অপরিণামদর্শী অর্থনীতির ফল কী হতে পারে, দেখাল শ্রীলঙ্কা
Sri Lanka

শেষ পর্যন্ত ভরাডুবি

কয়েক বছর আগেও যে দেশের মানবোন্নয়ন সূচকের উদাহরণ দেওয়া হত, তার এমন অবস্থা কী করে হল? খানিকটা ভাগ্যের মার, অস্বীকার করার উপায় নেই।

Advertisement
অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩৪
মরিয়া: কলম্বোয় পার্লামেন্টের সামনে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ৮ এপ্রিল।

মরিয়া: কলম্বোয় পার্লামেন্টের সামনে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। ৮ এপ্রিল। ছরি: রয়টার্স

দেশ জুড়ে হাহাকার শ্রীলঙ্কায়— দিনের অর্ধেক সময় লোডশেডিং, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, পেট্রল পাম্পে তেল নেই, রান্নার গ্যাস নেই। তুমুল মূল্যস্ফীতি। আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণের পরিমাণ বিপুল— তা শোধ দেওয়ার সংস্থান নেই। দেশের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার তলানিতে ঠেকেছে।

কয়েক বছর আগেও যে দেশের মানবোন্নয়ন সূচকের উদাহরণ দেওয়া হত, তার এমন অবস্থা কী করে হল? খানিকটা ভাগ্যের মার, অস্বীকার করার উপায় নেই। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একটা বড় দিক হল পর্যটন শিল্প। কোভিডের ধাক্কায় তার অবস্থা ভয়াবহ। অন্য দিকে রয়েছে নীতিনির্ধারকদের অপরিণামদর্শিতা। ঋণ করে দেশ চালানোর অভ্যাস করে ফেলেছিলেন সে দেশের শাসকরা। তা-ও চড়া সুদে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ। এ দিকে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধিতে মন দেয়নি সরকার, অর্থব্যবস্থার রাশ ছেড়ে রেখেছিল শাসকদের ঘনিষ্ঠ কতিপয় সাঙাতের হাতে। ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপুল ধার, তার উপর নিরাপত্তার অভাব— সব মিলিয়ে দেশের ক্রেডিট রেটিং কমেছে। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাণিজ্যিক ধার পাওয়ার পথও বন্ধ হয়েছে ক্রমে। এ দিকে, নতুন নোট ছাপিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টায় আরও দ্রুত গতিতে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।

Advertisement

গত কয়েক বছরে টাকার অভাব সামাল দিতে বিপজ্জনক সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের সরকার। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিদেশি মুদ্রায় রাসায়নিক সার কিনতে হয়, এবং তার উপর ক্রেতাদের ভর্তুকিও দিতে হয়, তাই সে খরচ বাঁচাতে রাতারাতি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল রাসায়নিক সার— গোটা দেশে অর্গানিক চাষ চালু করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে বলেছিলেন— অচ্ছে দিন, থুড়ি, কৃষিতে উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও কৃষকের সমৃদ্ধি এল বলে। আসেনি। ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২০ শতাংশ, এখন বাংলাদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। অর্থনীতির উন্নতি হবে বলে রাতারাতি করের হার কমিয়ে দিয়েছিল সরকার। শিল্প উৎপাদন বাড়েনি, কিন্তু রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে বিপুল পরিমাণে। ফলে, রাজকোষ ঘাটতির হার জিডিপি-র প্রায় ১৫ শতাংশ।

শুধুই কি অর্থব্যবস্থাকে সামলাতে না পারার ফল? যেমন ভারতীয় অর্থব্যবস্থাও বারে বারেই ধাক্কা খেয়েছে গত সাত-আট বছরে? উত্তরটা শ্রীলঙ্কা আর ভারত, দু’দেশের জন্যই এক— না, এ শুধু অর্থনৈতিক ব্যর্থতা নয়। শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে পরিবার— যে পরিবারের এক ভাই দেশের প্রেসিডেন্ট, অন্য ভাই প্রধানমন্ত্রী, আরও দু’ভাই এবং ছেলেমেয়েদের অধীনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব দফতর, সব মিলিয়ে দেশের বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে যে পরিবারটি— যে ভঙ্গিতে দেশ চালিয়েছে, এটা তার প্রতিফলন। অন্য কারও মতের তোয়াক্কা না করে, শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থের কথাটুকু ভেবে। ২০১৬ সালে যেমন কোনও বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ না করেই ভারতে নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আগুপিছু না ভেবে কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিতে সম্ভবত ততখানি দুঃসাহসেরই প্রয়োজন হয়।

সেই সাহস আসে কোথা থেকে? রাজাপক্ষে পরিবারের দুর্নীতি, দেশের সব ক্ষমতা দখলের চেষ্টা— সব কিছু নিতান্ত প্রকাশ্যে থাকার পরও পরিবার চার বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পরে ২০১৯ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়েই প্রেসিডেন্ট হন গোতাবায়া রাজাপক্ষে; দু’দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহেকে ছেঁটে সেই পদে বসেন মহিন্দ রাজাপক্ষে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিঃশর্ত সমর্থন ছিল তাঁদের দিকে— কারণ, মহিন্দ রাজাপক্ষে দ্ব্যর্থহীন ভাবে এই সিংহলী সংখ্যাগরিষ্ঠতানির্ভর উগ্র জাতীয়তাবাদের পক্ষে। প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট থাকার সময় এলটিটিই-র কোমর ভেঙেছিলেন মহিন্দ, সঙ্গে মারা পড়েছিলেন অন্তত পঁচাত্তর হাজার তামিল। তিনি জানেন, সিংহলী জাতীয়তাবাদের পালের হাওয়াই তাঁকে টেনে নিয়ে যাবে। উগ্র জাতীয়তাবাদের সব সময়েই কোনও না কোনও শত্রুপক্ষের প্রয়োজন হয়। দুর্বল হয়ে যাওয়া তামিল জনগোষ্ঠীকে দিয়ে সেই কাজ আর চলছে না বলে রাজাপক্ষেরা নতুন শত্রু হিসাবে বেছে নিয়েছেন মুসলমানদের। বড় মাপের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি ঠিকই, কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্রের মুসলমানরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়েছেন। একটা উদাহরণ দিই— ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে পিছু হটার আগে অবধি কোভিড-১৯’এ মারা যাওয়া মুসলমানদের দেহ দাহ করতে বাধ্য করেছিল সে দেশের সরকার।

জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনীতি শ্রীলঙ্কায় নতুন নয়। স্বাধীনতার বছর দশেকের মধ্যেই সে দেশে সিংহলী বৌদ্ধ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পর ক্রমে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব গুরুত্বপূর্ণ ভার চলে গিয়েছে সেই জনগোষ্ঠীর হাতেই। প্রশাসনের উঁচু পদ থেকে পুলিশ-সেনাবাহিনী, সবেতেই নিজেদের লোক। সংখ্যালঘু দমন করতে উগ্র নীতি গ্রহণ করলেও তাতে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। ফলে, ক্ষমতায় থাকার জাদুমন্ত্র হয়ে উঠেছে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ। বোদু বল সেনা নামে এক কট্টরপন্থী বৌদ্ধ সংগঠন ক্রমাগত উস্কানি দিয়ে গিয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে— গোতাবায়া দেখেছেন, নীরবে প্রশ্রয় দিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে?

সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ দিয়ে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের উন্নতি করা কঠিন। দীর্ঘ সিংহলী-তামিল গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কায় ঋণের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছিল। সেই গৃহযুদ্ধ মিটেছে, কিন্তু জাতিগত অবিশ্বাসের আবহে অর্থব্যবস্থা গুটিয়েই থেকেছে— শ্রীলঙ্কায় লগ্নি করতে ভয় পেয়েছেন অনেকেই। পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গেও ক্রমশ সম্পর্ক ছিন্ন করেছে শ্রীলঙ্কা— দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক চাপকে রাজাপক্ষেরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির অন্যায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে দেখিয়েছেন। ফলে, লাভজনক শর্তে বিদেশি বিনিয়োগ বা সহজতর শর্তে ঋণ, কোনওটাই পায়নি শ্রীলঙ্কা। এই ফাঁক পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে চিন। শ্রীলঙ্কা জুড়ে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে লগ্নি করেছে চিন— সে লগ্নি আসলে চড়া সুদে ঋণ। যে দেশ অন্য কোথাও থেকে ঋণ পায় না, তাকে চড়া হারে ঋণ দেওয়া চিনের ইদানীংকার নীতি। আমেরিকা এর নাম দিয়েছে ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোম্যাসি— ঋণের দায়ে জড়িয়ে ফেলার কূটনীতি। খাতক দেশ ঋণ শোধ করতে না পারলে সেই সম্পদের দখল তো বটেই, এমনকি সরকারেরও কার্যত দখল নেয় চিন, আমেরিকা এই অভিযোগ করে চলেছে বেশ কিছু কাল ধরেই। শ্রীলঙ্কায় চিনের লগ্নি প্রচুর, রাজাপক্ষে পরিবার ও সাঙাতদের তাতে লাভ প্রচুরতর, কিন্তু দেশের কতখানি উপকার হয়েছে, সে হিসাব নেই।

এখনকার সঙ্কটটি ঘনিয়ে ওঠার আগে কারও যে সেই হিসাব চাওয়ার খুব তাগিদ ছিল, তেমন দাবি করাও মুশকিল। সিংহলী-বৌদ্ধ আধিপত্য বজায় থাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মোটের উপর খুশি ছিলেন। ‘আন্তর্জাতিক চাপ’-এর কাছে দেশের প্রেসিডেন্টের মাথা না নোয়ানোর সাহসেও অনেকেই গর্বিত ছিলেন। এপ্রিলের গোড়ায় যে মন্ত্রীরা দল বেঁধে পদত্যাগ করলেন অপশাসনের অভিযোগ তুলে, তাঁরাও দীর্ঘ দিন ধরে বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছেন সব কিছুই। অর্থব্যবস্থার যখন ক্রমেই ভরাডুবি হচ্ছে, আইএমএফ তখন বারে বারে সাহায্য করতে চেয়েছিল— গোতাবায়া রাজি হননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভারত মহাসাগরে শ্রীলঙ্কার ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অবস্থানের কারণেই গোটা দুনিয়া বিনা শর্তে আর্থিক সাহায্যের ঝুলি নিয়ে ছুটে আসবে, চিনের আরও প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে। সেই বিশ্বাস ভ্রান্ত প্রমাণিত হচ্ছে— এমনকি চিনও খুব আগ্রহ দেখায়নি শ্রীলঙ্কার মাথায় ভেঙে পড়া আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা লাঘব করার জন্য। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, গোতাবায়া যখন এমন বিপজ্জনক পথে হাঁটছিলেন, চার পাশের কেউ বাধাও দেননি তাঁকে।

শ্রীলঙ্কার উদাহরণ থেকে ভারত, বা তার নাগরিকরা কিছু শিখবে, সেই আশা ক্ষীণ। তবে, একটা মস্ত বার্তা দিয়ে গেল শ্রীলঙ্কা— সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের পথে হাঁটতে গিয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করলে, সাঙাততন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলে, চার পাশে শুধু ‘জো হুজুর’-দের জায়গা দিলে শেষ পর্যন্ত তার ফল হয় মারাত্মক।

আরও পড়ুন
Advertisement