Houston Central Library

আমার গৃহহীন সহপাঠীরা

আপাতদৃষ্টিতে কাউকে তেমন বিপজ্জনক মনে হল না, তবে নিজেদের মধ্যে তর্ক বাধলে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, অপশব্দের ব্যবহারও করেন।

Advertisement
শ্রাবণী রায় আকিলা
শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৪ ০৫:৫৩
Houston Central Library

—প্রতীকী ছবি।

সপ্তাহ দুয়েক টেক্সাসের হিউস্টন সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়ে দেখি, লাইব্রেরিটি বিশাল, পানীয় জল, বাথরুম, ফ্রি ইন্টারনেট, ওয়াইফাই থেকে সব সুবিধাই আছে। লাইব্রেরি কার্ড টেক্সাসের বাসিন্দাদের জন্য ফ্রি। টেবিলে রোজ সকালের খবরের কাগজ, হেডফোন-সহ বড় বড় স্ক্রিনের কম্পিউটার মজুত। শিশু থেকে বয়স্ক, সকলের জন্য ভাষাশিক্ষা, কলেজ বা চাকরির আবেদনপত্র লিখতে শেখানো, এমন নানা পরিষেবা রয়েছে।

Advertisement

প্রথম দু’এক দিন কাজ করেছি, আশপাশের সব টেবিলে কারা চুপচাপ বই পড়ছেন, কাজ করছেন, আলাদা করে খেয়াল করিনি। তার পরে এক দিন খেয়াল করলাম, প্রায় প্রত্যেকের পাশে রাখা রয়েছে বড়সড় ব্যাগ, সুটকেস। পোশাকের তেমন ছিরিছাঁদ নেই, এক পলক দেখলে অপরিচ্ছন্ন মনে হয়। অচিরে জানলাম, এঁরা ডাউনটাউনের আশপাশের পথবাসী, গৃহহীন মানুষ।

আমেরিকার যে কোনও বড় শহরের ‘ডাউনটাউন’ বা অফিস এলাকাগুলোতেই গৃহহীনদের ভিড় বেশি। হিউস্টনও ব্যতিক্রম নয়। তাঁদের সাধারণত দূর থেকে দেখা যায়, গাড়ির জানলার কাচ দিয়ে, বা টিভিতে। নানা ধারণাও জন্মায় মনে, যেগুলি খুব স্বস্তির নয়। এ বার কাছ থেকে দেখলাম এই মানুষগুলিকে। কেউ তাক থেকে বই তুলে দেখছেন, কেউ এক মনে বই পড়ছেন, কেউ কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে কানে হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউবে সিনেমা বা বক্সিং দেখছেন, খবর শুনছেন। অনেকে সরকারি অনুদান পাওয়ার আশায় লাইব্রেরি কর্মীর সাহায্য নিয়ে অনলাইনে ফর্ম ফিল আপ করছেন। এক জন এক মনে খাতায় স্কেচ করছেন, এক জন স্প্যানিশ শেখার চেষ্টা করছেন। ফোন প্রায় সবার আছে, কিন্তু ফোনের স্ক্রিনের চাইতে কম্পিউটারে, নয় বইতে মুখ গুঁজে থাকেন বেশি। খবরের কাগজ বিশেষ জনপ্রিয়। কাড়াকাড়ি করে পড়ছেন ‘হিউস্টন ক্রনিকল’।

আপাতদৃষ্টিতে কাউকে তেমন বিপজ্জনক মনে হল না, তবে নিজেদের মধ্যে তর্ক বাধলে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, অপশব্দের ব্যবহারও করেন। তেমন পরিস্থিতি হলে মুহূর্তে ছুটে আসেন লাইব্রেরির কর্মী, নিরাপত্তা কর্মীরা। লাইব্রেরির বিশাল চত্বরে নিরাপত্তা রক্ষীদের যথেষ্ট উপস্থিতি চোখে পড়ে, প্রতি দিন পাশের থানা থেকে দু’জন সশস্ত্র পুলিশ অফিসার এক বার করে চক্করও দিয়ে যান।

তবে যা অবাক করে, তা হল এই গৃহহীনদের সঙ্গে লাইব্রেরি কর্মীদের সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার। তাঁরা লাইব্রেরিতে ঢোকামাত্র রিসেপশনে বসা ভদ্রমহিলাটি অন্যদের মতো তাঁদেরও স্বাগত জানাচ্ছেন। ঝাঁ চকচকে পরিবেশেও অপরিচ্ছন্ন মানুষজনের ঘোরাফেরায় কোনও নিষেধ নেই, লাইব্রেরির কর্মী বা লাইব্রেরির আর পাঁচ জন সদস্যের মধ্যে কোনও নাক সিঁটকোনো ভাব, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা নেই। যে যাঁর মতো কাজ করছেন। এটাই লাইব্রেরির স্বাভাবিক পরিবেশ। এক লাইব্রেরি কর্মী জানালেন, লাইব্রেরি কার্ড থাকুক বা না থাকুক লাইব্রেরিতে প্রবেশ সকলের জন্য অবাধ। রাজ্যের নাগরিক গৃহহীন, অপরিচ্ছন্ন, যা-ই হোন না কেন, এ লাইব্রেরিতে সকলের সমান অধিকার।

এ তো গেল অধিকারের দিক। গৃহহীন মানুষদের স্বাগত জানানোয় একটি স্বার্থের দিকও রয়েছে। লাইব্রেরির মূল ফটকে একটি মেশিন হিসাব রাখে, দিনে কত জন লাইব্রেরিতে ঢুকছেন। পাবলিক স্কুলে যেমন ছাত্রের উপস্থিতির উপরে সরকারি অনুদান নির্ভর করে, এ ক্ষেত্রেও তাই। যত মানুষ লাইব্রেরিতে আসবেন, তত সরকারি অনুদান বহাল থাকবে, বা বাড়বে। সে বিষয়ে লাইব্রেরিকে সাহায্য করছে গৃহহীন মানুষদের নিত্য আনাগোনা।

এক পুলিশ অফিসার জানালেন, দিনের বেলা রাস্তার জীবনের সম্ভাব্য নানা বিপদ, অশান্তি, মাদক থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এক আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে এই লাইব্রেরি। তার জন্য লাইব্রেরির সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং প্রশাসনের নজরদারি আছে। কিন্তু বাধা দেওয়ার মানসিকতা নেই। এঁরা অনেকেই মাদকাসক্ত, মানসিক স্বাস্থ্যে সমস্যা আছে। এঁদের সম্পূর্ণ পুনর্বাসন হয়তো সহজ নয়। কিন্তু অপরাধ-প্রবণতা, আত্মহত্যা থেকে সরিয়ে রাখার একটা সার্বিক চেষ্টা করা হয়। এই লাইব্রেরি আপনাআপনি তার অংশ হয়ে উঠেছে।

এ ভাবেই এঁরা অনেকে মাসের পর মাস এসে নিজেদের পছন্দের বিষয়ে বই পড়ে অনেক কিছু শিখেছেন, তারও আভাস পেলাম। এক জনকে ক্লিয়োপেট্রার এক জাবদা বই কয়েক ঘণ্টা একটানা পড়তে দেখলাম। প্রায় প্রত্যেকে কম্পিউটার ব্যবহারে সড়গড়, প্রয়োজনে লাইব্রেরি কর্মীদের ডেকে সাহায্য নেন। লাইব্রেরির কোন ধরনের বই কত তলায়, কোথায় মিলবে, এঁদের অনেকের নখদর্পণে, তা-ও ক’দিনে বুঝলাম।

এ ক’দিন হিউস্টনের পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে নিজের বিষয়ে যত না শিখলাম, তার থেকে হয়তো বেশিই জানলাম, শিখলাম আমার সহপাঠীদের দেখে। গৃহহীন, দরিদ্র, অপরিচ্ছন্ন মানুষগুলি, যাঁরা সব সম্বল নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন, তাঁরাও যে কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহারে আর পাঁচটা মানুষের মতোই সাবলীল, ইউটিউবে সিনেমা দেখতে আগ্রহী এবং দেখে তা উপভোগ করেন, তা দেখে বিস্মিত হয়েছি। এবং নিজের বিস্ময়ের বোধে কুণ্ঠিতও হয়েছি। এই মানুষগুলির অনেক অভাব, তবে আত্মবিশ্বাসের অভাব নেই। আমার বিস্ময় তাঁরা টের পাননি। পেলে হয়তো বলতেন, “...অসুন্দরের জন্যে তোমার এই অনুকম্পার অর্থ বুঝি নে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement