Alipore Museum

আমোদলোভীর ইতিহাস শিক্ষা

আলিপুর বোমার মামলার কিছু আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। হয়েছিল এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

Advertisement
অশোককুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:৩৮

ফাইল চিত্র।

একটা কারাগারকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে ভরিয়ে তুলে ধ্বনি-আলোর অনুষ্ঠান রচনা করে তাকে আকর্ষক করে তোলার চেষ্টা নিশ্চয়ই প্রশংসার। কারণ, এর মাধ্যমেই তো আজকের প্রজন্ম সেই সংগ্রামীদের সম্পর্কে জানতে পারবে, আরও জানার কৌতূহল তৈরি হবে।

কিন্তু, আলিপুর মিউজ়িয়ামের সন্ধে ছ’টার লাইট অ্যান্ড সাউন্ড অনুষ্ঠানে (২৭ ডিসেম্বর, ২০২২) যা দেখা গেল, বেশ মন খারাপের। বাংলার বিষয়বস্তু, বাঙালির ইতিহাস, বাঙালির কণ্ঠ, তবু সব দেখেশুনে মন বেশ খারাপ। ভাষ্যপাঠ যিনি করেছেন, তাঁর বাংলা উচ্চারণের জড়তা অতটা গায়ে লাগত না, যদি ভাষ্যের তথ্যগুলি সঠিক-সম্পূর্ণ হত।

Advertisement

প্রথমেই বলে রাখা যাক, এই আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, যেখানে এই ধ্বনি-আলো চলছে, সেখানে ঘটা করে অরবিন্দের নাম বলা হলেও অরবিন্দ-বারীন্দ্র-উল্লাসকর-হেমচন্দ্র প্রমুখ আলিপুর বোমার মামলায় ধৃত বন্দিরা থাকেননি, নরেন গোসাঁইয়ের হত্যাও এই জেলে হয়নি। ওঁরা যে জেলে ছিলেন, তাকে মুখে-মুখে আলিপুর জেল বলা হলেও, তা আসলে এখনকার প্রেসিডেন্সি জেল। কিন্তু প্রেসিডেন্সি জেল, যা এখনও চালু সংশোধনাগার, সেখানে এই সব ধ্বনি-আলো করা যাবে না, তাই সম্ভবত বন্ধ হওয়া আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের আঙিনায় ইতিহাসের গল্প বলা। উদ্দেশ্য মহৎ, কিন্তু যা দেখেশুনে মানুষ শিখবে, সেখানে সতর্ক-সত্যনিষ্ঠ থাকতে হবে তো! কত যে গুরুত্বপূর্ণ নাম বাদ পড়ে গেছে!

আলিপুর বোমার মামলার কিছু আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। হয়েছিল এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। স্বামীজির ছোট ভাই বলে কোনও ছাড় নেই, ঘানি টানতে হত তাঁকে! কোনও উল্লেখ নেই তাঁর। তখন তো তিনটি পত্রিকা বাংলা কাঁপিয়ে দিচ্ছে— সন্ধ্যা, যুগান্তর আর বন্দে মাতরম্। এই পত্রিকার প্রসঙ্গই বা বাদ যায় কী ভাবে?

এমনই অনুল্লিখিত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত এবং হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো)। উল্লাসকর দত্ত এবং হেমচন্দ্র দু’জনেই সেই স্বদেশি যুগের— অগ্নিযুগের— অস্ত্রগুরু। বাংলায় বোমার সূচনা এঁদেরই হাতে। নিজের সম্পত্তির একাংশ বিক্রি করে হেমচন্দ্র চলে গিয়েছিলেন প্যারিস, ভাল করে বোমা বানানো শিখবেন বলে। এঁদের অনুল্লেখ খুবই পীড়িত করে। আলিপুর বোমার মামলায় প্রথমে ফাঁসির রায় হয়েছিল উল্লাসকরের। রায় শুনে গেয়ে উঠেছিলেন, সার্থক জনম আমার...। বিরোধী পক্ষের ব্যারিস্টার নর্টন কান্না চাপতে চোখে রুমাল দিলেন!

আইএনএ-র কথায় যদি শুধু মোহন সিংহ এবং রাসবিহারী বসুর নাম থাকে এবং সুভাষচন্দ্র বসু অনুল্লিখিত থেকে যান, তা যেমন অনৈতিক, তেমনই অনৈতিক ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ প্রসঙ্গে শুধু সুভাষচন্দ্রের নাম রাখা। ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বা বিভি-র প্রাণ ছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ এবং মেজর সত্য গুপ্ত। এঁদের অনুল্লেখ মন খারাপ করে দেয়। এই রকম আরও লম্বা করা যায় অনুল্লেখের ফর্দ।

ধ্বনির মধ্যে যা খুবই কৌতুকের, মাঝেমধ্যেই ‘ভারতমাতা কি জয়’ স্লোগান। কে গবেষণা করে বার করেছেন এমন তথ্য যে, ওই সময়ে এই স্লোগান দেওয়া হত? আমরা যত দূর জানি, ইতিহাস বই এবং ব্রিটিশ পুলিশ রিপোর্ট যা বলে, কোথাও এই স্লোগান নেই। তখনকার স্লোগান ‘বন্দে মাতরম্’, যা বলার অপরাধে কিশোর সুশীল সেনকে বেত্রদণ্ড দিয়েছিলেন ডগলাস কিংসফোর্ড। যার জন্য তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন বিপ্লবীরা। সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বোমা নিয়ে মুজফ্ফরপুরে ছুটেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী। যে ক্ষুদিরামের কথা বলা হয়েছে এই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ভাষ্যে, তাঁকে কিন্তু গ্রেফতারের পরে এই জেলে আনা হয়নি, ফাঁসিও এখানে হয়নি; ভাষ্য শুনে সব গুলিয়ে যাওয়ার উপক্রম! কী বলব, কাকে বলব, কতটা বলব— এই সব প্রশ্নের উত্তরে স্বচ্ছতা না থাকলে এমনই হয়।

তবে এ-ও সহ্য করা যেত। এই ঘোর লাগা সময়ে আমরা তো দেখছি, কে বা কারা এক অদ্ভুত উপায়ে মসজিদের শিকড়ে মন্দিরের চূড়া খুঁজে পাচ্ছে; দ্রুত রচিত হচ্ছে নতুন ইতিহাস। ভূগোল গুলিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে রামচন্দ্রের পায়ে চলা পথ, পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের রাস্তা। এ সব যখন সহ্য হয়ে গেছে, আলিপুর মিউজ়িয়ামের ভাষ্যের ভুলভ্রান্তিও সহ্য হয়ে যেত এই ভেবে নিয়ে, এর চেয়ে অনেক কৌতুককর ভুল তথ্য এই রাজ্যের শাসনব্যবস্থার শীর্ষবিন্দু থেকে ঝরে পড়ছে অবিরল, তার তত্ত্বাবধানে এর চেয়ে ভাল কাজ আর হবে কী করে!

কিন্তু যখন চোখের সামনে দেখা গেল, এক জন ফাঁসির দড়ির ফাঁদের মধ্যে নিজের গলা ঢুকিয়ে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে, তাঁর সঙ্গে ঘুরতে আসা অন্য জন তাঁর ছবি তুলছেন, এবং তাঁদের এ কাজে নিবৃত্ত করার কেউ নেই, কেমন লাগে তখন? কেমন লাগে, যখন দেখা যায়, দর্শনের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে কিছু ‘পাড়ার ছেলে’ নিরাপত্তারক্ষীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের মাথায় উঠে পড়ছে। কেন? কোন ইতিহাস লেখা ওই চূড়ায়, যা তাদের জানতেই হবে তদ্দণ্ডে?

একটা ঔপনিবেশিক শাসকের তৈরি জেলখানায় ঢুকে নিজেদের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে গিয়ে, স্বাভাবিক নিয়মে ভাবগম্ভীর হওয়ার বদলে, যদি আমজনতা আমোদলোভী হয়ে ওঠে, বুঝতে হবে, আমরা একটা বিকৃতমনা জাতি হিসেবে বেড়ে উঠছি, যাদের মননে চিন্তার স্বাভাবিক সূত্রগুলি যথাযথ কাজ করছে না।

ভুল তথ্য নাহয় সমালোচনা শুনে শুধরে নেওয়া যাবে, কিন্তু এই সব সেলফি তোলা জনগণের প্রবাহকে কী ভাবে সভ্য করে তোলা যাবে? সে অনেক শতাব্দীর সাধনার কাজ।

আরও পড়ুন
Advertisement