Loneliness

বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা

একাকিত্বকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে ২০১৬ সালে ব্রিটেনে তৈরি হল ‘জো কক্স কমিশন অন লোনলিনেস’। কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়ে ২০১৭-র শেষে।

Advertisement
অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫৭

—প্রতীকী ছবি।

এক নতুন মহামারি নাকি গ্রাস করতে চলেছে সভ্যতাকে। ‘একাকিত্ব’। আ বায়োগ্রাফি অব লোনলিনেস-এর লেখক ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ফে বাউন্ড অ্যালবার্টি ‘একাকিত্ব’কে বর্ণনা করেছেন গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্নতা বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সচেতন, সজ্ঞান অনুভূতি হিসাবে। এই ‘একাকিত্ব’ তারুণ্য কিংবা যৌবনের উচ্ছলতাকেও গ্রাস করে ফেলে অনায়াসে। তৈরি করে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, হৃদ্‌‌রোগ, স্মৃতিভ্রংশ, নিদ্রায় গোলযোগ। অকালমৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে ৩০%। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার পরিণতিতে নাকি জীবনকালের পরিমাণ কমতে পারে দৈনিক ১৫টি সিগারেট খাবার সমতুল পরিমাণে। ‘নির্জনতা’ এর বিপ্রতীপে। অনেকে এমন ‘একা’ হতেই চায়— দার্জিলিং না গিয়ে যেতে চায় শিলং পাহাড়ে। বেলজিয়ান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও কবি মে সার্টন বলেছিলেন, ‘একাকিত্ব’ হল দারিদ্র এবং ‘স্বাতন্ত্র্য’ হল সমৃদ্ধি।

Advertisement

আমেরিকার সার্জন জেনারেল ডাক্তার বিবেক মূর্তি সামাজিক ভাবে একাকিত্বকে প্রতিহত করতে বেশ কিছু পরিকল্পনা করেছেন সম্প্রতি। তাঁর ২০২০ সালের বই টুগেদার: দ্য হিলিং পাওয়ার অব হিউম্যান কানেকশন ইন আ সামটাইমস লোনলি ওয়ার্ল্ড-এ মূর্তি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন একাকিত্বের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের, এ সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণার, এবং একাকিত্বের ফলে সম্ভাব্য শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির। একাকিত্বকে রুখতে কী ভাবে এক সম্পর্ক-কেন্দ্রিক সমাজকে লালন করা যায়, তারই তত্ত্বতালাশ করেছেন বিবেক মূর্তি। আমেরিকায় সামাজিক যোগাযোগকে এখন খাদ্য, জল আর বাসস্থানের মতোই মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।

একাকিত্ব এবং তার বিপদ নিয়ে চর্চা দীর্ঘ দিনের। অ্যালবার্টি অবশ্য বলছেন, উনিশ শতকের আগে একাকিত্বের দীর্ঘমেয়াদি রূপচিত্রের বড় একটা সুযোগই ছিল না। মানুষকে তখন জীবিকার প্রয়োজনেই অন্যদের সঙ্গে কাটাতে হত দীর্ঘ ক্ষণ। সে কী করে অনুভব করবে একাকিত্বকে? আবার এমন হতেই পারে, বহু আগেও একাকিত্ব ছিল পুরোদমে, কিন্তু ছিল তার প্রকাশ-ভঙ্গির অভাব। ইংরেজি সাহিত্যেও ‘একাকিত্ব’ কিন্তু খুব একটা আসেনি ১৮০০-র আগে। হ্যামলেট হয়তো অন্যতম ব্যতিক্রম, সেখানে ওফেলিয়া ভুগেছে একাকিত্বে।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবার্ট পাটনাম ১৯৯৫-এ একটা প্রবন্ধ লেখেন, শিরোনাম ‘বোলিং অ্যালোন’। পাঁচ বছর পরে একই শিরোনামে একটা বইও লেখেন তিনি। পুটনাম বর্ণনা দিয়েছেন দীর্ঘ দিন ধরে দানা বেঁধে ওঠা একাকিত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মহামারির রূপরেখার। প্রচুর তথ্য-সহযোগে দেখিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানগত, প্রযুক্তিগত এবং সামাজিক পরিবর্তন কী ভাবে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিক থেকে নড়বড়ে করে দিয়েছে আমেরিকার সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামোগুলোকে, মানুষজনকে করেছে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন সামাজিক কাজকর্ম, আর সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তিগত পদ্ধতির মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়ানোর।

একাকিত্বকে অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে ২০১৬ সালে ব্রিটেনে তৈরি হল ‘জো কক্স কমিশন অন লোনলিনেস’। কমিশনের রিপোর্ট জমা পড়ে ২০১৭-র শেষে। ২০১৮-র প্রথম দিকে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ‘একাকিত্ব’ দফতরের মন্ত্রী নিয়োগ করলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজ়া মে। তার পর পাঁচ বছর কেটেছে— ব্রিটিশ জনতা কি একটু কম ‘একাকী’? এর বিচার অবশ্য সাংঘাতিক কঠিন— মাঝখানের অতিমারি সামাজিক হিসাবনিকাশের মানদণ্ডকেও ঘেঁটে দিয়েছে। তবে ইতিমধ্যে একাকিত্ব দফতরের মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছে জাপানেও— কোভিডকালে সে দেশের আত্মহত্যার হার ১১ বছরের মধ্যে প্রথম বার বেড়ে যাওয়ার অভিঘাতে।

এই ক্রমবর্ধমান একাকিত্বের প্রধান চালিকাশক্তি কী? অনেকেই মনে করেন, প্রযুক্তি। এমআইটি-র অধ্যাপক শেরি টার্কল যেমন তাঁর ২০১১ সালের বই অ্যালোন টুগেদার: হোয়াই উই এক্সপেক্ট মোর ফ্রম টেকনোলজি অ্যান্ড লেস ফ্রম ইচ আদার-এ বর্ণনা দিয়েছেন, কী ভাবে প্রযুক্তি প্রভাব ফেলছে আমাদের সত্তা এবং সামাজিক জীবনযাত্রা, দুইয়ের উপরেই। টার্কল বলছেন, প্রযুক্তির উপর আমাদের নিরন্তর নির্ভরতা এবং ডিজিটাল দুনিয়ার আবর্ত আমাদের ঠেলে দিচ্ছে গভীর একাকিত্বের মধ্যে। প্রবল ভাবে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে জীবনের আবেগঘন অংশটুকু।

এই বই লেখার পরেও কেটে গিয়েছে এক যুগ। আমাদের ডিজিটাল নির্ভরতা বেড়েছে আরও। তার খানিকটা শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম অতিমারির ফলেও। আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও তার অস্থির ডানা ঝাপটাচ্ছে মানুষের জীবনে। কিন্তু প্রযুক্তি তো সমৃদ্ধতরই হতে থাকবে। প্রযুক্তির ম্যাজিকে ‘একাকী’ আবিষ্ট হয়ে থাকা, এবং পরিণতিতে এই ক্রমবর্ধমান একাকিত্বের চোরাবালিতে ডুবে যাওয়াই কি তা হলে মানুষের ভবিতব্য? মনে করিয়ে দেওয়া ভাল, আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড রিসম্যান-এর দ্য লোনলি ক্রাউড ছাপা হয় ১৯৫০’এ— সে সময়ই আমেরিকার ৯% বাড়িতে বাস করেন মাত্র এক জন করে মানুষ। ১৯৫৯-এর মধ্যেই মনোবিদ্যা তার পরিধির মধ্যে খুঁজে পায় ‘একাকিত্ব’কে। সবই আজকের প্রযুক্তিনিবিড় যুগের বহু আগের ঘটনা।

অ্যালবার্টির মতে, আধুনিক কালের এই ‘একাকিত্ব’ ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে বিকশিত হতে থাকা সামাজিক বিভাগ এবং শ্রেণিবিন্যাসের ফল— নিজের সঙ্গে দুনিয়ার, ব্যক্তির সঙ্গে সম্প্রদায়ের, রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির বিভাজনের। রাজনীতি এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক দর্শনের হাত ধরেই। মোটামুটি এই সময় থেকেই ‘একাকিত্ব’র ধারণাটা শিকড় গাড়তে শুরু করে সমাজে, সাহিত্যে। এ কি পুরোটাই কাকতালীয়? হয়তো বা বাজার অর্থনীতির হাত ধরেই জাগরূক হয়েছে ‘প্রাইভেসি’, আর ‘প্রাইভেসি’ই বোধ করি ‘একাকিত্ব’র এক প্রধান চালিকাশক্তি।

তবু কোনও একটা কিছু দিয়েই ‘একাকিত্ব’কে ব্যাখ্যার চেষ্টা আসলে অতি-সরলীকরণ। বাস্তবে বহু জনের মাঝে থেকেও হয়তো আমরা একাকী। সুদূর অতীতে মানুষ যে দিন যূথবদ্ধ হল, সেটা ছিল নিতান্তই জীবন-সংগ্রামের তাড়নায়। এই যূথবদ্ধতা মানুষের বহিরঙ্গ। একাকিত্ব মানুষের অন্দরে অন্তরে। তার অনুরণন সঞ্চারিত হয় আমাদের শিরায়-উপশিরায়। কখনও অনেকের সঙ্গে বসে হইচই করতে করতেও আমরা থেকে যাই ‘একাকী’। ভীষণ রকমের ‘একাকী’। এই একাকিত্ব, কিংবা একাকিত্বের এই ‘বোধ’কে নির্মূল করা হয়তো অসম্ভব। আবার, ‘একা’ মানেই ‘একাকী’ নয়। রবিনসন ক্রুসো ‘একা’ ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু ‘একাকী’ ছিল না।

আরও পড়ুন
Advertisement