জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত বৃদ্ধির হিসাবে গোড়ায় গলদ
Population

মেরুকরণের অস্ত্র

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ছবিটি কী রকম? ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২০.৭% ও ৩২.৭%।

Advertisement
শাশ্বত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৪ ০৮:০১

—প্রতীকী ছবি।

ভেবেছিলাম, আগামী জনশুমারির প্রাথমিক রিপোর্ট না বেরোনো (জনশুমারি কবে হবে, তার রিপোর্ট প্রকাশিত কবে হবে, তা এখনও অজানা) পর্যন্ত ধর্মীয় জনসংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ে কিছু লিখব না— গত কয়েক বছরে অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু, চুপ করে থাকা গেল না! প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য শমিকা রবির তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের শতকরা অনুপাত বিষয়ে সদ্যপ্রকাশিত একটি ওয়ার্কিং পেপারের ফলাফলে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, বিশেষত মুসলমানদের জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাকে যেমন বিভ্রান্তিমূলক ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে; তার পর, সেটাকে চটজলদি যে ভাবে সমাজমাধ্যমে, বিশেষত হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন, তা অতি বিপজ্জনক। কাজেই, কিছু পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে হচ্ছে।

Advertisement

এই ওয়ার্কিং পেপারে উল্লেখ করা হয়েছে: “ভারতের জনসংখ্যায় ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে হিন্দুদের অংশ ৭.৮২% কমেছে, যেখানে মুসলমানদের অংশ ৪৩.১৫% বেড়েছে, যা দেখায় যে, দেশে বৈচিত্র লালনপালনের একটি অনুকূল পরিবেশ রয়েছে।” এই বিশ্লেষণের একেবারে গোড়ায় গলদ— যে-ভাবে শতকরার শতকরা ব্যবহার করা হয়েছে, তা আদৌ রাশিবিজ্ঞানসম্মত নয়। এই হিসাবটি যে ভাবে কষা হয়েছে, তা এই রকম— ১৯৫০ সালে জনসংখ্যায় যত শতাংশ হিন্দু ছিল, তার থেকে ২০১৫ সালে যত শতাংশ হিন্দু ছিল, সেই সংখ্যাটি বিয়োগ করে তাকে ১৯৫০-এর সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে গুণ করা হয়েছে। মুসলমানদের ক্ষেত্রেও তা-ই। সহজ অঙ্ক, ক্লাস সেভেন-এর পাটিগণিতে যে ভাবে শতকরা হার নির্ণয় করতে শেখায়। কিন্তু, শতাংশের শতাংশ বার করার এই পদ্ধতিটি রাশিবিজ্ঞানে গ্রাহ্য নয়। তার কারণ সহজ— যে-হেতু এই উদাহরণে ১৯৫০ সালে ভারতে হিন্দু এবং মুসলমানের মোট সংখ্যায় বিপুল ফারাক, ফলে শতাংশের হিসাবের মধ্যে ঢুকে থাকে বেস এফেক্ট। যে সংখ্যাটি তুলনায় ছোট, তার ক্ষেত্রে ছোট পরিবর্তনও শতাংশের হিসাবে বড় মনে হতে থাকে। শতাংশের শতাংশ ব্যবহার করা যায় বটে, কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম আছে— যেমন, অন্তত তিনটি সময়কালের মধ্যে তুলনা করতে হবে। শমিকা রবি সেই পথে হাঁটেননি।

এ ক্ষেত্রে তুলনা করার রাশিবিজ্ঞান-সম্মত পন্থা হল শতাংশ-বিন্দু যাচাই করা। সে হিসাবে আসছি, কিন্তু তার আগে সংখ্যাগুলো দেখে নেওয়া যাক। ১৯৫০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ভারতে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৩২ কোটি থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটির একটু উপরে, অর্থাৎ এই সময়কালে হিন্দুদের জনসংখ্যা তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। একই সময়কালে মুসলমানদের সংখ্যা ৩.৭ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৮ কোটির মতো, প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি। ১৯৫০ সালে ভারতের মোট জনসংখ্যায় হিন্দুদের অনুপাত ছিল ৮৫%; ২০১৫ সালে তা প্রায় ৭৮%। অন্য দিকে, জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত ১৯৫০ সালে ১০% থেকে বেড়ে ২০১৫ সালে দাঁড়িয়েছে ১৪%। অর্থাৎ, আলোচ্য সময়কালে ভারতের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অংশ ৪.২ শতাংশ-বিন্দু বেড়েছে, হিন্দুদের অংশ কমেছে ৬.৬ শতাংশ-বিন্দু। দেশের অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে, খ্রিস্টান এবং শিখ জনসংখ্যাও হিন্দু জনসংখ্যার তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। খ্রিস্টান, শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধ-সহ ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ২০১৫ সালে মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশেরও বেশি, যেটা ১৯৫০ সালে ছিল ৪.৫ শতাংশের চেয়ে কিছুটা বেশি। খেয়াল করার, মোট জনসংখ্যায় আপেক্ষিক অনুপাত বাড়া-কমার পরেও ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের সাড়ে পাঁচ গুণ। অন্তত পরিসংখ্যানগত দিক থেকে ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ বলার উপায়মাত্র নেই।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ছবিটি কী রকম? ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২০.৭% ও ৩২.৭%। ১৯৮১ থেকে ১৯৯১-এর মধ্যে এই দুই সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে হারটি বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২২.৭% ও ৩২.৯%। ১৯৯১-পরবর্তী সময়কালে এই দুই সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। ১৯৯১ থেকে ২০০১-এর মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে হয় যথাক্রমে ১৯.৯% ও ২৯.৪%। তার পরের দশকে এই বৃদ্ধির হার আরও কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৬.৭% এবং ২৪.৭%। ১৯৮১-১৯৯১ এবং ১৯৯১-২০০১, এই দুই দশকের মধ্যে হিন্দুদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে ২.৮ শতাংশ-বিন্দু, মুসলমানদের কমেছে ৩.৫ শতাংশ-বিন্দু। ১৯৯১-২০০১ এবং ২০০১-২০১১’এর মধ্যে হিন্দুদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমেছে ৩.২ শতাংশ-বিন্দু, মুসলমানদের ক্ষেত্রে ৪.৭ শতাংশ-বিন্দু।

জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে লিখেছিলাম যে (‘সত্য তথ্য বনাম অন্ধ বিশ্বাস’, ১১/১/২০২৩, আবাপ, পৃ.৪), ১৯৯২-৯৩ থেকে ২০১৯-২১ পর্যন্ত ভারতে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার (মহিলাপিছু বাচ্চার সংখ্যা) হ্রাস পেয়েছে ৪৬.৫%, যেটা হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৪১.২%। ১৯৯২ সালে এক জন হিন্দু মহিলার চেয়ে এক জন মুসলমান মহিলার গড়ে সন্তানসংখ্যা ১.১১ জন বেশি ছিল, ২০১৯ সালে তা কমে ০.৪২ হয়েছে।

জন্মহার কমা বা বাড়ার জন্য কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম দায়ী নয়— বিভিন্ন মানবোন্নয়ন সূচক, যেমন শিশুমৃত্যুর হার, শিক্ষা, বিশেষত নারীশিক্ষা, নারীদের ক্ষমতায়ন, গর্ভনিরোধক পদ্ধতির জ্ঞান ও তার ব্যবহার, স্থানীয় স্তরে উন্নয়নমূলক পরিষেবা প্রদান— এগুলো দায়ী। এ ছাড়া গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে সব জেলায় মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার বেশি, সেখানে হিন্দুদের মধ্যেও জন্মহার বেশি; আর যে জেলাতে হিন্দুদের মধ্যে জন্মহার কম, সেখানে মুসলমানদের মধ্যেও জন্মহার কম। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু তা সংখ্যায় নগণ্য। শুধু ইসলাম ধর্ম জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী হলে বাংলাদেশ, ইরান, ইন্দোনেশিয়ায় জন্মহার এ ভাবে কমে যেত না। পাকিস্তানে যে জন্মহার কমেনি তার কারণ অনেক, এ লেখায় সেই প্রসঙ্গে ঢুকব না।

জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য সমীক্ষার পাঁচটি রাউন্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সব ধর্মের মধ্যেই জন্মহারের অভিন্নতার অভিমুখ সুস্পষ্ট। ব্যতিক্রম শুধু বিহার। সে রাজ্যে ২০১১ সালে মুসলমানদের মহিলাপিছু বাচ্চা হিন্দু মহিলাদের চেয়ে ০.৪০ বেশি ছিল, সেটা ২০১৯-এ বেড়ে ০.৭৫ হয়েছে। কেন, তা বোঝার জন্য বিশদ অনুসন্ধান প্রয়োজন। তবে জন্মহার এক বার কমার প্রক্রিয়া শুরু হলে সেটা যে সাধারণত একমুখী হয়, এমনকি কোনও সরকারি প্রণোদনাও তার অভিমুখ সহজে পরিবর্তন করতে পারে না, সেটা চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান-সহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর জন্মহার দেখলে সহজে বোঝা যায়।

শমিকা রবি অর্থশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষিত। তিনি রাশিবিজ্ঞানসম্মত নিয়মাবলি জানেন না, সেটা মনে করাও বাতুলতা। তিনি যে পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করেছেন, তা অনুসরণ করলে দেখা যায়, ভারতে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্মীয় জনসংখ্যা বৌদ্ধ— ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতে বৌদ্ধ জনসংখ্যা বেড়েছে ১৬০০%! এই হিসাব কতখানি অর্থহীন, তার আর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়োজন নেই। অনুমান করা চলে, তাঁর এই হিসাবপদ্ধতি পরিকল্পিত ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। উনি কেন্দ্রের শাসক দলকে ধর্মীয় মেরুকরণের আরও একটি অস্ত্র উপহার দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় শাসকদের রাজনীতি বিপজ্জনক; তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত গবেষকরা সেই রাজনীতির অস্ত্রের জোগানদার হয়ে উঠলে তা
ক্ষমার অযোগ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement