Religious Discrimination

‘এখানে জায়গা হবে না’

ভাড়া পাওয়াও মুখের কথা নয়। স্বধর্মী ভিন্ন ভাড়া না দেওয়ার মানসিকতা সর্বব্যাপ্ত। সেখানেও সমাজ সংসার আত্মীয় মায় গৃহে প্রতিষ্ঠিত গোপালঠাকুর— যুক্তি অগণ্য।

Advertisement
আকাশ বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৪৯
An image of no entry

—প্রতীকী চিত্র।

হিন্দু ধর্মমত ব্যাখ্যা করতে বললে আমি শুধু বলব অহিংসার পথে সত্যের সন্ধান। কোনও মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও নিজেকে হিন্দু বলতে পারেন। অক্লান্ত সত্যান্বেষণই হিন্দু ধর্ম। সকল ধর্মের চেয়ে হিন্দু ধর্ম সহিষ্ণু এ তো নিশ্চিত। হিন্দু ধর্ম সকলকে আপন করে নেয়।” মহাত্মা গান্ধীর এই কথার মতোই ভাবতে চান অনেকে, বিশ্বাস করেন। শিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দের ভাষণের মূল প্রতিপাদ্যও এই বিশ্বাস। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে এই বিশ্বাস মিললে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যালঘু পড়ুয়ার থাকার জায়গা খুঁজে পেতে হয়রান হওয়ার কথা কাগজে খবর হত না।

Advertisement

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে র‌্যাগিংয়ের কবলে পড়ে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যখন এ রাজ্য দিশাহারা, দূর গ্রাম-শহর থেকে সন্তানকে কলকাতায় পড়তে পাঠানো অভিভাবকদের দশা করুণ, হস্টেলে ভরসা হারিয়ে অনেকেই চাইছেন পেয়িং গেস্ট বা মেসে থাকুক সন্তান, এ-হেন পরিস্থিতিতে চাহিদা ও জোগানের সমস্যা হবেই। কিন্তু সমস্যাটা আরও প্রবল, ছাত্র বা ছাত্রীটি অ-হিন্দু হলে। বাড়ির মালিকদের নানান যুক্তি: প্রতিবেশীদের গোঁড়ামি, সহ-আবাসিকদের অস্বাচ্ছন্দ্য। উল্লিখিত খবরটিতে প্রকাশ, মুসলমান বলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়নি কেউ, বরং নিজের উদারতার অভাব নেই জানিয়ে, প্রতিবেশিক অসুবিধার অজুহাত দিয়েছে।

এমন পেয়িং গেস্ট রাখা পরিবারের কথাও জানি যারা অ-হিন্দু শিক্ষার্থীকে থাকতে দেয়, তবে সেই ছাত্রেরা গৃহকর্তার খাওয়ার টেবিলে বসে খেতে পারে না, খাবার নিয়ে ঘরে চলে যেতে হয়। জীবনে প্রথম জমিদারি সামলাতে পূর্ববঙ্গে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, “কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত।” সেই ‘ট্র্যাডিশন’ই কি চলছে না? মেনে নেওয়াও চলছে। যে বাড়ির কথা বললাম তার এমন নিয়ম-রীতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দূরে থাক, প্রতি বছরই সেখানে আসে নতুন অ-হিন্দু ছাত্র, কারণ এই জায়গাটুকু পাওয়াও অনেক বড় পাওয়া। এটুকুও না জুটলে উপায় নিজস্ব ফ্ল্যাট কেনা বা ভাড়া নেওয়া, বা মেটিয়াবুরুজ রাজাবাজার পার্ক সার্কাসে আশ্রয় খোঁজা। সেখান থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব যদি বেশি হয়, পড়াশোনার অনুকূল পরিবেশ যদি না-ও মেলে, নান্যঃ পন্থাঃ।

ভাড়া পাওয়াও মুখের কথা নয়। স্বধর্মী ভিন্ন ভাড়া না দেওয়ার মানসিকতা সর্বব্যাপ্ত। সেখানেও সমাজ সংসার আত্মীয় মায় গৃহে প্রতিষ্ঠিত গোপালঠাকুর— যুক্তি অগণ্য। ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রেও ছবিটা ভয়াবহ। বহু গৃহপতি তাঁর জমি প্রোমোটার তথা নির্মাতার হাতে সমর্পণের আগে এ অনুরোধে কুণ্ঠিত হন না যে, তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেয় যেন অ-হিন্দুকে ফ্ল্যাট বেচা না হয়! অপর পক্ষেরও অসম্মতি থাকে না, কারণ ‘বিধর্মী’র সঙ্গে সহাবস্থানে অধিকাংশ ক্রেতাই গররাজি হবেন— পূর্বসিদ্ধান্ত এমনই, এবং তা পরিবর্তনের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। সংখ্যালঘুকে জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনতে তাই বেছে নিতে হয় কাজিপাড়া শেখপাড়া মোল্লাপাড়ার মতো এলাকা। কর্পোরেট কাঠামোর বড় আবাসন ব্যতীত সংখ্যাগুরু পাড়ার ছোট ছোট আবাসনে সংখ্যালঘু ফ্ল্যাট মালিক বা ভাড়াটে খুঁজতে হয় দূরবিন দিয়ে।

নতুন গড়ে ওঠা নিউ টাউন-রাজারহাটের আবাসনগুলিতেও অবস্থা ভয়াবহ। সেক্টর ফাইভ ও নিউ টাউনে চাকরিসূত্রে শিক্ষিত সংখ্যালঘু যুবাদের ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া বা কেনার ভাল চাহিদা রয়েছে। অথচ অধিকাংশ সমবায়-আবাসনের কমিটি মিটিংয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তের অলিখিত ও প্রচলিত নিদান— ‘বাঙালি’ ছাড়া কাউকে ভাড়া দেওয়া যাবে না। এখানে ‘বাঙালি’ বলতে অবশ্যই হিন্দু-র প্রতিশব্দ বা সমার্থক।

চিরকালই পরিস্থিতি এমন। মাসিমা, পিসিমা, জেঠিমা, খুড়তুতো, মাসতুতো— এই সব শব্দ সংখ্যালঘুর জানা, কিন্তু সংখ্যাগুরু হিন্দু আজও কি জানে ফুফু খালা চাচির অর্থ আর তফাত? বছর বছর ছুটি ভোগ করেও তারা শেখেনি কোনটা ইদ-উল-ফিতর, কোনটাই বা ইদ-উজ-জোহা। এর পরেও, কয়েকশো বছর পাশাপাশি থেকেও, ধর্মান্তরিত ভাইয়ের সূত্রে ভাগ হয়ে যাওয়া পৈতৃক ভিটেয় এক দরমার বেড়ার এ পারে-ও পারে বসেও সংখ্যালঘুর সঙ্গে মেশার সব পথ যথাসম্ভব বন্ধ রেখেই দাবি করব ‘আমরা’ কালে কালে কত ‘প্রোগ্রেসিভ’ হয়েছি, কিন্তু ‘ওরা’ সেই তিমিরেই! প্রত্যাখ্যান কেমন করে জাগিয়ে তোলে পারস্পরিক অসূয়ার বিষ, কে ভাবতে চায় !

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মুসলমানধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিশয় সংকীর্ণ। আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক।” সম্প্রদায় তো শুধু হিন্দু-মুসলমান নয়, ব্রাহ্মণ কায়স্থ মাহিষ্য নমশূদ্র আরও কত ভাগাভাগি। আজকের হিন্দু অধ্যুষিত বহুতল আবাসনগুলি ভবিষ্যতে বামুনপাড়া, বদ্যিপাড়া, নমশূদ্র পাড়ার মতো ফ্লোরে-ফ্লোরে, তলায়-তলায় ভেঙে যাবে না তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement