Assam

বুলডোজ়ারেও ক্ষোভ কই, হিমন্তই ‘চাণক্য’

আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যেও বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর সুবাদে রাজ্যে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু যে সব রাজ্যে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার চলছে, সেখানে কী হাল? উন্নয়ন, না কি শুধুই মেরুকরণ? তিন রাজ্য ঘুরে আনন্দবাজারের রিপোর্ট।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ ২২:১২
ভাঙা বাড়ির সামনে কচুতলির আমিলা খাতুন।

ভাঙা বাড়ির সামনে কচুতলির আমিলা খাতুন। —নিজস্ব চিত্র।

কচুতলির ফাঁকা মাঠের মাঝখানে বসে খেলনাবাটি খেলছিল ছোট্ট আমিলা। আমিলা খাতুন। পিছনে তাদের বাড়ি ছিল। বুলডোজ়ার চালিয়ে পাকা বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অর্থসাহায্যেই তৈরি বাড়ি। পাশে চাদরের উপরে কিছুটা ধান ছড়ানো। আপাতত পেট চালানোর সম্বল।

Advertisement

আমিলা খাতুন। চতুর্থ শ্রেণি। কচুতলি নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখন স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমিলা, তার বাবা, মা, কচুতলি গাঁয়ের বাঙালি মুসলিমরা অসমের ‘অশনাক্ত লোক’। তাঁদের বাড়ি-জমির দলিল ছিল। রেশন কার্ড ছিল। এখন ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়েছে। স্কুলের গেটে তালা। সবাই এখন সন্দেহভাজন বাংলাদেশি।

অসমের কামরূপ জেলার কচুতলি গুয়াহাটি শহর থেকে ঘণ্টা খানেকের পথ। গত সেপ্টেম্বরে মুসলিম মহল্লার সমস্ত বাড়ি বুলডোজ়ার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে ন’শো পরিবার গৃহহারা। অনেকে দিগারু নদীর পাশে মসজিদের মাঠে বেড়ার ঘর বানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। জেলা প্রশাসনের দাবি, আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত জমি থেকে জবরদখল সরানো হয়েছে। বিজেপি বলছে, অসমের ‘খিলঞ্জিয়া’ বা ভূমিপুত্রদের জমি দখল করে ‘মিঁঞা মুসলিম’-দের ‘জমি জিহাদ’ থামাতেই বুলডোজ়ার।

কচুতলির মুকদ্দর আলি একসময় বিজেপি করতেন। মরিগাঁওতে আদি ভিটে ব্রহ্মপুত্রে তলিয়ে যাওয়ায় পরিবারটি বিশ-চল্লিশ বছর আগে কচুতলিতে আসে। আদিবাসীদের থেকে জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন। দলিলও রয়েছে। মুকদ্দরের প্রশ্ন, “জবরদখল খালি করার হলে হিন্দুদের বাড়িতে বুলডোজ়ার চলল না কেন?” বিজেপি ২০১৬-এ প্রথম অসমে ক্ষমতায় আসার পরে ১০ হাজারের বেশি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, উচ্ছেদের সময় বেছে বেছে মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে। চলতি বছরেই অসমে পঞ্চায়েত ভোট। আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচন। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা ঘোষণা করেছেন, “আমার মিঁঞা ভোট দরকার নেই।” মুকদ্দরের প্রশ্ন, “ভোট দরকার নেই বলেই কি কচুতলির তিন হাজার নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ল?”

কচুতলি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মরিগাঁওয়ের জাগি রোডে চলছে উন্নয়নের যজ্ঞ। টাটা গোষ্ঠীর সেমিকনডাক্টর কারখানা হচ্ছে। লগ্নি হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ২৭ হাজার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে। হিমন্তের সাফল্যের সব থেকে বড় পালক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘এ ফর আসাম’। হিমন্ত ডাবল ইঞ্জিন সরকারের মাহাত্ম্য প্রচারে ব্যস্ত। উত্তর-পূর্বের বিজেপিতে তিনিই চাণক্য, তিনিই চন্দ্রগুপ্ত। গোটা অসমের ‘মামা’ হিমন্তকে জনপ্রিয়তায় টেক্কা দিতে বিরোধী শিবিরে কেউ নেই, একমত সবাই। মোদীর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর আদলে ‘অ্যাডভান্টেজ অসম’ শিল্প সম্মেলন করছেন তিনি।

বিরোধীদের দাবি, উন্নয়নের প্রদীপের তলায় দুর্নীতির অন্ধকার। হিমন্তবিশ্ব বেনামে রাজ্য জুড়ে সম্পত্তি দখল করছেন। ইতিমধ্যে তিনি সব থেকে ধনী দশ মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে এক জন। অথচ মানব উন্নয়নের মাপকাঠিতে অসম পিছনের সারিতে। কংগ্রেস নেতা রিপুন বরার অভিযোগ, বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, অসম প্রথম পাঁচে থাকবে। বাস্তবে মাথা পিছু আয় থেকে মানব উন্নয়নের সূচকে অসম শেষ সারিতে। স্কুলছুটের হার, মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর হার খুবই খারাপ। বিজেপি সরকারের দাবি, গত তিন বছরে অপরাধের সংখ্যা ৬৫% কমেছে। জঙ্গি আন্দোলনে ইতি পড়েছে। কংগ্রেস পাল্টা বলছে, গত আট বছরে ১৮ হাজারের বেশি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে।

বিরোধীদের অভিযোগ থেকে নজর ঘোরাতে অসমের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে মন হিমন্তবিশ্বের। অসমে বৈষ্ণব আন্দোলনের পথিকৃৎ শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের বটদ্রবার সত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর বারাণসী করিডর, যোগী আদিত্যনাথের অযোধ্যার মতো হিমন্তবিশ্ব বটদ্রবাকে সাজিয়ে তুলছেন। কংগ্রেসের আমলে এই সত্রের জমিও জবরদখল হয়ে গিয়েছিল বলে তাঁর অভিযোগ।

অসম জাতীয় পরিষদের মুখপাত্র জিয়াউর রহমানের প্রশ্ন, বিজেপি শঙ্করদেবের আদর্শ মানলে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন কেন করছে? অসমের ভাষিক সংখ্যালঘু উন্নয়ন পর্ষদের প্রধান, বিজেপি নেতা শিলাদিত্য দেবের পাল্টা দাবি, তাঁরা বাংলা, হিন্দির মতো ভাষাভাষী মানুষের উন্নয়নে বিপুল অর্থ খরচ করছেন। অসমের বাঙালিরা মনপ্রাণ থেকে বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিচ্ছেন। জিয়াউরের বক্তব্য, রাজ্যের মানুষ বিজেপি নেতাদের দুর্নীতি সম্পর্কে অবহিত। ভোটে এই ক্ষোভ টের পাওয়া যাবে। কংগ্রেস মুখপাত্র আমন ওয়াদুদের মতে, মানুষের মধ্যে অসন্তোষকে অস্ত্র করতে হবে।

ক্ষোভ কি আদৌ রয়েছে? আমজনতার মধ্যে ক্ষোভের আঁচ পাওয়া মুশকিল। ২০১৬ সালে বিজেপি অসমে ক্ষমতায় আসে। ২০২১-এ হিমন্তবিশ্ব মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি মুসলিমদের নিশানা করেছেন বলে বিরোধীদের দাবি। অসমে যে মুসলিম জনসংখ্যার ৩৫%। এর পরেও হিমন্তবিশ্বের জনপ্রিয়তা অটুট। বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধে মুসলিমদের নিশানা করার অভিযোগ তুললেও রাজ্যে তেমন অসন্তোষ নেই। বরং একাংশ মুসলিম মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন জানান। সিএএ-র বিরোধিতায় একযোগে বিরোধীরা নামলেও জনতার মধ্যে সাড়া মেলেনি।

অসমে সরকারি বিজ্ঞাপনে তাই এক জনেরই হাসি মুখ। হিমন্তবিশ্বশর্মা।

(শেষ)

Advertisement
আরও পড়ুন