ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার দিনই ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর সরকার কেবল দু’টি লিঙ্গকেই মান্যতা দেবে— নারী এবং পুরুষ। এতে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি সমাজে বিদ্বেষ স্বাভাবিক ভাবেই বাড়বে। নির্বাচনী প্রচারের সময়েই বোঝা গিয়েছিল যে, কী হতে চলেছে। যেখানে আমেরিকার মাত্র এক-দেড় শতাংশ মানুষ রূপান্তরকামী, সেখানে ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজ্ঞাপনের ৪১% ছিল রূপান্তরকামী মানুষদের বিরুদ্ধে, যার জন্য খরচ হয়েছিল সাড়ে একুশ কোটি ডলার! আগের দফাতেও ট্রাম্প সমকামী-রূপান্তরকামীবিরোধী বহু ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু এ বারে আশঙ্কা প্রবলতর।
শপথগ্রহণের দিনই প্রেসিডেন্ট প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষের অস্তিত্ব মুছে ফেলার কথা ঘোষণা করছেন, এ ঘটনা সম্ভবত গোটা দুনিয়ায় আক্ষরিক অর্থেই অ-পূর্ব। লিঙ্গপরিচয় একটি চলমান ধারণা। পৃথিবীতে নারী আর পুরুষ লিঙ্গপরিচয়ের মানুষদের পাশাপাশি রূপান্তরকামী মানুষদের অস্তিত্ব সব সময়ই বজায় ছিল। বরং রূপান্তরকামী মানুষদের অধিকার রক্ষায় আমেরিকা ছিল দৃষ্টান্তস্বরূপ। সামাজিক অধিকার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, এমনকি পাসপোর্টে অবধি রূপান্তরকামী মানুষদের যে সুরক্ষা আমেরিকার সংবিধান নিশ্চিত করেছিল, এ বার সে সবের কী হবে? রাষ্ট্র কি এ ভাবে নাগরিকের স্বাধীনতা হরণ করতে পারে? দাবি করতে পারে যে, সব রূপান্তরকামী মানুষকে তাঁদের জন্মকালে-ন্যস্ত লিঙ্গপরিচয়ে ফিরে যেতে হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথের দিন তাঁর চার পাশে চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি ছিল নানাবিধ সমাজমাধ্যমের মালিক ধনকুবেরদের। জনমত গঠনে সমাজমাধ্যমের শক্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতা আজ অনস্বীকার্য। অনেকেরই মনে হয়েছে, গত বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ক্ষমতাধর সমাজমাধ্যমগুলি প্রচ্ছন্ন ভাবে বা প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সমর্থনে কাজ করছিল। ‘মেটা’ সম্প্রতি তাদের অভ্যন্তরীণ নিয়মাবলিতে কিছু পরিবর্তন এনেছে। ঘোষণা করেছে যে, জাতপাত কিংবা ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়ে পদক্ষেপ করবে, কিন্তু লিঙ্গযৌন পরিচয়ের ক্ষেত্রে ঘৃণাভাষণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা তারা দিতে পারবে না। পাবলিক টয়লেট ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কিংবা ক্রীড়াক্ষেত্র, স্বাস্থ্য এবং স্কুল-কলেজে প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের অংশগ্রহণ না-করতে দেওয়ার দাবির বিরোধিতা করবে না। শুধু তা-ই নয়, এ বার থেকে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের যদি ‘মনোরোগী’ বলা হয়, তা-ও মেটা-র ‘কমিউনিটি গাইডলাইন’-এ আটকাবে না।
শপথের দিন ডোনাল্ড ট্রাম্পের রূপান্তরকামী মানুষদের বিরুদ্ধে ঘোষণা এবং তার আগে ‘মেটা’র এ বিষয়ে পদক্ষেপ, অতএব, এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে— একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে ঘৃণা ছড়ানো শুরু হয়েছে। যা অতীতের গণহত্যার নানা ভয়ানক সময়ের স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে। প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষেরা সমাজমাধ্যমের হাত ধরে নিজেদের প্রকাশ আরও বাড়িয়েছেন সাম্প্রতিক কালে। আবার, তাঁদের প্রতি বিদ্বেষও আছড়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমেই। উদাহরণ ঘরের কাছেই আছে— বাংলার যে কোনও রূপান্তরকামী ‘ইনফ্লুয়েন্সার’-এর সমাজমাধ্যমে ‘কমেন্ট’ অংশ দেখলেই তার আন্দাজ পাওয়া যায়। এ কি মানসিক নির্যাতন নয়? হিংসা নয়?
অনেক সমকামী-রূপান্তরকামী ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ এমন ঘৃণাভাষী ‘ফলোয়ার’ বাড়িয়ে সমাজমাধ্যম সংস্থার থেকে অর্থানুকূল্য আদায় করছেন! ঘৃণা তাঁদের রোজগারের উপায়। কিন্তু এমনও তো অনেকে থাকেন, যাঁরা এই ঘৃণার ঝড় পার করতে পারেন না। প্রথম ট্রাম্প-জমানায় আমেরিকার নানা রাজ্যে মোট ৪৮টি এমন আইন প্রণয়ন হয়েছিল, যেগুলিকে রূপান্তরকামী-বিরোধী বলা চলে। তাতে আমেরিকার রূপান্তরকামী মানুষদের মধ্যে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় ৭২%। ঘৃণার তরঙ্গ সর্বত্র ছড়িয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরের ষোলো বছরের এক কিশোর তার একটি শাড়ি-পরা ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করেছিল। ঘৃণাভাষণের আঘাত সহ্য না করতে পেরে সে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল।
যে আমেরিকা সারা বিশ্বের কাছে বিভিন্নতা, ন্যায্যতা ও অপরকে স্থান দেওয়ার সর্বজনীনতায় পথপ্রদর্শক ছিল, সেই মহাদেশ কি তবে অন্যায়, অবিচার আর ঘৃণার রাষ্ট্রে পরিণত হবে? এ-কথা সত্যি যে, বিশ্বে যত বার রাষ্ট্রের নিপীড়ন বেড়েছে— সে যে গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই হোক— পাশাপাশি প্রতিরোধের নানা পথও খুলে গিয়েছে। প্রেসিডেন্টের শপথের দিনই ওয়াশিংটন ডিসি-র বিশপ ম্যারিয়ান এগডার বাড সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনুরোধ করেছেন সমাজে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে, এবং প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার শিশুদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে। প্রতিবাদের এক অনন্য রূপ গড়ে তুলেছেন বিশপ বাড। তিনি ট্রাম্পকে গণতন্ত্র ও সাম্যের প্রকৃত অর্থ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এখন দেখার, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুনর্নির্বাচিত করে যে জনগণ আমেরিকার তখতে বসাল, সহনাগরিকদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের মধ্যে প্রতিরোধের ঢেউ ওঠে কি না।