‘শক্ত খুঁটি’তে দড়ি বাঁধা থাকলেই এমন দুঃসাহস সম্ভব
R G Kar Hospital Incident

স্বাধীনতা, তুমি কার?

স্বাধীনতা, তুমি কার? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের যে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়া তাঁর নিজের শিক্ষাঙ্গনে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় বাঁচার অধিকার পেলেন না, তাঁর?

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২৪ ০৯:১৩
স্ব-অধিকার: আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল, ১৩ অগস্ট।

স্ব-অধিকার: আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল, ১৩ অগস্ট। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

আজ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। উদ্‌যাপনের দিন। সাতাত্তর বছর আগে বহু সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমাদের মাথা তুলে বাঁচার অধিকার দিয়েছিল। উৎসবে, অনুষ্ঠানে, সুশোভিত মঞ্চের জ্ঞানগর্ভ ভাষণে আজ সারা দিন সেই সব কথা শুনতে হবে আমাদের।

Advertisement

স্বাধীনতা, তুমি কার? আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের যে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়া তাঁর নিজের শিক্ষাঙ্গনে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তায় বাঁচার অধিকার পেলেন না, তাঁর? না কি, তাঁর শরীরে যথেচ্ছ লুটপাট চালিয়ে প্রাণ কেড়ে নেওয়া এক (বা একাধিক) বিকৃতকাম নরাধমের? স্বাধীনতা, তুমি কি সেই ‘ক্ষমতাধর’দের, যারা ধর্ষিতা ও নিহত মেয়েটির বাড়িতে ফোন করে বলতে পেরেছিল, তিনি নাকি আত্মহত্যা করেছেন! তুমি কি সেই পুলিশদের স্বাধীনতা, যারা মেয়েটির দেহ ময়নাতদন্তের পরে হাসপাতালে অপেক্ষমাণ মা-বাবাকে না-জানিয়েই তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অধিকার ফলায়? তুমি কি কলেজের সেই অধ্যক্ষের স্বাধীনতা, যাঁকে ‘আশ্রয়’ দিতে খোদ সরকার কোল পেতে দেয়?

যে মানুষ কাঁদছে, তার পাশে ‘মানুষ’ হয়ে দাঁড়াতে বলেছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আমরা কি পারলাম? পারছি? পেরেছি? আজ বড় বেশি করে সেই আত্মানুসন্ধানেরও দিন। আর জি করের ঘটনার হাড় হিম করা অনুভব এখনও আমাদের বোধকে স্তম্ভিত করে রেখেছে। আমরা এখনও বুঝতে পারছি না, আরও কী কী তথ্য সামনে আসবে।

আমরা সঠিক জানি না, ধর্ষক ও খুনি এক জন, না একাধিক। জানি না, ঘটনায় ধৃত অমানুষটি কোথা থেকে কার বরাভয়ে পুষ্ট হচ্ছিল। আশ্চর্য লাগে, এই রকম ঘৃণ্য কীটের পরিচয় প্রকাশ করতে পুলিশ ঢোঁক গিলেছে! কেন? কিসের শঙ্কা? কিসের ক্লেশ? হাঁড়ির মুখ বন্ধ রাখতে চাওয়ার এই অপচেষ্টা কিসের ইঙ্গিত? কাউকে আড়াল করার?

তবে জানা যাচ্ছে অনেক কিছুই। যেমন, ওই ব্যক্তি কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার। থাকত পুলিশের একটি ব্যারাকে। আদতে সে নাকি প্রতিবেশী হিন্দিভাষী রাজ্যের। বিভিন্ন হাসপাতালে অবাধ যাতায়াত এবং নাড়িনক্ষত্র জানার ‘স্বাধীনতা’ সে পেয়েছিল অবশ্যই তার প্রশ্রয়দাতাদের কল্যাণে। তার জীবনধারায় মদে চুর হয়ে থাকা, যৌনপল্লিতে যাতায়াত, পর্নোগ্রাফি চর্চা ইত্যাদি তথ্য মিলছে। ওই রাতের ঘটনার পরে ব্যারাকে চলে যাওয়ার দুঃসাহসও দেখিয়েছিল সে।

সিভিক ভলান্টিয়ার হিসাবে কাদের নিয়োগ করা হয়, আজকের বাংলায় তা ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে হবে না। সরল সত্যি হল, হনুমানের বুক চিরে ‘রাম’ দেখানোর কাহিনির মতোই সিভিক-দের পোশাকের নীচে আরও একটি অদৃশ্য জামা থাকে। সেই জামাটি ঔদ্ধত্যের, যথেচ্ছাচারের ছাড়পত্র।

রোজকার জীবনে রাস্তার ট্র্যাফিকে, গাড়ি রাখার পার্কিংয়ে বা কোনও গেটের নিরাপত্তায় নিযুক্ত সিভিক-দের দুর্ব্যবহারের সঙ্গে পরিচিত অনেকেই। সবাই না-হলেও তাদের একাংশ তোলাবাজির ভঙ্গিতে টাকা আদায়ে সিদ্ধহস্ত। ইদানীং তো আইনকে কলা দেখিয়ে লাঠি তুলে মারতেও দেখা যাচ্ছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের।

রং দেখে নিয়োগ নাহয় বোঝা গেল। কিন্তু যাদের সিভিক-এর তক্‌মা দিয়ে বাজারে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারা কে? পুলিশের প্রক্রিয়ায় এ সব যাচাই করা হবে, এটুকু তো প্রত্যাশিত। অথচ ও সব কিছুই হয় না। অন্য কোনও ‘কার্যকর’ পন্থায় কাজ মেলে।

‘সিভিক’ সঞ্জয়ের অসংযত জীবনযাত্রাও এক দিনে তৈরি হতে পারে না। অভ্যাসে হয়। প্রশ্ন হল, পুলিশের ঠিকানায় বাস করে, দিবারাত্র পুলিশের ছাঁদনাতলায় ওঠা-বসা করে সে এটা চালিয়ে গেল কী করে? যারা তাকে পুষেছে এটা কি তাদের অন্ধত্ব, না অপদার্থতা? হতে পারে, দুইয়ের কোনওটিই নয়। আসলে এটা হয়তো ওই দুষ্কৃতীর ‘খুঁটি’র জোর! তবে যেটাই হোক, তার মদতদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা সমাজ প্রত্যাশা করবেই। বাকিটা প্রশাসনিক সদিচ্ছা।

এ বার ফিরে যাওয়া যাক আর জি করে। আমরা জানি, চিকিৎসক-তরুণীর পৈশাচিক খুনের পরে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোয শেষ পর্যন্ত ‘নৈতিক দায়’ মেনে নিজেই পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। সরকার তাঁকে আগলে রেখে কাজে ফিরিয়েছিল। কেন? কে তিনি? কত বড় প্রশাসক, কত মহান চিকিৎসক, কতখানি ছাত্র-দরদি যাঁকে ছাড়তেই পারে না সরকার?

স্বাস্থ্য-প্রশাসনের অন্দরে কান পাতলে ‘খুঁটি’র কথা ভেসে আসে এখানেও। সত্যি-মিথ্যে ‘স্বাস্থ্যেশ্বর’ জানেন! তবে শুনতে পাওয়া যায়, কোথাকার কী এক ‘নর্থ বেঙ্গল লবি’র দাসত্ব মানলে ওই দুনিয়ায় নাকি অনেক কিছুই সম্ভব। বস্তুত এর আগেও দেখা গিয়েছে, এক বার আর জি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে সরানোর অল্প দিন পরেই স্বপদে সেখানেই ফিরে এসেছিলেন সন্দীপবাবু। বিষয়টিকে তখন তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিবাদের আওতায় ফেলা হয়েছিল।

এ বার নিজে চাকরি ‘ছাড়তে চেয়ে’ পারেননি। অত বড় কাণ্ডের পরেও শীর্ষ কর্তারা গোড়ায় তাঁকে আর জি করেই রাখতে চেয়েছিলেন। পরে তাঁর পদত্যাগের ইচ্ছা এবং আর জি করের জটিল অবস্থা বুঝে তাঁকে সরানো হয় ন্যাশনাল মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পদে। অর্থাৎ হাই কোর্ট তাঁকে ‘লম্বা ছুটি’তে পাঠানোর আগে পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদটিই তাঁর বহাল ছিল। অবাক লাগে, একটি মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়াদের সুরক্ষা ও আনুষঙ্গিক পরিষেবা নিশ্চিত করতে যিনি ব্যর্থ, তাঁকেই অন্য কলেজে অধ্যক্ষ করতে যাওয়া! তা-ও আবার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যে। এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে?

মৃতার মা-বাবার বক্তব্যে জানা যাচ্ছে, তাঁদের নির্যাতিতা মেয়ের রক্তাক্ত দেহ যখন হাসপাতালের সেমিনার রুমে পড়ে রয়েছে, তখন নাকি এই হাসপাতালেরই সহকারী সুপার পরিচয় দিয়ে কেউ ফোন করে বলেছিলেন, তাঁদের মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার পরে তিন-চার দিনেও সেই তথ্য যাচাই করা হয়েছিল কি? পুলিশ কি নির্দিষ্ট ভাবে বলতে পেরেছে, ওই ফোন কার? বোধ হয় না। কিন্তু এটা যাচাই করা পুলিশের পক্ষে খুব শ্রমসাধ্য বা সময়সাপেক্ষ ছিল কি?

আসলে কোনও ঘটনার অভিঘাত যখন চরমে পৌঁছয়, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টা সেখানে দামি। বিশ্বাস করি, দীর্ঘ দিন মাঠে-ময়দানে লড়াই করে উঠে আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটা সবার চেয়ে ভাল বোঝেন। এ-কথাও ঠিক, বিরোধীর আন্দোলন এবং প্রশাসকের দায়বদ্ধতার মধ্যে ফারাক আছে। তবে প্রতিবাদের ব্যাপকতা বুঝে শাসককে কখনও রক্ষণাত্মক হতে হয়। মমতা জানেন, নন্দীগ্রামে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ওই ভুল করেছিলেন।

এক-একটি দিনের সঙ্গে আর জি করের ঘটনার প্রতিক্রিয়া বিস্তার পেয়েছে। এর পিছনে রাজনৈতিক মদত আছে, বলা বাহুল্য। সে পতাকা নিয়েই হোক, বা পতাকা ছাড়া। আবার রাজ্য ছাড়িয়ে দেশের অন্যত্র এই ঘটনার বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের প্রতিবাদ-আন্দোলন বিষয়টিকে জাতীয় রাজনীতির উপকরণ করে তুলেছে। যা সরকারের পক্ষে স্বস্তিকর নয়।

অথচ, মমতা শুরু করেছিলেন ইতিবাচক জায়গা থেকে। প্রথম দিনেই তিনি বলেছিলেন, সিবিআই ডাকতে তাঁর নীতিগত আপত্তি নেই। বলেছিলেন, অপরাধীর ফাঁসি চাইবেন। কিছু পদাধিকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপও করা হয়েছে। কিন্তু বিতর্কিত অধ্যক্ষের ‘পক্ষে’ সরকারের দাঁড়িয়ে যাওয়াই, মনে হয়, বিষয়টিকে অনেকটা জেদাজেদির স্তরে ঠেলে দিল।

আদালত যে ভাবে অধ্যক্ষকে তাঁর নতুন নিয়োগ সত্ত্বেও ‘ছুটি’তে পাঠাল এবং পুলিশকে তদন্তের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া সাত দিনের সময়সীমা না মেনে হাতে হাতে সিবিআইকে তদন্তভার দিল, তাতে রাজ্যের ভূমিকা আপাতত খর্ব হল বইকি। তবে এখন সামনে অন্যতম কর্তব্য, হাসপাতালগুলির পরিষেবা দ্রুত স্বাভাবিক করা। আন্দোলনকারীদেরও বোঝা উচিত, কোথায় থামতে হয়।

আরও পড়ুন
Advertisement