বেসরকারি সংস্থাকে বিনা সুদে ঋণ দিলে যথেষ্ট গবেষণা হবে কি
Indian Economy

উন্নতির জন্য উদ্ভাবন

এ বারের অন্তর্বর্তী বাজেটে এ বিষয়ে খানিক উৎসাহ দেখা গেল। এক লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণার খাতে। তবে এই টাকা সরকারি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সংস্থার মাধ্যমে খরচ করা হবে না।

Advertisement
ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০২৪ ০৮:৪৭

—প্রতীকী চিত্র।

অর্থনীতিবিদরা কোনও প্রশ্নেই সচরাচর একমত হন না। তবে, দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক উন্নয়নের জন্য ইনোভেশন বা উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণায় লগ্নি করা ভিন্ন উপায়ান্তর নেই, এ কথাটিতে কার্যত সবাই একমত। উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে জোগাড় করা খুব সহজ নয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪.৬% খরচ হয় উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণার খাতে, জাপানে হয় ৩.২%, চিনে ২.৩%, আমেরিকায় ২.৮% এবং ব্রিটেনে ১.৭%। ভারতে হয় ০.৭%। স্থির হয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে ভারতে এই অনুপাত বাড়িয়ে ২ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে।

Advertisement

এ বারের অন্তর্বর্তী বাজেটে এ বিষয়ে খানিক উৎসাহ দেখা গেল। এক লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে উদ্ভাবন সংক্রান্ত গবেষণার খাতে। তবে এই টাকা সরকারি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সংস্থার মাধ্যমে খরচ করা হবে না; এই তহবিল থেকে বেসরকারি সংস্থাগুলি পঞ্চাশ বছরের জন্য বিনা সুদে ধার করতে পারবে। এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘সানরাইজ় সেক্টর’-এর উন্নতি করা। এর মধ্যে আছে ওষুধ, গাড়ি, রাসায়নিক, যন্ত্রাংশ, কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদি নির্মাতা সংস্থাগুলি। এখানে বলার কথাটি হল, শুধু বেসরকারি উদ্যোগে উদ্ভাবনে জোয়ার এসেছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই।

প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্পদ সৃষ্টি সম্ভব নয়, এই ভাবনার পথিকৃৎ হিসাবে প্রথম সারিতে আছেন জোসেফ শুমপিটার; তার পর কেনেথ অ্যারো থেকে ফিলিপ অ্যাঘিওন-এর মতো অর্থনীতিবিদরা। কার্ল মার্ক্সের রচনার সূত্র ধরে শুমপিটার বলেছিলেন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ছাড়া পুঁজিবাদ এগোতে পারে না। তিনি ‘ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন’ বলে একটি শব্দবন্ধ সৃষ্টি করলেন, যার অর্থ, উদ্ভাবন একটা গতিশীল প্রক্রিয়া, যা নতুন নতুন বস্তু সৃষ্টি করেই যায়। অনেক পুরনো সংস্থা তার সঙ্গে তাল মেলাতে না-পেরে দেউলিয়া হয়ে যায়। শুমপিটার মনে করতেন যে, উদ্ভাবন প্রক্রিয়া এক-একটা ঢেউয়ের মতো আসে। প্রতি ৩০ বছরে নতুন নতুন ঢেউ ওঠে। পরবর্তী সময়ে রবার্ট সোলো প্রযুক্তিগত প্রগতির সঙ্গে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি দেখান যে, বৃদ্ধির আশি শতাংশই ব্যাখ্যা করা যায় প্রযুক্তির উন্নতির দ্বারা।

প্রশ্ন হল, এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন করবে কে? ব্যক্তিগত উদ্যোগে তা কতটুকু হতে পারে? এর জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, তা জোগাবে কে?

দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চিন বা আমেরিকার মতো উন্নত দেশে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে জোর দেওয়া হয়েছে বহু দিন ধরেই, যা তাদের শিল্প উৎপাদনকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক কালে আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির উত্থানের গল্প আমরা সবাই জানি। এখানে অজস্র স্টার্ট-আপ সংস্থা কাজ শুরু করে, তার মধ্যে অনেকগুলিই বিপুলায়তন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে পরবর্তী কালে। গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুক, উবর, এয়ারবিএনবি, অ্যামাজ়নের মতো সফল সংস্থার মূলমন্ত্রই হচ্ছে উদ্ভাবন। পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার মাপের অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার পথে কি এ রকম উদ্ভাবক সংস্থা ভারতেও দেখা যাবে?

যে কোনও সফল উদ্ভাবনের পিছনে থাকে অজস্র গবেষকের সুদীর্ঘ পরিশ্রম। তার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ দরকার হয়, যা থেকে তাৎক্ষণিক লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ব্যর্থতার ঝুঁকিও থাকে। স্বভাবতই বেসরকারি উদ্যোগ এই বিনিয়োগ খুব সামান্যই করতে চায়। অতএব সরকারি বিনিয়োগ ছাড়া প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন অসম্ভব। সফল উদ্ভাবনের পিছনে থাকে একটা যৌথ প্রক্রিয়া— পুঁজি দেবে সরকার, আর গবেষকরা করবেন আবিষ্কার। আজকের প্রাত্যহিক ব্যবহারের বহু প্রযুক্তির পিছনে অবদান আছে উন্নত দেশগুলির সরকারি পুঁজির নিয়মিত জোগানের। আইফোন থেকে সৌরবিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, এইচটিএমএল কোড, সবই সম্ভব হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুদানের কারণে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ফলে কিছুটা সাফল্য এলে অনেক সময় ভেঞ্চার ক্যাপিটালের রূপে বেসরকারি পুঁজি সেখানে ঢুকে পড়ে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সময়টা এমন হওয়া দরকার, যখন আবিষ্কারের ঝুঁকিটা পেরিয়ে গিয়েছে, উদ্ভাবনের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। এত অঙ্ক কষেও অনেক সময় দেখা যায় যে, ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বিনিয়োগটা পুরোপুরি লোকসান। আবার এ রকম অনেক বিনিয়োগ সাফল্যের মুখও দেখেছে— এত লাভ করেছে যে, আর ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা এত রোজগার করছেন উদ্ভাবন থেকে তেমন ঝুঁকি না নিয়েই, সেটা কি ন্যায্য? ঝুঁকি পুরোপুরি থাকছে সরকারের ঘাড়ে, আর তার সুফল ভোগ করছেন এই লগ্নিকারীরা!

বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রিতে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা প্রচুর লাভের মুখ দেখছেন আজকাল। কিন্তু এই আবিষ্কারের পিছনে তাঁদের অবদান কতটুকু? তাঁরা আবিষ্কারের সুফল ভোগ করছেন, ব্যবসা বাড়িয়ে চলেছেন। হাইটেক স্টার্ট-আপ সংস্থাগুলো প্রধানত আইপিও-র মাধ্যমে টাকা তোলার উপরে নির্ভরশীল। এর কুফলও কিছু দেখা গিয়েছে বায়োফার্মাসিউটিক্যাল স্টার্ট-আপ’এর ক্ষেত্রে। অনেক সময় দেখা গিয়েছে এই সংস্থাগুলো আইপিও-র মাধ্যমে টাকা তুলেছে বাজার থেকে, কিন্তু কোনও ওষুধ তৈরির দায়িত্ব নেয়নি। এরা উদ্ভাবনী গবেষণার চুক্তি করে কোনও বড় ওষুধ সংস্থার সঙ্গে, আর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সাফল্য বা ব্যর্থতার উপরে ভিত্তি করে ফাটকা বাজারে লেনদেন করে তাদের শেয়ারের। এর ফলে উদ্ভাবনের সাহায্যে মূল্য (ভ্যালু) সৃষ্টি না হয়ে মূল্য নিষ্কাশনের একটা প্রক্রিয়া চলেছে পৃথিবী জুড়ে, যা নৈতিক ভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

পেটেন্ট হচ্ছে মূল্য নিষ্কাশনের আর একটি পথ। শুরুতে পেটেন্টের উদ্দেশ্য ছিল, পেটেন্টের ফলে আবিষ্কর্তা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত একচেটিয়া আধিপত্য রাখতে পারবেন তাঁর আবিষ্কারের উপরে। পেটেন্টের মেয়াদ ফুরোলে তিনি তাঁর আবিষ্কারের খুঁটিনাটি প্রকাশ করে দেবেন, যার ফলে মানুষের উপকার হবে। পেটেন্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত মূল্য সৃষ্টি করা। এখন পেটেন্ট মূল্য সৃষ্টি না করে মূল্য নিষ্কাশনের পদ্ধতি হয়ে উঠছে ক্রমশ, যার মূল উদ্দেশ্য, সংস্থার মুনাফা বৃদ্ধি।

সরকার শুধু বিনিয়োগ করবে কিন্তু কোনও লাভ করতে পারবে না উদ্ভাবন থেকে, এটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। একটা ‘ইনক্লুসিভ’ উদ্ভাবনের ধারণা তৈরি হওয়া দরকার, যাতে সমস্ত অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি পুরস্কৃত হন, লাভের অংশ পান। উদ্ভাবন যে-হেতু সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল, তার ফলটাও সম্মিলিত ভাবে ভাগ হওয়া দরকার।

আশা করি, বর্তমান সরকারের এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে বিনিয়োগের ফলে প্রকৃত মূল্য সৃষ্টি হবে এবং উদ্ভাবন শুধুমাত্র মূল্য নিষ্কাশনের পদ্ধতি হয়ে দাঁড়াবে না। আমাদের দেশে প্রধানত অন্যদের করা উদ্ভাবনকে নকল করে উৎপাদন করা হত এত দিন। মৌলিক আবিষ্কার খুব বেশি হয়নি, মূলত বিনিয়োগের অভাবে। বেসরকারি উদ্যোগে উদ্ভাবনে বিনিয়োগ হলে শুধুমাত্র সেই সংস্থার হাতেই থাকে তার অধিকার। কিন্তু যদি সরকারি বিনিয়োগ হয় উদ্ভাবনে, তা হলে এই আবিষ্কারের সুফল পাবেন অনেকে, ‘স্পিলওভার এফেক্ট’-এর ফলে। অনেক বেশি লাভ হবে অর্থব্যবস্থার।

তবে, এই বাজেটে যে টাকা বরাদ্দ হয়েছে উদ্ভাবনের জন্য, তা সরকার সরাসরি বিনিয়োগ করবে না, ঋণ হিসাবে দেবে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে। ঋণ নিয়ে তারা উদ্ভাবনে কতটা আগ্রহী হবে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তারা ঋণ নিয়ে কী ভাবে তা ব্যবহার করবে, সে দিকেও নজর রাখা দরকার। সরকারি বিনিয়োগ প্রধানত বিজ্ঞান গবেষণায় উৎসাহ দেওয়ার জন্য দরকার। বিনিয়োগ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ২০২০ সালের ‘সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন পলিসি’-তে বলা হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে জোর দেওয়া দরকার, ও তার জন্য দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও পরিকাঠামো বাড়াতে হবে। এগুলি যথাযথ ভাবে করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি বা আইসার-এ বিনিয়োগের পাশাপাশি এদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া দরকার গবেষণা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কল্পিত অতীতে বৈদিক যুগের উদ্ভাবনে মজে থাকলে আমরা ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারব না, এটা সর্বস্তরে অনুভব করা দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement