চলচ্চিত্র উৎসবের তিন দশকে কলকাতার মানচিত্র ও চালচিত্র
KIFF

এই শহরের ফিল্মায়ন

আজ নয়, বহুকাল। ৯/১১-র পর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের ব্রোশিয়োরের প্রচ্ছদে ছিল টুইন টাওয়ার, বিমানহানা। সেটি তৎকালীন সিনেমাপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রীর আইডিয়া ছিল।

Advertisement
গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:২৩
তখন: আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন, কলকাতা, ১৩ জানুয়ারি ১৯৯০

তখন: আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেন, কলকাতা, ১৩ জানুয়ারি ১৯৯০

তেত্রিশ বছর কেটে গেলে বোঝা যায়, কেউ কথা রাখেনি। ২৮ বছরেও সেই হিসাবনিকাশ হয়ে ওঠে না, শুধু কিছু স্মৃতি জলছবির মতো ভেসে ওঠে। নন্দন চত্বরে সম্প্রতি ঘুরতে ঘুরতে মনে হল, সেই সব স্মৃতি পাশাপাশি রেখে দিলে যা তৈরি হয়, তারই নাম সিনেমা। অমিতাভ বচ্চন আর সিলভেস্টার স্ট্যালোনকে পাশাপাশি রেখে, চ্যাপলিনকে পথের পাঁচালীর অপুর পাশে বসিয়ে, সৌমিত্র আর টম হ্যাঙ্কসকে পাশাপাশি রেখে যে মন্তাজ তৈরি হয়, সেটাই তো সিনেমা-উৎসবের টিজ়ার। ফোটোশপ আর উৎসব আজ একাকার।

আজ নয়, বহুকাল। ৯/১১-র পর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের ব্রোশিয়োরের প্রচ্ছদে ছিল টুইন টাওয়ার, বিমানহানা। সেটি তৎকালীন সিনেমাপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রীর আইডিয়া ছিল। এই স্মৃতির কোলাজই বলে দিতে পারে, সাত দিনের উৎসবকে কেন্দ্র করে কী ভাবে বদলে গেল আমাদের শহর ও তার সংস্কৃতি!

Advertisement

২৮ বছর আগে, এই কাগজে প্রথম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব সংক্রান্ত খবরের হেডিং ছিল, ‘শিল্পায়নের মতই রাজ্যে আসুক ফিল্মায়ন।’ তখন রাজারহাট নজরুলতীর্থ থেকে সল্ট লেকের রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবন, ইন্ডোর স্টেডিয়ামে উদ্বোধন সবই দূর অস্ত। ‘শিল্পায়ন’ শব্দটার মধ্যে বাঙালির স্বপ্ন, সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। প্রায় তিন দশক আগের সেই শিল্পহীন, প্রাক্-উৎসব পৃথিবীতে নন্দন ছিল অন্য রকম, মাল্টিপ্লেক্সের থেকে বেশি কিছু। তুরস্কের জেলবন্দি পরিচালক ইলমাজ় গুনে-র দ্য ওয়াল এখানেই দেখেছি। টিভিতে গোবিন্দ নিহালনির তমস ধারাবাহিক দেখানো হল, শোনা গেল সব ক’টা এপিসোড এক সঙ্গে নন্দনে দেখা যাবে।

টিকিট বা কার্ড নেই, তবু আমরা জনাচারেক বন্ধু নন্দনের সামনে দাঁড়িয়ে। নিরাপত্তারক্ষীদের প্রতি কাকুতিমিনতি, অনুনয়-বিনয় সব জলে। ঠিক আছে, চান্স নেওয়া যাক। সিনেমা শুরুর পর যদি বরফ গলে! সেই সময় হলে ঢুকছেন গোবিন্দ নিহালনি ও ওম পুরী। উটকো ছোঁড়াগুলিকে পিছু পিছু আসতে ওঁরা ইশারা করলেন, আমরা ঢুকে গেলাম। তখনও উজ্জ্বলা, লাইটহাউস, আলোছায়ার মতো সিনেমা হল ভেঙে শপিং মল বা বহুতল হয়নি, ফিল্ম ক্লাবগুলি দেখাত চ্যাপলিন বা গুরু দত্ত। ফিল্ম ক্লাব ছিল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্টাডিজ় ছিল, চিত্রবাণীতে প্রায়ই সিনেমা নিয়ে ক্লাস নিতেন ফাদার গাস্তঁ রোবের্জ। শম্ভু মিত্রের শেষ নাটক দশচক্র-র টিকিট কিনতে আমরা বন্ধুরা ওই চত্বরে সারা রাত লাইন দিই। উৎসবের জৌলুসহীন সেই পৃথিবীতে নন্দন বেশ সমীহের বস্তু। টপ ভিউতে আকাশ থেকে হলটাকে নাকি মাছের মতো দেখায়, নাম দিয়েছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। ভিতরে সিনেমার বইপত্রের জন্য ঋত্বিক মেমোরিয়াল লাইব্রেরি। সিনেমা নিয়ে তখন হরেক নাগরিক স্মৃতি। কলকাতা কর্পোরেশনের কাছে যে সোসাইটি হলে নুন শো-তে রগরগে নীল ছবি চলে, সেখানে এক বার সত্যজিৎদের চেষ্টায় ফিল্মোৎসব হয়, দেখানো হয় গোদারের ছবি। তখন দিল্লি ছাড়া অন্যত্র ফিল্মোৎসব হত না।

তা হলে কি বাংলার প্রতিবাদী বাম রাজত্বে থাকবে না নিজস্ব উৎসব? জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনুপ্রেরণায় নন্দনে শুরু হল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। জ্যোতিবাবু এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি না, বুদ্ধ ও সব সংস্কৃতি-টংস্কৃতি বোঝে।”

তখন সংস্কৃতি ছিল না বিচ্ছিন্ন কোনও ব-দ্বীপ। সাহিত্য, সিনেমা, নাটকের মধ্যে চলত নিঃশব্দ কথোপকথন। আন্তোনিয়নির ছবি দেখতে আসেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা। ডেলিগেট কার্ডের জন্য লাইন পড়ে। কখনও শো-এর পর হল থেকে বেরিয়ে আসেন অপর্ণা সেন, সোহাগ সেনরা। ঋতুপর্ণ ঘোষ থেকে কৌশিক, চূর্ণী, শেখর দাশ, অরিন্দম শীল অনেকেই তখন ছবির শেষে মনোযোগী ছাত্রের মতো হেঁটে যান। ফি বছর ১০ থেকে ১৭ ডিসেম্বর নন্দন চত্বরে ফিল্মোৎসব এ ভাবেই বদলে দিয়েছিল শহরের সিনেমা-আগ্রহ। মজার ঘটনাও অনেক ঘটত। সেই বুভুক্ষু পৃথিবীতে ফেস্টিভ্যালে অনেকে রগরগে নীল ছবি দেখতে চাইত। উৎসবের এক বিকেলে নন্দনে প্রবল ভিড়। সবাই সেক্সি বিস্ট ছবিটা দেখতে চায়। এবং ছবির শেষে হতাশ। কোনও রগরগে মশলা নেই, গান্ধী-অভিনেতা বেন কিংসলে অভিনীত ছবি। তখন নন্দনে সকাল ৯টার শো-টি ছিল চমৎকার। ওই সময়েই দেখানো হত রোবের্তো ব্রেসঁ, আন্তোনিয়নি, পাসোলিনিদের রেট্রোস্পেকটিভ। কারা যেন রটিয়ে দিয়েছে, পাসোলিনির সালো, অর দি ১২০ ডেজ় অব সডোম ছবিতে বেশ গরম দৃশ্য আছে। নন্দনের চেয়ার থেকে সিঁড়ি কোত্থাও তিল ধারণের জায়গা নেই। কিন্তু বাঙালির ভঙ্গুর জীবনে কি পাসোলিনি হজম হয়? ছবির মাঝপথে ভিড় প্রায় ফাঁকা। সরকারি ফিল্মোৎসবে অল্প হলেও কিছু ধ্রুপদী ছবি দেখা যেত, অস্বীকারের জো নেই।

এই অবধি ঠিকই ছিল। কিন্তু বাদ সাধল স্রষ্টার বাড়াবাড়ি! বুদ্ধদেববাবু তখন প্রায়শ সন্ধ্যায় নন্দনে বসেন, ছবি এবং মায়াকোভস্কির কবিতা, গার্সিয়া মার্কেসের উপন্যাস নিয়ে তাঁর নিজস্ব গোষ্ঠীবৃত্তে আলোচনা করেন। তাঁর নিরাপত্তার জন্য নন্দনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশভ্যান, খেঁকিয়ে ওঠে, “সরুন, সরুন। সি এম আসছেন।” ভিড়ে ঠাসা হলে ফিল্মের পড়ুয়া নয়, সরকারি কর্তা ও তাঁদের শ্যালিকা-ভায়রাভাইদের সংখ্যাই বেশি। নন্দন হয়ে উঠল রাইটার্স বিল্ডিং-এর মতো ক্ষমতার প্রতীকচিহ্ন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই জনমোহিনী রাজনীতিতে এই প্রতীকটিকে গুঁড়িয়ে দিলেন। নন্দনে সিনেমা দেখানো হবে, কিন্তু উদ্বোধন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। সেখানে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা নেই, পরিকাঠামো তৈরি করে দিলেন গৌতম ঘোষ। ঠারেঠোরে ছবি বাছাই কমিটিকে জানিয়ে দেওয়া হল, উৎসবে তাঁরা কান-বার্লিন-ভেনিস যে কোনও জায়গার ছবি দেখাতে পারেন, কিন্তু উদ্বোধনী ছবি হবে সকলে মিলে, সপরিবারে দেখার মতো। সে নিয়ম মেনেই তো এ বার উদ্বোধনে সত্তর দশকের অমিতাভ-জয়ার অভিমান।

চার দশক আগে তৈরি, ডিভিডি, ইউটিউবে সহজলভ্য একটা ছবি দিয়ে আন্তর্জাতিক উৎসব উদ্বোধন হয় না। কিন্তু ভাল ছবি ক’টা হয়? চতুর্দশ উৎসবের আগে বুদ্ধদেববাবুর সাংবাদিক বৈঠক মনে আছে। “এ বারই প্রথম আজ়ারবাইজান, কোস্টারিকা, নামিবিয়া, ভিয়েতনাম থেকে ছবি পাচ্ছি আমরা।” উদ্বোধনে এক জনের গর্ব ছিল তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা অকিঞ্চিৎকর নতুন ছবি, অন্য জনের ভুট্টা-হয়ে-যাওয়া পুরনো সুপারহিট ছবি।

ঘোষণা পাল্টেছে, পাল্টেছে উদ্বোধন। আগে মুখ্যমন্ত্রী এবং সিনেমার বিশিষ্ট কেউ থাকতেন মঞ্চে। এক বার উদ্বোধনে শাহরুখ খান আসবেন রটে গেল, বুদ্ধদেববাবু জানালেন, “না, আমাদের অত পয়সা নেই।” সে বার উৎসবের সূচনা করলেন প্রবীণ সিনেমাটোগ্রাফার রামানন্দ সেনগুপ্ত। এক বার মণিরত্নম উদ্বোধনে এসেছেন, নন্দনের দর্শকাসনে বসে মৃণাল সেন। “এ কী, আপনি নীচে কেন”, প্রশ্নের উত্তরে মৃণালবাবু হাসলেন, “আমার ডিমোশন হয়েছে।” পরে বুদ্ধদেববাবু দর্শকাসনে তাকিয়ে বললেন, “মৃণালদা, মণি তো আপনার বন্ধু। ওঁকে নীচে তথ্যকেন্দ্রের এগজ়িবিশনটা দেখিয়ে আনুন।”

এখন? মঞ্চে এক ডজন লোক, নীচে আরও। ২০১৩ সালে, ইন্ডোরের উদ্বোধনী মঞ্চে অমিতাভ, জয়া, শাহরুখ প্রমুখ চাঁদের হাট। নীচে দর্শকাসনে আদুর গোপালকৃষ্ণন, ইজ়রায়েলের আমোস গিতাই। কিন্তু সিনেমার উৎসবে মঞ্চের উপর-নীচে এক বারও হয় না সংযোগ। তারকার ছটায় পূর্ণ এই সব উদ্বোধনে একমাত্র মান রেখেছিল অমিতাভ বচ্চনের বক্তৃতাগুলি। বাকিরা ‘আমি কলকাতাকে ভালবাসি’ ইত্যাদি চিরাচরিত ক্লিশে। মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধনেই জানিয়েছিলেন, তিনি রূপসাগর, ভোরসাগর ইত্যাদি তিনটি সৈকত অবিষ্কার করেছেন। শাহরুখরা যেন সেখানে শুটিং করতে আসেন। এ বার তো বাংলার পর্যটন ছাপিয়ে তিনি অমিতাভ বচ্চনকে ভারতরত্ন দেওয়া উচিত, তা নিয়ে বাগবিস্তার করেছেন। যে অমিতাভ কাশ্মীর ফাইলস থেকে প্রতিটি বিতর্কে স্পিকটি নট থাকতে অভ্যস্ত, তিনিও বললেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কী ভাবে খর্ব হচ্ছে, তা নিয়ে। উদ্বোধনে সিনেমা ছাড়া অন্য সব বিষয় স্বাগত। যে জন রাজনীতি জানে, বুঝহ সন্ধান।

তা হলে, ২৮ বছরের প্রাপ্তি কী দাঁড়াল? নন্দন বনাম নেতাজি ইন্ডোরে উদ্বোধন, মুষ্টিমেয় আঁতেলদের উৎসব বনাম জনতার উৎসব সবই উদ্বোধন আর ঘোষণাকে ঘিরে। সিনেমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক নেই। বরং শহরের মানচিত্রে ঘটে গিয়েছে উজ্জ্বল উদ্ধার। নজরুলতীর্থ, রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনের দৌলতে নিউ টাউন, সল্ট লেকের বাসিন্দাদের আর নন্দন, রবীন্দ্র সদনে ভিড় না করলেও চলে। তারকারা নন, তিন-চার মাস খেটেখুটে যে নাম-না-জানা কর্মীরা এজেন্সি থেকে ছবিগুলি জোগাড় করেন, কোন ছবি কোথায় কখন সেই শিডিউলিং তৈরি করেন, তাঁরাই এই উৎসবের নায়ক। মন্ত্রী-সান্ত্রি-তারকা-সেলেব্রিটিরা নন।

আসলে তখনও উৎসব ভিড়ের হিসাব কষত, এখনও। একতারা মঞ্চে গান, তারকাদের আলোচনা, সেলফি স্ট্যান্ড, সপ্তাহান্তে প্রেম-কফি-পকোড়া ইত্যাদি। এই শহর ছাড়া কান, বার্লিন, বুসান কোথাও এ ভাবে ভিড়ের নিরিখে উৎসবের সাফল্য-ব্যর্থতা বিবেচিত হয় না। কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই!

আরও পড়ুন
Advertisement