B. R. Ambedkar

লড়াইয়ের প্রেরণা তিনি

১৯৭০-এর দশকে মহারাষ্ট্রের দলিত প্যান্থার আন্দোলন অম্বেডকর-পরবর্তী ভারতে তাঁকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার সবচেয়ে বড় বিপ্লব। যে বিপ্লব সফল ভাবে সারা দেশে অম্বেডকর-চেতনা নিয়ে আসে।

Advertisement
মৃন্ময় প্রামাণিক
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৪:৫৮
B. R. Ambedkar.

অম্বেডকর। ফাইল চিত্র।

আমরা ঘনিষ্ঠতম অভিজ্ঞতা লাভ করি স্পর্শের মধ্যে দিয়ে। এই স্পর্শের অধিকারে বঞ্চিত, বা স্পর্শের অযোগ্য বলে কাউকে মনে করা হলে তাকে আসলে স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ ও গভীরতম ভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা অস্পৃশ্যতার নির্যাতন ভারতীয় সমাজে মানুষকে এক অভিনব দাসত্বে পরিণত করেছে। অম্বেডকর (ছবি) ভারতের দলিত সমাজকে নিজেদের দাসত্বের এই অবস্থান বোঝাতে চেয়েছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মে তাঁর ধর্মান্তরণ আসলে জাতীয়তাবাদী যুগে উচ্চবর্ণের তীব্র অনুশাসন থেকে মুক্তির একটি পথ, তার থেকে বড় ছিল উচ্চবর্ণের প্রতিষ্ঠিত হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে মুক্তি দেওয়া। অম্বেডকরের গভীর শ্রদ্ধা ছিল ধর্মের প্রতি। বৌদ্ধ ধর্মের নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি গণতন্ত্রের এক নৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।

অশোক গোপাল তাঁর সাম্প্রতিক বই আ পার্ট অ্যাপার্ট: দ্য লাইফ অ্যান্ড থট অব বি আর অম্বেডকর-এ বলেন, অম্বেডকর তাঁর মরাঠি বক্তৃতা ও লেখালিখির মধ্য দিয়ে নিজেকে এক জন গভীর নৈতিক ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেন। তিনি এক সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী, কারণ তিনি সমগ্র দেশের জন্য চিন্তিত ছিলেন। গভীর ভাবে চেয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরীণ সংস্কার, তা সম্ভব না হওয়ায় অত্যন্ত বেদনা অনুভব করেছিলেন। অম্বেডকর সম্ভবত নিজে জানতেন, বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরণ দলিতের মুক্তির একমাত্র বা সর্বোত্তম পথ হতে পারে না। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই অম্বেডকরবাদী নব্য বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যেই অপর হয়ে গেলেন।

Advertisement

অম্বেডকর সফল ভাবে ভারতের এক বৃহৎসংখ্যক মানুষের মধ্যে চেতনার জগতে বিপ্লব সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বা আর বি মোরের মতো মার্ক্সবাদীরা বহু আগেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, শ্রেণি ও বর্ণ বা জাতের সমস্যা একই সঙ্গে এবং স্বতন্ত্র ভাবে ভারতীয় সমাজে বোঝা প্রয়োজন। একটা দিয়ে অন্যটা বোঝা যায় না। বাংলার দীর্ঘ দিনের লালিত মিশ্র সংস্কৃতি, বৈষ্ণবীয় সংস্কৃতি, ইসলামি ও সুফি ভক্তিধারা, নবজাগরণ ও কমিউনিস্ট আন্দোলন যে প্রগতিবাদী চেতনার ধারা তৈরি করে, তা বাংলাকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে দলিতের সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে। কিন্তু বাংলার মধ্যযুগে ও আধুনিক যুগে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র কখনওই অবদমিত হয়নি। বৈষ্ণব ধর্মও ব্রাহ্মণ্যবাদকে পরিকল্পিত ভাবেই গ্রহণ করে। তাই একাদশ শতকের কৈবর্ত আন্দোলন থেকে শুরু করে কুর্মি প্রতিবাদ পর্যন্ত আজ অবধি বাংলায় দলিত প্রতিরোধের বয়ান প্রবহমান। উনিশ-বিশ শতকের নবজাগরণ ও ঔপনিবেশিক আধুনিকতার কালে প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকাতেই জাত-পরিচয় সচেতনতার প্রসঙ্গ দেখা যায়।

১৯৭০-এর দশকে মহারাষ্ট্রের দলিত প্যান্থার আন্দোলন অম্বেডকর-পরবর্তী ভারতে তাঁকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার সবচেয়ে বড় বিপ্লব। যে বিপ্লব সফল ভাবে সারা দেশে অম্বেডকর-চেতনা নিয়ে আসে। বাংলাতেও নতুন আঙ্গিকে নমশূদ্র, পৌণ্ড্র, বাউরি, বাগদি ইত্যাদি জাতি দলিত পরিচয়ের দর্শনে অম্বেডকরকে আইকন করে আত্মসচেতনতায় উদ্দীপ্ত হয়। তৈরি হতে থাকে প্রতিটি জাতির সামাজিক সত্তা, যে সামাজিক সত্তার নির্মাণ ছিল অম্বেডকরের কাছে স্বরাজের অর্থ। গান্ধীর স্বরাজ থেকে তাঁর স্বরাজ এখানে বিশেষ ভাবে আলাদা।

অম্বেডকর বাংলার সঙ্গে যত না সামাজিক, তারও বেশি রাজনৈতিক ভাবে যুক্ত। যোগেন মণ্ডলের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা থেকে নির্বাচিত হয়ে গণপরিষদে যাওয়ার সুযোগ পেলেও পরবর্তী কালে যোগেন মণ্ডলের সঙ্গে তাঁর একটি অস্পষ্ট মানসিক দূরত্বও তৈরি হয়, তাঁর দীর্ঘ লেখালিখির মধ্যে বাংলা সম্বন্ধে বিশেষ অভিমতও তিনি প্রকাশ করেননি। সত্তরের দশক অম্বেডকরবাদী চেতনার দশক। তখন মুক্তিযুদ্ধ ও তার ফলে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ভারতে আসেন, ক্রমে বাস্তুহারা নিম্নবর্ণের মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। মূল ধারার সংস্কৃতির অংশীদার হিসাবে উচ্চবর্ণের উদ্বাস্তুদের পরিচয় নির্মাণের কাজ অনেক সহজ। কয়েক দশকের মধ্যে দলিত আশ্রয়হীন শরণার্থীদের কাছে অম্বেডকর হয়ে ওঠেন আত্মনির্মাণের আইকন। তাঁর মর্যাদা ও সুরক্ষার দর্শন বাস্তুহীন মানুষকে আত্ম ও গোষ্ঠী নির্মাণে সাহায্য করে। বামপন্থী আদর্শ ও রাজনীতি দেশভাগের কাল থেকে আজ অবধি উদ্বাস্তুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বশক্তিকরণের কাজ করে চলেছে। সেই বৃত্তেই আত্মসচেতন উদ্বাস্তু নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হন অম্বেডকর।

ক্রমে বাংলা ভাষায় আসে ‘অম্বেডকর কন্টেন্ট’। মহীতোষ বিশ্বাস লেখেন বিন খংগড়ৈ সংগ্রাম, রাজু দাস লেখেন অম্বেডকরের জীবননির্ভর বহু নাটক, অভিষেক সরকার লেখেন মূকনায়ক। মনোহর মৌলি বিশ্বাস, যতীন বালা, ধূর্জটি নস্কর, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, নকুল মল্লিক, সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস, অনিলরঞ্জন বিশ্বাস, নীতীশ বিশ্বাস, মঞ্জু বালা, স্মৃতিকণা হাওলাদার, কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়াল, লিলি হালদার প্রমুখের কলমে উঠে আসেন তিনি। জ্যোতি বসু, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, দীনেশ ডাকুয়া, উপেন কিস্কু, কান্তি বিশ্বাসরা ঐকতান গবেষণাপত্র-এর ১৯৯২ অম্বেডকর বিশেষ সংখ্যায় তাঁর প্রতি বামপন্থীদের শ্রদ্ধা ও তাঁর আপসহীন লড়াইয়ের কথা নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেন।

২০১২ সালে রানাঘাটের উদ্বাস্তুপাড়া, কুপার্স ক্যাম্প থেকে নতুন করে শুরু হয় মর্যাদা সুরক্ষার আন্দোলন। অম্বেডকর শুধু জাতপাতভিত্তিক লাঞ্ছনাতেই নন, প্রান্তিক মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলনেও সহায় হচ্ছেন। দলিতের কাছে প্রত্যক্ষ জাতিবঞ্চনা সব সময় সমস্যা নয়, তার সামাজিক পশ্চাৎপদতার পিছনে যে অর্থনৈতিক দুর্বলতা, তা থেকে মুক্তি পেতেও তার লড়াই অম্বেডকরবাদী লড়াই। এই লড়াই সে শুধু অর্থনৈতিক সমস্যাকে বুঝতে লড়ছে না, নিজের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সত্তা যাতে হারিয়ে না যায়, সেই কারণেও লড়ছে। দলিতের কাছে মর্যাদাবোধ হল শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে প্রধান অহিংস প্রতিরোধ, তার বীজমন্ত্র দিয়েছেন অম্বেডকর। তামিল ছবি পরিয়েরুম পেরুমল-এ পরিয়ন আইন পড়তে এসে ‘ডাক্তার’ হতে চেয়েছিল, শুনে হেসেছিল সবাই, টেবিলে রাখা অম্বেডকরের ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে সে তার ইচ্ছার গভীরতা বুঝিয়েছিল। অম্বেডকরবাদী দর্শন এ দেশে এতই জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক যে, প্রতি দিন তা তৈরি করে সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক বয়ান, জীবন্ত মানুষের চেতনা।

আরও পড়ুন
Advertisement