Doctors

হারিয়ে যাচ্ছে ‘ডাক্তারি চোখ’

বিজ্ঞানের এক চলমান শাখা চিকিৎসাবিজ্ঞান, যেখানে একের পর এক রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা এসেছে, এখনও আসছে। প্রযুক্তির উন্নতি নানা আধুনিক, যন্ত্রনির্ভর পরীক্ষা নিয়ে এসেছে ডাক্তারদের মুঠোয়।

Advertisement
শ্যামল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৪১
doctor.

নতুন প্রজন্মের ডাক্তারদের একাংশের কাছে প্রযুক্তি ‘ডাক্তারি চোখ’-এর বিকল্প হয়ে উঠেছে। ফাইল চিত্র।

রোগী শুয়ে আছেন, ডাক্তারবাবু মানুষটিকে দেখছেন। রোগীর মুখ দেখে মানসিক অবস্থা বুঝছেন, হাত দিয়ে রোগীকে স্পর্শ করছেন, নিচ্ছেন গন্ধ। নাড়ি টিপে, পেট, বুক, গলা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করে রোগটাকে ধরে ফেলতে চাইছেন। ভারতীয় যুক্তিবাদী চিকিৎসাবিজ্ঞানের জন্মকাল থেকে প্রবল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে চিকিৎসকের এই পর্যবেক্ষণের দক্ষতাকে। ভারতীয় বিজ্ঞানভিত্তিক উপশমবিদ্যা চিরকাল ভরসা রেখেছে এমন প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর। ভারতের আধুনিক নিরাময়ব্যবস্থা যে চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর নির্ভর করে রয়েছে, সেই পশ্চিমের চিকিৎসাতেও বহু কাল ধরে রোগনির্ণয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণক্ষমতা, বা ‘ক্লিনিক্যাল আই’-কে।

বিজ্ঞানের এক চলমান শাখা চিকিৎসাবিজ্ঞান, যেখানে একের পর এক রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা এসেছে, এখনও আসছে। প্রযুক্তির উন্নতি নানা আধুনিক, যন্ত্রনির্ভর পরীক্ষা নিয়ে এসেছে ডাক্তারদের মুঠোয়। জটিল রোগ গোড়াতেই ধরে ফেলতে, ভোগান্তি কমাতে এই পরীক্ষাগুলো কাজে লাগে। এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সমস্যা দেখা দেয় যখন এ সব পরীক্ষার উপর অতিমাত্রায় নির্ভর হয়ে পড়েন চিকিৎসকেরা। বিশেষত নতুন প্রজন্মের ডাক্তারদের একাংশের কাছে প্রযুক্তি ‘ডাক্তারি চোখ’-এর বিকল্প হয়ে উঠেছে। অনেকে কেবলমাত্র ল্যাবরেটরির পরীক্ষার উপরে নির্ভর করে রোগ নির্ণয় করার মধ্যে কোনও সমস্যা দেখছেন না।

Advertisement

তাতে প্রথম সমস্যা অবশ্যই খরচের। রোগনির্ণয়ের বেশির ভাগটাই পরীক্ষা বা প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। কোন রোগ হয়ে থাকতে পারে, সে বিষয়ে ‘ডাক্তারি জ্ঞানচক্ষু’ বা ‘ক্লিনিক্যাল নলেজ’ প্রাথমিক ধারণা তৈরি করছে না বলে একের পর এক পরীক্ষার দিকে ঠেলে দেন চিকিৎসকরা। সাধ্যাতিরিক্ত খরচ হয় রোগীর। পাশ্চাত্যের দেশগুলির অভিজ্ঞতা বলে, অস্ত্রোপচারের আগে করানো পরীক্ষাগুলির অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়, চিকিৎসায় কোনও কাজে লাগে না। এতে রোগীর চাপ ও হাসপাতালের খরচ বাড়ে, ভারাক্রান্ত হয় ল্যাবরেটরিগুলো। যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো এর জন্য দায়ী, সেগুলো নিয়ে চর্চা বিশেষ হয় না। বরং ডাক্তারদের দুর্নীতি নিয়ে মুখরোচক আড্ডা চলে। চিকিৎসকরা তাতে বিরক্ত হন, কিন্তু তাঁরা কি ভেবে দেখেন যে, কেন ক্রমাগত আলগা হয়ে আসছে সহজ উপশমপদ্ধতির ভিত? কেন দরিদ্র রোগীর চিকিৎসা দিন দিন দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে?

কয়েক দশক আগেও ডাক্তারি স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করতে গেলে ‘ক্লিনিক্যাল আই’-এর পরীক্ষা দিতে হত। বই পড়ে শেখা জ্ঞান যাচাই করার পাশাপাশি ডাক্তারি চোখ কতটা তৈরি হল, তারও পরীক্ষা হত। কারণ, সহজে রোগনির্ণয় ও তার উপশম করার দক্ষতাও ডাক্তারের অধীত বিদ্যার সাফল্যের প্রমাণ। এখন রোগীর চোখ, জিভ, নাকের ডগা, কানের লতি, গলা, বুক, পেট, পা পরীক্ষাকে অবহেলা করেও ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রায় সবাই পাশ করে যাচ্ছেন! কিছু ব্যতিক্রমী রয়েছেন আজও, তাই ভিতটা এখনও ভেঙে পড়েনি।

স্নাতক স্তরেই ডাক্তারি চোখ তৈরির তালিম দিলে ভাল কাজ হয়, কিন্তু তার প্রশিক্ষণের পদ্ধতি এখনও অবধি সে ভাবে তৈরি হয়নি। এক-এক জন শিক্ষক নিজের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে এক-এক ভাবে শেখান। সবার প্রশিক্ষণ দেওয়ার দক্ষতা সমান হতে পারে না। তবে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, কেস রিপোর্ট, রোগীদের সঙ্গে আরও বেশি করে ছাত্রদের সংযোগ তৈরি করা, নানা রোগের সঙ্গে গভীর পরিচিতি তৈরি করা গেলে ছাত্রদের ডাক্তারি জ্ঞান বাড়ে।

ক্লিনিক্যাল আই-এর গুরুত্ব ভুলে যাওয়ার জন্য দায়ী আমাদের ইতিহাস-বিচ্ছিন্নতাও। নীলরতন সরকার, রাধাগোবিন্দ কর, সুন্দরীমোহন দাস, কেদারনাথ দাসের মতো দিকপাল চিকিৎসকরা তো বটেই, তাঁদের হাতে-গড়া ছাত্রদেরও ডাক্তারি চোখ ছিল গভীর, প্রত্যয়ী। রোগীর কথা শোনা, রোগীর শরীরে হাত দিয়ে পরীক্ষা করা, এ সব পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ‘প্রত্যক্ষ’ জ্ঞান অর্জন রোগ নির্ণয়ে তাঁদের কত অভ্রান্ত করে তুলেছিল, তার বহু কাহিনি আজও শোনা যায়। আজও বহু প্রবীণ ডাক্তার দেখেন বেশি, ওষুধ লেখেন কম।

ক্লিনিক্যাল আই অর্জন থেকে আজকের প্রজন্ম যেন বঞ্চিত না হয়। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, বা একই পরীক্ষা বার বার করানোর প্রবণতা চিকিৎসকের প্রযুক্তির উপর অতিনির্ভরতা এবং ডাক্তারি চোখের অগভীরতাকে সামনে নিয়ে আসছে। ‘শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’ হয়ে ওঠার আগেই ডাক্তারির স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পঠনপাঠনের পদ্ধতিকে ঢেলে সাজানো দরকার। রোগীর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে শেখার বেডসাইড ক্লিনিকগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি এবং শিক্ষাগ্রহণের বিষয়ে কঠোর হওয়া জরুরি।

মেডিক্যাল কলেজগুলোতে রোগীর ভিড় কমানোও দরকার। রোগীর চাপ সামলে শিক্ষকদের শেখানোর সময় হয়তো কমছে। শেষে সেই এক অমোঘ প্রশ্ন— ‘লাও তো বটে কিন্তু আনে কে!’ ভাল চিকিৎসক তৈরির জন্য এখনই কিছু করা দরকার, কিন্তু করবেটা কে?

আরও পড়ুন
Advertisement