Gender Discrimination

বৈষম্য থেকে মুক্তির পাঠ

২০১৪ সালের ‘নালসা রায়’-এ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অভিমত প্রকাশ করেছিল যে, যে-কোনও ভারতীয় নাগরিক নিজের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারবেন, এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই।

Advertisement
ভাস্কর মজুমদার
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৩ ০৬:১৩

—প্রতীকী ছবি।

জনাই ট্রেনিং হাই স্কুলের ছাত্রী স্মরণ্যা ঘোষ উচ্চ মাধ্যমিকে সপ্তম স্থান অধিকার করেছে। খবরের কাগজে, চ্যানেলে অন্য কৃতীদের পাশাপাশি তাকে নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হচ্ছে। সেই আলোচনা যত না পড়াশোনা বিষয়ক তার চেয়ে বেশি তার লিঙ্গ-পরিচয় ঘিরে। কারণ, শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন, সমগ্র ভারতেই উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির কোনও পরীক্ষার মেধা তালিকায় কোনও রূপান্তরকামী এমন ভাবে জায়গা করে নিয়েছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। স্মরণ্যার আগের পরিচয় ছিল স্মরণ্য, লিঙ্গ-পরিচয়ে পুরুষ।

২০১৪ সালের ‘নালসা রায়’-এ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অভিমত প্রকাশ করেছিল যে, যে-কোনও ভারতীয় নাগরিক নিজের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারবেন, এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনও হস্তক্ষেপ ছাড়াই। এক ব্যক্তি যে লিঙ্গ-পরিচয়ে জীবন অতিবাহিত করতে চাইবেন, সেই পরিচয়েই বাঁচতে পারবেন। কিন্তু বিজেপি-শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার যখন ২০১৯ সালে রূপান্তরকামীদের জন্য আইন (ট্রান্সজেন্ডার অ্যাক্ট) প্রণয়ন করল, তখন লিঙ্গ-পরিচয়ের ব্যাপারে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব করে কেবলমাত্র চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যে রূপান্তরিত ব্যক্তিদেরই ‘সঠিক’ রূপান্তরকামীর তকমা দিতে চাইল। সুপ্রিম কোর্টের আরও যে-সব পরামর্শ ছিল— যেমন রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য সংরক্ষণ তৈরি করা বা বাড়ানো, তাঁদের উপার্জনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, সামাজিক হেনস্থার বিরুদ্ধে আইনের সুরক্ষা গড়ে তোলা— সরকার সেগুলির কিছুই পালন করেনি। শুধু তা-ই নয়, রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রীরা যাতে স্কুলের ছেলেমেয়েদের থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে পারে, তার জন্য কয়েক বছর আগে এনসিইআরটি শিক্ষকদের জন্য একটি প্রণালী-পুস্তিকা তৈরি করেছিল। বাস্তবে তা আজও প্রয়োগ হয়নি।

Advertisement

স্মরণ্যা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে যে, তার অভিভাবক ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাকে প্রভূত সাহায্য করেছে পড়াশোনায়, এবং দু’এক বছর আগে শুরু হওয়া তার লিঙ্গান্তর প্রক্রিয়ায়। অতএব ধরে নেওয়া যায় যে, স্মরণ্যার অভিভাবক ও শিক্ষকদের সংবেদনশীলতার পাঠ রয়েছে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রী নানা ভাবে লাঞ্ছিত হয় তার পরিবারে এবং বিদ্যালয়েই। কেউ পরিবারেই গার্হস্থ হিংসার শিকার হয় এবং বাধ্য হয় পরিজনদের থেকে দূরে যেতে। অর্থনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে তারা তখন বেছে নেয় ভিক্ষাবৃত্তি অথবা যৌনকর্ম। শিক্ষার সুযোগ তেমন পায় না। যারা তা পেয়ে থাকে, তাদের কাছে আবার স্কুলে পড়াশোনা করে এগিয়ে যাওয়ার যাত্রাপথ হয়ে ওঠে বিভীষিকাময় এক অভিজ্ঞতা।

অথচ, যে-কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রত্যেক বিদ্যার্থীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে, এমনই প্রত্যাশিত। ভারতের সংবিধান চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিটি শিশু-কিশোরের ‘বাধ্যতামূলক শিক্ষা’-র অধিকারে সিলমোহর দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি পড়ুয়াও যেন বাদ না পড়ে, ধর্ম, বর্ণ, অর্থনৈতিক অবস্থান ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলে সমান সুযোগ-সুবিধা পায়, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছে। বাস্তবে তার কতটুকু হয়? ভারতের বহু রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রী চার পাশ থেকে গঞ্জনা, উপহাস, নির্যাতনের জন্য মাঝ-পথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তথাকথিত মূলধারার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই স্কুলছুটের সংখ্যা বিপুল, তা কমার লক্ষণ নেই। আর রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে স্কুলশিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকার হার আরও ভয়াবহ। এ দেশে রূপান্তরকামী নারীদের মধ্যে যে-হেতু হিজড়া-পেশা চালু আছে তাই অনেকে ধরেই নেন যে, রূপান্তরকামী হলেই যে কোনও মানুষের ভবিতব্য ওই পেশা, আর না হলে ভিক্ষাবৃত্তি। মূলস্রোতের পড়াশোনা, শিক্ষা তাদের জন্য নয়। আইন সুরক্ষা দেওয়ার কথা বললেও, বাস্তব জীবন তাই ছাত্রছাত্রীদের কাছে হয়ে পড়ে সমস্যাসঙ্কুল।

খোঁজ নিতে হবে স্মরণ্যার মতো ছাত্রছাত্রীরা নিজস্ব লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্যে বিদ্যালয়ে সহপাঠী, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক বা অন্য কারও হাতে হেনস্থার শিকার হচ্ছে কি না। এক জন রূপান্তরকামী ছাত্র বা ছাত্রীর নিশ্চিন্তে, সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার পথে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তার পোশাক নির্বাচন ও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ‘টয়লেট’। সেগুলি পাওয়ার অধিকার থেকে যেন সে বঞ্চিত না হয়ে পড়ে। দরকার হলে প্রত্যেক বিদ্যালয়ে পোশাকও হতে হবে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ। স্মরণ্যার বিদ্যালয়ের প্রধান জানিয়েছেন একাদশে উঠে সে ‘মেয়েদের সঙ্গে বসত’। অর্থাৎ, সহশিক্ষা (কো-এডুকেশন)-র বিদ্যালয়গুলিতেও ছেলেদের-মেয়েদের ‘আলাদা’ বসার রীতি আছে!

স্মরণ্যার সত্যভাষণ ও সাহস আগামী দিনের রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রীদের এগিয়ে চলার পথকে খানিক মসৃণ করবে। এমন নয় যে, পড়াশোনায় ভাল হওয়াই সব রূপান্তরকামী ছাত্রছাত্রীর জীবনে একমাত্র লক্ষ্য হওয়া দরকার, মেধা-তালিকাতে জায়গা করে নিতে পারলে তবেই সে সম্মানের যোগ্য হবে। নম্বর যেমনই হোক, প্রতিটি পড়ুয়া মানুষ হিসাবে সম্মানের যোগ্য। তার পারিবারিক, সামাজিক পরিচয়, বা স্বনির্বাচিত পরিচিতি যেন বিদ্যালয়ে সবার সঙ্গে তার অন্তর্ভুক্তির অন্তরায় না হয়, বিভাজন তৈরি না হয়, সে দিকে বিশেষ ভাবে লক্ষ রাখতে হবে। এমন শিক্ষাই এক সুস্থ, বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

আরও পড়ুন
Advertisement