বিজ্ঞান ও মানবিক বিদ্যার মধ্যে দূরত্ব হয়েছে অনতিক্রম্য
Science and Humanities

দু’টি দিকে গেছে বেঁকে

জীবনের উপান্তে কবির এই আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে, হাহাকার হয়ে বেজেছে, যার পরিচয় ছত্রে ছত্রে ধরা আছে মৃত্যুর কিছু দিন আগে লেখা সভ্যতার সংকট পুস্তিকাটিতে।

Advertisement
শিবাজীপ্রতিম বসু
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২৩ ০৬:৩২
Woman.

প্রতীকী ছবি।

জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর/ আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী/ বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি...।” জ্ঞানকে একটি বেগবান মুক্ত স্বচ্ছতোয়া মনে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যার উৎসে হয়তো থাকে একটি বিশিষ্ট সভ্যতার অবদান, কিন্তু যা আদতে একটি বিশিষ্ট সভ্যতার ‘একান্ত’ সম্পদ নয়, তা বিশ্বজনীন, সমগ্র মানবসমাজেরই। যেমন, সংখ্যা জগতে ভারতীয় সভ্যতার অনন্য অবদান, ‘০’ (শূন্য) সংখ্যাটি— যা বাদ দিয়ে সাধারণ দৈনন্দিন জীবন থেকে জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণা সব কিছুই অসম্ভব, তা কি কেবলমাত্র ভারতের? একই ভাবে, প্রাচীন চিনা সভ্যতার অবদান, চা, রেশম কিংবা চিনামাটির বাসন, সেও তো পৃথিবীর সব দেশের মানুষ ‘নিজের’ করে নিয়েছে। কিন্তু গত শতাব্দীর গোড়া থেকে কবি উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ করে এসেছেন, কী ভাবে আধুনিক আধিপত্যবাদী পশ্চিম, জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়ে তাদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থপূরণের জন্য আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান লব্ধ নানা ‘ফসল’ (প্রযুক্তি, পণ্য, বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল)— যা স্মরণাতীত কাল থেকে সর্বজনীন মানবসভ্যতার সম্পদ বলে বিবেচিত হত, তার মুক্তধারাকে বেঁধে রাখতে চার পাশে কঠিন বাঁধ নির্মাণ করছে, যাতে এক দেশের জ্ঞানের ফসল অন্য দেশের মানুষ অবাধে ব্যবহার করতে না পারে!

জীবনের উপান্তে কবির এই আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে, হাহাকার হয়ে বেজেছে, যার পরিচয় ছত্রে ছত্রে ধরা আছে মৃত্যুর কিছু দিন আগে লেখা সভ্যতার সংকট পুস্তিকাটিতে। সেখানে তিনি, উনিশ শতকে কাটানো তাঁর বাল্য-কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতি রোমন্থন করে বলছেন, অনেক অন্যায়-অবিচার সত্ত্বেও, কী ভাবে শিক্ষিত ভারতবাসী ইংরেজি সাহিত্যচর্চা করে ‘বৃহৎ মানববিশ্ব’-এর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। “তখন ইংরেজি ভাষার ভিতর দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও উপভোগ করা ছিল মার্জিতমনা বৈদগ্ধ্যের পরিচয়।... তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস।” নানা অভিঘাতে এই ‘বিশ্বাস’ ভাঙতে ভাঙতে জীবনান্ত বেলায় কবি ভাবছেন, তিনি বড় ঠকে গেছেন: “জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।”

Advertisement

কবি বর্ণিত সভ্যতার এই ‘সর্বজনীন’ আবেদনের পশ্চিমি বিশ্বাসের ভিত্তি নিহিত আছে অষ্টাদশ শতকে ঘটা ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তি (এনলাইটেনমেন্ট) নামক বৌদ্ধিক আন্দোলনে। এর প্রবক্তারা মনে করতেন, কুসংস্কার পরিত্যাগ করে জ্ঞানবিজ্ঞানের ভিত্তিতে সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তি অবলম্বন করে, জীবনের সব ক্ষেত্রে যদি চলা যায়, তবে তা বিশ্বের সর্বত্রই প্রগতিমূলক বিকাশ সুনিশ্চিত করবে। ইউরোপীয় জ্ঞানদীপ্তি আন্দোলনের এই মৌলিক প্রতিপাদ্যগুলিই বিশ্বজনীন ‘আধুনিকতা’রও ভিত্তি। অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে এই জ্ঞানদীপ্তিবাহিত আধুনিকতা দেশে দেশে বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও কলা-শিল্পের মূল মর্মবাণীকে একটি সরল সর্বজনীন রূপ দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহার্য করে তুলেছিল। ফলে, মোটামুটি শিক্ষিত মানুষ তখন একই সঙ্গে সাহিত্য, বিজ্ঞান বা দর্শন সম্পর্কে অন্তত খানিকটা ওয়াকিবহাল ছিল, আজকের মতো, ‘আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তাই উত্তর-আধুনিক সাহিত্যতত্ত্ব ভাল বুঝি’, ‘তুমি পদার্থবিদ্যার, তোমার অধিকার কেবল ব্ল্যাক হোল আলোচনায়’, এই জাতীয় ভাগাভাগি ছিল না। ফলে, তখন বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ নিঃসঙ্কোচে ‘এক্তিয়ারবহির্ভূত’ নানা বিষয়ে লিখতে পেরেছেন। বিশ শতক থেকে আধুনিকতার এই সর্বজনীন রূপটি ধাক্কা খেল, যখন নানা ক্ষেত্রে ‘বিশেষজ্ঞ’রা, এক-একটি বিষয়ে কথা বলার ‘অধিকারী’ হয়ে উঠল। সর্বজনীন আধুনিক জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যটিই তখন মাটি হল। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চার দশক পর (১৯৮০), অনেকটা কবির সুরেই, এমন আক্ষেপ করছেন আধুনিক জার্মানির অন্যতম বিখ্যাত দার্শনিক, ইয়ুরগেন হাবরমাস।

হাবরমাসের বক্তব্যের দু’দশক আগেই অবশ্য প্রখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক সি পি স্নো জ্ঞানক্ষেত্রের বিভাজন নিয়ে অন্য ভাবে বোমা ফাটিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত ‘টু কালচারস’ বক্তৃতায় (১৯৫৯), যা প্রথম দিন থেকে আজ অবধি জ্ঞানচর্চার জগতে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। বিদ্যাচর্চার এই ‘দুই সংস্কৃতি’ হল কলাসাহিত্য ভিত্তিক ‘লিবারাল আর্টস’-এ শিক্ষিত মানুষের সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানচর্চায় যুক্ত মানুষদের সংস্কৃতি। এই দুই সংস্কৃতির ‘শিক্ষিত’ মানুষদের মধ্যে এমন ফারাক গড়ে উঠেছে যে একে অন্যকে, বিশেষত কলাসাহিত্যে শিক্ষিত মানুষ বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের যথেষ্ট ‘শিক্ষিত’ মনে করে না (কারণ, তারা শেক্সপিয়র পড়েনি), অথচ, স্নো উষ্মার সঙ্গে লক্ষ করছেন, ‘লিবারাল আর্টস’-এ শিক্ষিতদের অনেকেই ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ক বহু প্রাথমিক তথ্যের বিষয়েও প্রায় অজ্ঞ। “একবার বা দুবার আমি প্ররোচিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, এই গোষ্ঠীর মধ্যে কত জন তাপগতিবিদ্যার (থার্মোডাইনামিক্স) দ্বিতীয় সূত্র বর্ণনা করতে পারে। এর প্রতিক্রিয়া ছিল শীতল এবং নেতিবাচক।” ফলে, ‘শিক্ষিত মানুষ’-এর সকলে জ্ঞানচর্চা বলতে আজ আর এক-কথা বোঝে না। স্নো-র মতে, ব্রিটেনে এই ভিক্টোরীয় যুগের প্রভাব এখনও (১৯৫০-৬০’এর দশকে) চলছে, বিপরীতে জার্মানি ও আমেরিকা তাদের নাগরিকদের বিজ্ঞান ও মানববিদ্যা, দুই বিষয়েই উৎসাহ দেয়।

স্নো-র এই প্রবন্ধ এবং পরবর্তী কালে একই বিষয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একই সঙ্গে তা বিশ্বের গত সাত দশক ধরে দু’টি সংস্কৃতিতে ভেঙে যাওয়া উচ্চশিক্ষা জগৎ, এক দিকে মানববিদ্যা-সমাজবিজ্ঞান কেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চা আর অন্য দিকে ভৌত বা জীবন সম্বন্ধীয়বিজ্ঞানচর্চা সম্পর্কে তিক্ত সত্যটি উন্মোচন করেছে। এ যেন লিউইস ক্যারলের অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড-এর ‘হাম্পটি-ডাম্পটি’ নামক জোড়া চরিত্র— যারা সহসা পাঁচিলের উচ্চাসন থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে চৌচির! রাজার লোকলস্কর আর ঘোড়সওয়ারের দল কত চেষ্টাই করল, কিন্তু ‘হাম্পটি-ডাম্পটি’ আর জুড়ল না!

সারা বিশ্বের সঙ্গে এ দেশেও উচ্চতর বিদ্যাচর্চা— শিক্ষণ ও গবেষণা— একই সমস্যায় দীর্ণ। এ রাজ্যও তার বাইরে নয়। এখানেও ‘গবেষণা’ বলতে আগমার্কা বিজ্ঞান যা বোঝে, সমাজবিজ্ঞান একই জিনিস বোঝে না, ভাষাচর্চাকারী মানববিদ্যার অন্য শাখাগুলিও নয়। বিজ্ঞানের প্রায় সকল গবেষণাই চলে একটি সামূহিক প্রকল্প হিসাবে। এক জন বা কয়েক জন খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক সেই প্রকল্পের নেতৃত্বদান করতে পারেন, কিন্তু গবেষণা চালানো ও তার ফলাফল, কোনওটাই একার কৃতিত্ব নয়, তা ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত একাধিক (অনেক সময় নানা দেশের নানা গবেষণাগারের সঙ্গে যুক্ত) মানুষের অর্জিত ফসল। তাই, ওই বিষয়ে গবেষণাপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধগুলির লেখকের সংখ্যাও ‘এক’ নয়, এক গুচ্ছ, অনেক সময় দশেরও বেশি! মানববিদ্যা-সমাজবিজ্ঞানচর্চারত গবেষকদের ‘রচনা সংস্কৃতি’র চেয়ে এটা একদম ভিন্ন, সেখানে গবেষণাপত্রে ‘প্রথম’ লেখকের সঙ্গে ‘দ্বিতীয়’ বা বড়জোর ‘তৃতীয়’ লেখক থাকে, তার বেশি নয়। এ ছাড়া, বিজ্ঞানের গবেষকদের সকলেরই রচনা প্রকাশের প্রধানতম মাধ্যম বৈজ্ঞানিক জার্নাল, গ্রন্থ প্রায়শ নয়। কারণ, গবেষণার প্রক্রিয়া এতই জটিল ও বিশেষীকৃত যে, বই বেরোলে কে পড়বে! ফলে, স্টিফেন হকিং-এর আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর মতো জটিল অথচ জনপ্রিয় বই ছাড়া বিজ্ঞানীরা মুখ্যত আন্তর্জাতিক জার্নাল-নির্ভর। সেই জার্নালগুলির আবার গুরুত্ব অনুযায়ী নানা ‘প্রভাব’/‘ইমপ্যাক্ট’-এর মাপকাঠি। এবং প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলির যা ‘ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর’, মানববিদ্যা-সমাজবিজ্ঞান জার্নালগুলির তার ধারেকাছেও নয়। তাদের গবেষণায় আবার জার্নাল-প্রবন্ধগুলির পাশাপাশি একক বা যৌথ গ্রন্থপ্রকাশ সমান গুরুত্বের। বিজ্ঞান গবেষকদের কাছে আবার এগুলির তেমন মূল্য নেই, কারণ, যত বিখ্যাতই হোক, গবেষণাগ্রন্থের কোনও প্রভাব-পরিমাপক নেই। বড়জোর, অন্য কোনও রচনায় তা উদ্ধৃত হলে কিছু ‘নম্বর’ পাওয়া যাবে!

এই ভাবে সম্মিলিত সর্বজনীন জ্ঞানচর্চার আদর্শ থেকে একদম সরে এসে উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে আমরাও বিদ্যাচর্চার দুই ভিন্ন সংস্কৃতির প্রায় অনতিক্রম্য ভুবন গড়ে তুলেছি। শোনা যাচ্ছে, নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি নাকি এই সব বাধা পেরিয়ে নানা স্তরে ছাত্রছাত্রীদের ফের বিবিধ জ্ঞানের ‘সম্মেলন’ ঘটানোর সুযোগ করে দেবে। সত্যিই কি তা-ই হবে? তা জানতে শুধু নীতির ‘কাগজপত্র’ নয়, তার প্রয়োগের ফলাফলের জন্য বেশ কিছু দিন তাকিয়ে থাকতে হবে।

আরও পড়ুন
Advertisement