মমতা ও কংগ্রেসের কাছে রাজনৈতিক বাস্তবের ছবিটা আলাদা
Mamata Banerjee-Rahul Gandhi

বিশ্বাসের সঙ্কট কি মেটে

একটি বচন বহুচর্চিত। তা হল, রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প এবং ভোট এক অনিশ্চিত রসায়ন। এটা মনে রাখলে কোনও ভবিষ্যদ্বাণীই হয়তো এখানে শেষ কথা হতে পারে না।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:০৩
অ-সমদর্শী: বিরোধী বৈঠকে রাহুল গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বেঙ্গালুরু, ১৮ জুলাই।

অ-সমদর্শী: বিরোধী বৈঠকে রাহুল গান্ধী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বেঙ্গালুরু, ১৮ জুলাই। ছবি: পিটিআই।

কংগ্রেসের ভোট-ভাগ্য সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমান যদি সঠিক হয়, অর্থাৎ কংগ্রেস সারা দেশে লড়ে নিজেরা যদি ‘বড় জোর’ চল্লিশটি আসন পায়, তা হলে তথাকথিত বিরোধী জোটের ক্ষমতায় আসা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ার অবকাশ যথেষ্ট। অন্য ভাবে বললে, সে ক্ষেত্রে শাসক বিজেপি এবং তার দলবলের থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ষোলো আনা! ভোটের আগে এমন পর্যবেক্ষণ তাই শুধু তাৎপর্যপূর্ণই নয়, জোটের ঘরে গুরুতর পরিস্থিতির ইঙ্গিতও বটে।

Advertisement

একটি বচন বহুচর্চিত। তা হল, রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প এবং ভোট এক অনিশ্চিত রসায়ন। এটা মনে রাখলে কোনও ভবিষ্যদ্বাণীই হয়তো এখানে শেষ কথা হতে পারে না। তবে কিছু কিছু বিষয় থাকে যার ধাক্কা সামলাতে বেগ পেতে হয়। বিশেষত ভোটের মুখে। ‘ইন্ডিয়া’র কাছে তৃণমূল নেত্রীর বক্তব্যটি সেই গোত্রের।

দেশের শীর্ষ স্তরের কুশলী রাজনীতিকদের মধ্যে মমতা প্রথম সারির এক জন। তাঁর চরম শত্রুকেও মানতে হবে যে, তিনি সচরাচর যে সব পদক্ষেপ করেন বা যা বলেন, তার পিছনে তাঁর নিজস্ব বিবিধ হিসাবনিকাশ, সমীকরণ ইত্যাদি বিরাট ভাবে কাজ করে। যাঁরা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা এটাও মনে করেন, তিনি অনেক কিছুই অনেক আগে ভেবে রাখেন এবং সময় অনুযায়ী সেইমতো পা ফেলেন। বহু ক্ষেত্রে বিকল্প পরিকল্পনা, মানে ‘প্ল্যান বি’, ভাবা থাকে তাঁর এবং ঘটনাচক্রে এখন পর্যন্ত অধিকাংশ সময় পরিণাম তিনি নিজের অনুকূলে আনতে পেরেছেন। হতে পারে সেটা আপেক্ষিক বিচার।

আসলে বৃহত্তর রাজনীতিতে এই ধরনের বিষয়কে নিছক হারজিতের মাপকাঠিতে যাচাই করা পুরোপুরি ঠিক নয়। এখানে কখনও জিতেও হার হয়, কখনও হেরেও জিত। তাই আজ যদি কারও মুখ পোড়ে, কাল সেই মুখেই মন্ডা-মিঠাই খাওয়ার প্রত্যাশা মিটবে না, কে বলতে পারে! অতএব হাঁ করে থাকা কে আটকায়!

এই যেমন, নীতীশ কুমার। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম উদ্যোক্তা হয়েছিলেন তিনি। মূল লক্ষ্য ছিল জোটে বড় পদ দখল করবেন। যাতে জোট জিতলে কোনও ভাবে ‘দাবিদার’ হওয়া যায়। সেটা হাসিল করতে না পেরে আবার অঙ্ক কষে দ্রুত বিজেপির শরণে ফেরা। বিহারে তাঁর ভবিতব্য যা-ই হোক, দিল্লির ‘খুঁটি’ তো ধরা থাক। তাতে যদি ‘ভাগ্য’ ফেরে!

সবাই জানেন, মমতার রাজনীতি এই রকম নির্লজ্জ নয়। তিনি অনেকের ভিড়ে আলাদা ‘গুরুত্ব’ চান ঠিকই। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে পদের জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ, তা নিয়ে দর-কষাকষি বা পদ না-পেলে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রামাণ্য রেকর্ড তাঁর রয়েছে বলে মনে পড়ে না। তবে যে-হেতু তিনি কুশলী, তাই রাজনৈতিক স্বার্থে চাল বদলের অভ্যাস তাঁর আছে। সেটা প্রমাণিত। এবং আগেই বলেছি, তিনি ‘ভবিষ্যৎ’ কিছু দূর পর্যন্ত ভেবে নিয়ে পা ফেলতে চেষ্টা করেন। তবে সেটা অবশ্যই তাঁর নিজের ভাবনা অনুযায়ী।

‘ইন্ডিয়া’ জোটের উদ্যোগ যখন সে ভাবে দানা বাঁধেনি, মমতা তখন থেকেই মূলত আঞ্চলিক দলগুলির ঐক্য ও শক্তিবৃদ্ধির উপর জোর দিতেন। কংগ্রেসকে ভাবা হত অনেকটা যেন ‘অতিথি’। তাঁর তত্ত্ব ছিল, যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, তারা নিজেদের মতো লড়াই করে আসন বাড়িয়ে নিক। পরে প্রয়োজনমতো কংগ্রেস তাতে অনিবার্য ভাবেই শামিল হয়ে যাবে। সোজা কথায়, রাশ থাকুক আঞ্চলিক দলগুলির কব্জায়। এখনও এটাই তাঁর অভিমত। বলা বাহুল্য, এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিপত্য এই রকম ভাবনার নেপথ্যে একটি বড় কারণ। এ সবই আমরা জানি।

রাজনৈতিক বাস্তবতা বিচার করে পরবর্তী কালে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ছবিটিকে দৃশ্যত নমনীয় করে তোলার চেষ্টা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখানে ওই দু’দলের মধ্যে প্রথম থেকেই এমন অনেক খিঁচ রয়ে গিয়েছে, যা সহজে মেটার নয়। নির্মম সত্য হল, পঁচিশ বছর ধরে মমতা ও কংগ্রেস কেউ কাউকে মন থেকে বিশ্বাস করার জায়গায় নেই। যখন যেটুকু হয়, সবটাই উপর-উপর। বস্তুত এ কথাও ভুললে চলবে না, তৃণমূলের জন্ম হয়েছিল তীব্র কংগ্রেস-বিরোধিতার অবস্থান থেকে। রাজ্যে কংগ্রেসকে ভেঙে, কার্যত নিঃস্ব করে, মমতার হাতেই তাঁর দলের সৃষ্টি ও উত্থান। সেই জন্যই দেখা যায়, পারস্পরিক স্বার্থের অঙ্কে একাধিক বার কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে জোট তৈরি হলেও তা কখনও দীর্ঘস্থায়ী এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। অচিরে ভেঙে গিয়েছে। এখন তো তিক্ততার শিকড় এতটাই গভীরে যে, বাংলায় চৌত্রিশ বছরের বৈরী সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের ঐক্য মজবুত হচ্ছে, কিন্তু মমতার দলের সঙ্গে ঐক্যে ঘোরতর আপত্তি।

এই অবস্থায় সকলেই বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে অলৌকিক কিছু না ঘটলে রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে সম্মিলিত জোট দূর অস্ত্ ভাবা খুব ভুল হবে না। তৃণমূল নেত্রী তো তাঁর দলে ‘একলা’ চলার বাঁশি বাজিয়েই দিয়েছেন। প্রদেশ কংগ্রেসও ‘নো তৃণমূল’ সিদ্ধান্তে অনড়। শুধু তাদের হাই কম্যান্ড এখনও একটু ঢোঁক গেলার অবস্থায়। যদিও এতে আর ফল হবে বলে মনে হয় না।

তবে হলফ করে বলা যায়, মমতা কংগ্রেসকে দু’টির বদলে দশটি আসন ছাড়তে চাইলেও এই বোঝাপড়া সহজ হত না। তাতে কংগ্রেসের সঙ্কট বরং বাড়ত। কারণ, তৃণমূলের সঙ্গে গেলে কংগ্রেসের উপর চাপ থাকত সিপিএমের সঙ্গ ত্যাগ করার। আবার সিপিএম চাপ দিত, কংগ্রেস যাতে তৃণমূলের সঙ্গে না যায়। সর্বোপরি রাজ্যের কংগ্রেস মনে করে, এখানে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার রাজনীতি থেকে সহসা সরে আসা তাদের ভবিষ্যতের জন্যও ‘ঝুঁকি’র।

এই সময়ে রাজ্যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ভোট এক দিকে চলে না-যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা ও ‘সুবিধা’ সম্পর্কে মমতাও ওয়াকিবহাল। তিনি বিলক্ষণ জানেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের দল ও সরকার যে ভাবে নানা অভিযোগ ও কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে, লোকসভা ভোটে তার খানিকটা প্রভাব পড়বেই। সে ক্ষেত্রে শাসকের বিরুদ্ধ-ভোট বিজেপি এবং কংগ্রেস-সিপিএম জোটের মধ্যে যত ভাগ হয়ে যায়, শাসকের পক্ষে তত ভাল। হয়তো তাই সুচিন্তিত কৌশলে সরাসরি নিজের শর্ত ঘোষণা করে দিয়ে একা লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।

তবে আরও বড় যে প্রশ্নটি মমতা জাগিয়ে দিয়েছেন, এই মুহূর্তে সেটি ‘ইন্ডিয়া’র বিড়ম্বনা এবং বিজেপির উল্লাসের কারণ। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী জাতীয় দল কংগ্রেস যদি ৫৪৩ আসনের মধ্যে মাত্র ৪০টি পায়, তা হলে সরকার গড়ার জন্য শুধু আঞ্চলিক দলগুলিকে একত্রে কমপক্ষে ২৩২ আসন জিততেই হবে। কোথা থেকে, কী ভাবে আসবে? এখনও তৃণমূল নেত্রী তা স্পষ্ট করেননি।

কিন্তু রাজ্যে কংগ্রেস ও সিপিএম যে “মুসলিমদের সুড়সুড়ি দিচ্ছে, আর বিজেপি হিন্দুদের সুড়সুড়ি দিচ্ছে”, সেই সব উদ্বেগ মমতার কথায় গোপন নেই। হিন্দু-ভোটে বিজেপির দখলদারি ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে দিশাহারা করে তুলেছিল। তখন মুসলিম ভোট ছিল তৃণমূলের ‘সহায়’। ২০২১-এর বিধানসভা ভোট থেকেই অবশ্য তৃণমূল ‘শোধ’ তুলে নিচ্ছে! তবে অযোধ্যা-পরবর্তী অধ্যায়ে অভিজ্ঞ রাজনীতিক মমতার ‘হিন্দু-ভোট’ মন্তব্যের অন্তর্নিহিত বার্তাটি অর্থপূর্ণ।

এরই সমান্তরালে আবার কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটে কিঞ্চিৎ ভাগাভাগি হলেও তৃণমূলের চাপবৃদ্ধি। তাই কংগ্রেসকে গোড়া থেকেই যৎপরোনাস্তি ‘তুচ্ছ’ প্রতিপন্ন করে তাদের ‘গুরুত্ব’ কমানোও এখন মমতার পরিকল্পিত পদক্ষেপ। তাঁর তীক্ষ্ণ কটাক্ষ এবং তীব্র সমালোচনার নিশানায় খোদ রাহুল গান্ধী। মনে হয়, এটা বাড়বে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement