নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে নয়, শিক্ষার স্বার্থে যোগাযোগ বাড়ান
CV Ananda Bose

মাননীয় আচার্য সমীপেষু

রাজ্যের অসংখ্য ছাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের বৃত্তির উপর নির্ভরশীল। দ্রুততা ও স্বচ্ছতার স্বার্থে কেন্দ্র এই টাকা পাঠায় সরাসরি ছাত্রদের অ্যাকাউন্টে। তাতে ফল হয়েছে উল্টো।

Advertisement
সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৩৬
CV Anand Bose.

মুখোমুখি: প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সঙ্গে কথা বললেন রাজ্যপাল। ১৩ এপ্রিল ফাইল চিত্র।

মাননীয়েষু, আপনার সদিচ্ছা ও সহৃদয়তায় বাংলার মানুষ প্রীত ও আশাবাদী। রাজ্যের অশান্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে আপনার সক্রিয় ভূমিকা আমরা দেখেছি। এই সদর্থক ভাবমূর্তিতে আশ্বস্ত হয়ে এক জন শিক্ষক ও নাগরিক হিসেবে আপনার কাছে একটি নিবেদন করছি। বিষয়, রাজ্যের উপাচার্যদের প্রতি আপনার সাম্প্রতিক নির্দেশ।

এই নির্দেশগুলি আপনি জারি করেছেন রাজ্যভর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে। এ বিষয়ে শিক্ষা দফতরের অবস্থান বা সংশ্লিষ্ট আইনকানুন নিয়ে অনধিকারচর্চা করব না। নিছক শিক্ষার নিরিখে, এবং শিক্ষাজগতের বর্তমান আবহে, এই নির্দেশাবলির কয়েকটি দিক আপনার বিবেচনার জন্য পেশ করছি।

Advertisement

এক জন দায়িত্বশীল ও সহমর্মী আচার্য নিয়মিত উপাচার্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। আপনি এই সুস্থ পন্থায় আগ্রহী, তাই উপাচার্যদের অবাধে যোগাযোগ করার উদার আহ্বান জানিয়েছেন; সে জন্য আপনাকে সাধুবাদ। তবে বিনীত নিবেদন, প্রতি সপ্তাহে রিপোর্ট দাখিলের প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার অবকাশ আছে। ধরে নিচ্ছি, কোন ক্লাসে কতটা পড়ানো হল, তার বিশদ লগবুক আপনার অভিপ্রেত নয়। ছাত্র-আন্দোলন বা রাজনৈতিক সমস্যাও (দুটো এক নয়) মূল বিবেচ্য হতে পারে না। গুরুতর বিষয় হল বৃহত্তর কর্মসূচি: পাঠ্যক্রম ও শিক্ষণরীতির সংস্কার, গবেষণার ধারা, ভবন নির্মাণ, পরিকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি। এ সব কাজের ছন্দ তেমন দ্রুত লয়ে চলে না। বৃহৎ কর্মবহুল বিশ্ববিদ্যালয়েও রিপোর্টের যথেষ্ট রসদ জড়ো হতে দু’তিন মাস লাগতে পারে। ছোট নতুন প্রতিষ্ঠানে, যেখানে লোকাভাব ও অর্থাভাব দুই-ই প্রবল, প্রায়ই সপ্তাহান্তে জানানোর মতো কিছু ঘটবে না। কোনও স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ থাকতে পারে— আলোচনাসভা, বক্তৃতা ইত্যাদি। এগুলির এমনিতেই একটা তাৎক্ষণিক আকর্ষণ আছে, আয়োজন করাও সহজ। ভয় হয়, রিপোর্ট ভরার তাগিদে কর্তৃপক্ষ এগুলিকেই গুরুত্ব দেবেন, দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা বা উন্নয়ন অবহেলিত হবে।

রিপোর্ট দাখিল নিয়ে আর এক সমস্যা আছে। তার আগে আর একটি নির্দেশ দেখা যাক: অর্থ-সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্তে আপনার অনুমোদন নেওয়া। আপনি অভিজ্ঞ প্রশাসক, আর্থিক স্বচ্ছতার স্বার্থে কী করণীয়, আপনি সম্যক বুঝবেন। এটাও তাই বুঝবেন যে, এখানে প্রোপোরশন্যালিটি বা আনুপাতিক বিচারের প্রশ্ন ওঠে। একটা সম্ভাব্য অনাচার ঠেকাতে বিশটা ভাল কাজে একটা বাড়তি বেড়া ডিঙোতে হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বালাই, কৃতী পণ্ডিত ও গবেষকরা প্রায়ই হিসাবপত্র নিয়মকানুনের ব্যাপারে ভীত বা অধৈর্য। প্রশাসনিক চাহিদার মুখে তাঁরা হতোদ্যম হয়ে পড়েন, হয়তো কাজ হাতে নিতেই অপারগ হন। তাঁদের এই দ্বিধাকে মর্যাদা দিতে আপনাকে অনুরোধ করি। দুর্নীতি ও অনাচারের সঙ্গে আপসের প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে না। এই দুই চাহিদার মধ্যে কী করে সামঞ্জস্য আনা যায়, আপনিই ভাল বুঝবেন। আপনার এক পূর্বসূরি কঠোর ভাবে সময়মতো পূর্ণ অডিট দাবি করে আস্তাবল সাফ করেছিলেন। এ বারেও সেটা উপায় হতে পারে কি?

আজ এমন আলোচনায় একটা বাড়তি উদ্বেগ থাকে, কারণ গত দশ-বারো বছরে শিক্ষকসমাজ উত্তরোত্তর বদ্ধ ও আক্রান্ত বোধ করছে— তার স্বাধীন মর্যাদা ক্ষীয়মাণ, কাজের সুযোগ ও মনোবল বিপর্যস্ত। এর জন্য কেন্দ্র-রাজ্য উভয়ের দায়ভাগ পাল্লা দিয়ে, বরং বাংলায় রাজ্য সরকারের তরফে আগে শুরু হয়েছে। বাম আমলে অশুভ কর্তৃত্ব ব্যাপক এমনকি উৎকট হলেও ছিল বহুলাংশে ‘অসাংবিধানিক’; আজ তা বিধিবদ্ধ স্বীকৃতি পেয়েছে। এর সূত্রপাত ২০১১ থেকে ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় আইনের তিনটি সংশোধনীতে। তাতে নানা উদ্ভাবনের মধ্যে আছে উপাচার্য নিয়োগের নতুন পদ্ধতি, পরেও যা পাল্টেছে দফায় দফায় (এমনকি গত সপ্তাহে)। হয়তো তার চেয়েও ক্ষতিকারক সরকারি কমিটি কর্তৃক ডিন নির্বাচন। চিনের কথা জানি না, বিশ্বের আর কোনও সফল উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এমন নিদান আছে কি? ডিন হলেন প্রশাসন আর শিক্ষককুলের প্রধান সংযোগকারী, তাঁর নির্বাচনে শিক্ষকদের সর্বত্র একটা ভূমিকা থাকে; বাংলায় গত এক দশক নেই।

তার কারণ আরও গভীরে। কেউ কি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে যে, রাজ্যের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপরোক্ত আইন মোতাবেক যে বিধি (স্ট্যাটিউট) প্রণয়নের কথা তা আজও হয়নি, বেগতিকে পুরনো স্ট্যাটিউট টেনেটুনে চালানো হচ্ছে? ন’বছর আগে আপনার পূর্বসূরি কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলেন, তাঁর উদ্যোগেও বরফ গলেনি। এর সবচেয়ে বড় ক্ষতি (এবং সম্ভাব্য উদ্দেশ্য), বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদে শিক্ষক প্রতিনিধির নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে শিক্ষকদের কণ্ঠ রুদ্ধ। তাঁদের মত ও অভিজ্ঞতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কোনও কাজেই লাগছে না, খুচরো ভাবে পালা করে কয়েক জন বিভাগীয় প্রধানকে দিয়ে নিয়মরক্ষা হচ্ছে।

অথচ কর্তৃপক্ষের যে কর্তৃত্ব বেড়েছে, তাও নয়। আক্ষরিক নিয়ম যা-ই বলুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট বা সিন্ডিকেটের সভা ডাকতে কার্যত রাজ্য সরকারের অনুমোদন লাগে। উপাচার্য দিল্লিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দফতরে গেলে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। সবচেয়ে মোক্ষম বিধান, স্বদেশি-বিদেশি যে কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে (মায় রাজ্য সরকারের অন্য বিভাগের সঙ্গে) গবেষণার চুক্তি করতে গেলে রাজ্য সরকারের ছাড়পত্র চাই, বিদেশের সঙ্গে হলে কেন্দ্রেরও। দশ-বারো বছর আগেও এমন কড়া ছিল না।

গবেষণার অনুদান রাজ্য সরকার থেকে কখনওই বড় জোটেনি। অর্থলাভ ও জ্ঞান-বিনিময়ের জন্য, সারস্বত স্বীকৃতির জন্য, দেশের ও বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিবিড় আদানপ্রদান না হলেই নয়, ওটাই সারস্বত জীবনের প্রাণ। এ ব্যাপারে রাজ্যের খতিয়ান নেহাত খারাপ নয়। ভারতের শ্রেষ্ঠ দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলার অন্তত দু’টির পাকা আসন, আরও কয়েকটি বিভিন্ন স্বীকৃতি পেয়েছে। একমাত্র যাদবপুরেই বিয়াল্লিশ জন গবেষক স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির তালিকাভুক্ত বিশ্বসেরা দুই শতাংশ বিজ্ঞানীর মধ্যে গণ্য। এমন প্রতিষ্ঠান এমন পণ্ডিতদের রসদ না দিতে পারি, স্বাধীনতা দিতে হয়, আস্থা রাখতে হয়।

আজকের আবহে যত সাধু উদ্দেশ্যেই হোক, সাপ্তাহিক রিপোর্টের নির্দেশ নিছক নিয়ন্ত্রণের একটা নতুন কৌশল বলে গণ্য হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। আরও খোলামেলা কোনও উপায়ে (যথা, উপাচার্যদের সঙ্গে নিয়মিত মিলিত হয়ে) একই উদ্দেশ্য মেটানো যায় কি? এটাও কি সম্ভব, শিক্ষক-গবেষকদের সঙ্গেও আপনার মাঝে-মধ্যে সাক্ষাৎ হল; তাঁদের কাজ দেখে এলেন, তাঁদের সমস্যার কথা সরাসরি শুনলেন?

আর একটি আবেদন রইল। কেন্দ্রীয় সরকার সম্বন্ধে এত ক্ষণ কিছু বলিনি, কারণ তা রাজ্যের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রাসঙ্গিক নয়। তবে যে-হেতু কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির দেশব্যাপী প্রসার ও প্রচার, তাদের ছায়া রাজ্যের সংস্থার উপর পড়তে বাধ্য। তার লক্ষণগুলি ইদানীং বড় শুভ নয়। সে আলোচনায় যাব না। তবে কেন্দ্র ও রাজ্যের যে সরাসরি যোগ, তার মুশকিলের আসান হয়তো একমাত্র আপনিই করতে পারেন।

একটা উদাহরণ: রাজ্যের অসংখ্য ছাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের বৃত্তির উপর নির্ভরশীল। দ্রুততা ও স্বচ্ছতার স্বার্থে কেন্দ্র এই টাকা পাঠায় সরাসরি ছাত্রদের অ্যাকাউন্টে। তাতে ফল হয়েছে উল্টো। টাকা আসে বহু বিলম্বে। গবেষণার রসদ ফুরিয়ে যায়, খাওয়াপরায় টান পড়ে। এই সমস্যার সুরাহা হলে মেধাবী ছেলেমেয়েগুলি বাঁচতে পারে।

একই সমস্যা বড় মাপে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদানে। ইউজিসির অধিকাংশ প্রকল্প বন্ধ, কেন্দ্রীয় অনুদানের কার্যত একটাই সূত্র, রাষ্ট্রীয় উচ্চতর শিক্ষা অভিযান। যাদবপুর এই প্রকল্পে একশো কোটি টাকা পেয়েছিল। অজ্ঞাত কারণে প্রথম কিস্তির পর টাকা গেল বন্ধ হয়ে। গোটা চল্লিশ প্রকল্প থমকে গেল, কাজ হারালেন শ’দুই প্রকল্পকর্মী। কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ত্রুটি বা অনাচারের অভিযোগ ওঠেনি। ‘ইনস্টিটিউট অব এক্সেলেন্স’ হিসেবে স্বীকৃতির সন্ধানে করুণ অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আপনার অজানা নয়।

অনেক কথা বলে ফেললাম; অনধিকারচর্চা হয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আপনি ভরসার সঞ্চার করেছেন যে কথাগুলো শুনবেন— মানুন না-মানুন ভেবে দেখবেন। সেটাই ঢের। শিক্ষকদের কথা কেউ শোনে না; যাবতীয় সিদ্ধান্ত চাপানো হয় উপর থেকে, বাইরে থেকে। শিক্ষকসমাজে রাজ্যপালের চেয়েও আপনার বড় পরিচয়, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। আপনাকে আমরা পেতে চাই প্রশাসক বা অভিভাবক নয়, সহমর্মী ও বন্ধু হিসেবে। নমস্কারান্তে, এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।

আরও পড়ুন
Advertisement