক সম্রাট আকবর। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে আকবর তখ্‌তে বসেন। আটাশ বছর পরে বাদশাহির মধ্যাহ্নে তিনি প্রবর্তন করলেন বর্ষগণনার এক নতুন ক্যালেন্ডার: তারিখ-ই-ইলাহি। তার হিসাব শুরু হল ১৫৫৬ সালকে ‘শূন্য’ ধরে, কিন্তু তার গণনার নিয়ম তৈরি হল তখন এ দেশের নানা অঞ্চলে প্রচলিত নানা ধরনের— যেমন, হিজরি সন, হিন্দু পঞ্জিকা, ইরানি তথা পারসিক ক্যালেন্ডার ইত্যাদি বিভিন্ন ধারার— বর্ষগণনার রীতিকে মিলিয়ে-মিশিয়ে। দীন-ই-ইলাহির মতোই তারিখ-ই-ইলাহিও আকবরের বহু-সাংস্কৃতিক সমন্বয়বাদী চিন্তার একটি নজির। মোগল বাদশার অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও এই ক্যালেন্ডার টিকল না বটে, কিন্তু তার প্রভাবেই গড়ে উঠল এবং টিকে গেল বর্ষগণনার অন্য একটি ধারা— বঙ্গাব্দ। আমাদের বাংলা সন। তার গণনায় সূচনা-বর্ষ ওই ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ।

কিন্তু ১৫৫৬ সালে যদি বঙ্গাব্দ গণনার শুরু হয়, তবে তো এই ২০২৩ সালে বাংলা সন ৪৬৭ হওয়ার কথা, ১৪৩০ কোথা থেকে আসছে? এখানেই দ্বিতীয় ইতিহাস। হিজরি-র ইতিহাস। হিজরি সন তখন এই উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত। হজরত মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রার সময়টিকে (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সূচনা-বিন্দু ধরে হিজরি অব্দের গণনা। তার ক্যালেন্ডার চলে চান্দ্রবর্ষের নিয়ম মেনে। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মানে হিজরি ক্যালেন্ডারে ৯৬৩ অব্দ। বঙ্গাব্দের গণনায় আকবরের রাজ্যাভিষেককে সূচনা-বিন্দু ধরা হল, কিন্তু সেই সূচনার বছরটি চিহ্নিত হল হিজরির অঙ্কে— ৯৬৩ সন হিসাবে। তবে, চান্দ্র বর্ষের পথে না গিয়ে বঙ্গাব্দ হল সৌর ক্যালেন্ডারের অনুসারী, ফলে তা খ্রিস্টাব্দের সমান্তরাল থাকল। বাকিটা সহজ পাটিগণিত— ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ যে-হেতু ৯৬৩ বঙ্গাব্দ, সুতরাং ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে আসছে বাংলা ১৪৩০ সন।

প্রবন্ধের উপসংহারে অমর্ত্য বলেছিলেন, বঙ্গাব্দের উৎপত্তির পিছনে আকবরের বহুত্ববাদী চিন্তাধারার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এবং এর পরে, বোধ করি ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি সহকারে, তাঁর মন্তব্য: “বাঙালি হিন্দু যখন তাঁর পঞ্জিকা অনুসারে কোনও ধর্মীয় আচার পালন করেন, তখন হয়তো তাঁর জানা থাকে না যে, হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের দিনক্ষণগুলি জড়িয়ে আছে মহম্মদের মক্কা থেকে মদিনায় পাড়ি দেওয়ার সঙ্গে”— অর্থাৎ, হিন্দু বাঙালির পুণ্যতিথিগুলি ইসলাম প্রবর্তকের সেই অভিযাত্রার কাহিনিকে স্মরণ করছে!

ইতিহাসের বই থেকে নাহয় মোগল এবং মুসলমানকে বিদেয় করা গেল, তার পরে খাঁটি গোময় লেপন করে সে-বই পরিশুদ্ধ করে নেওয়াও গেল, কিন্তু বাঙালির নববর্ষ যে একই সঙ্গে সম্রাট আকবর এবং হজরত মহম্মদের ইতিহাসকে আপন অন্দরে অন্তরে যত্নে ও শ্রদ্ধায় ধারণ করে আছে! এই উত্তরাধিকারকে সগৌরব স্বীকৃতি দিয়ে যদি তাকে আমাদের সামাজিক প্রতিস্পর্ধার প্রকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি, কোনও বুলডোজ়ারের সাধ্য নেই সেই ব্যারিকেড ভাঙার।

আরও পড়ুন
Advertisement