রাজধানীতে ভোট: সেই মেরুকরণ, খয়রাতি, কুকথার লড়াই
Delhi Election

দিল্লির বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন

২০১১ সালের জনগণনার এই তথ্য থেকে স্পষ্ট, দিল্লির একটা বড় অংশের মানুষ অন্যান্য রাজ্য থেকে এসে এই শহরে বসবাস করছেন। এমন কোনও রাজ্য নেই, যেখানকার মানুষ দিল্লিতে নেই।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:২৭
প্রত্যাশিত: তিলক পরিহিত আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল বেরিয়ে আসছেন পার্টি অফিস থেকে, দিল্লি, ১৫ জানুয়ারি।

প্রত্যাশিত: তিলক পরিহিত আপ নেতা অরবিন্দ কেজরীওয়াল বেরিয়ে আসছেন পার্টি অফিস থেকে, দিল্লি, ১৫ জানুয়ারি। ছবি: পিটিআই।

দিল্লির ১ কোটি ৬৭ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ৬৩ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষই আদতে অন্য রাজ্যের মানুষ। ২০১১ সালের জনগণনার এই তথ্য থেকে স্পষ্ট, দিল্লির একটা বড় অংশের মানুষ অন্যান্য রাজ্য থেকে এসে এই শহরে বসবাস করছেন। এমন কোনও রাজ্য নেই, যেখানকার মানুষ দিল্লিতে নেই। সেই অর্থে, দেশের রাজধানী আসলে একটা ছোট্ট ভারত। যেখানে বিন্দুতে সিন্ধুদর্শনের মতো গোটা ভারতের ছবি ফুটে ওঠে। একই ভাবে দিল্লির নির্বাচনের রাজনীতি দেখেও গোটা দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি টের পাওয়া যায়।

Advertisement

আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ৭০টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে দিল্লিতে। গত ২৬ বছর বিজেপি দিল্লির ক্ষমতার বাইরে। এর মধ্যে ১৫ বছর দিল্লিতে শীলা দীক্ষিতের নেতৃত্বে কংগ্রেসের সরকার ছিল। শেষ ১১ বছর অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি দিল্লির ক্ষমতায়। বিজেপি গত দশ বছর ধরে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায়। নরেন্দ্র মোদী দিল্লিতে বসে গোটা দেশের সরকার চালাচ্ছেন। অথচ বিজেপি দিল্লি বিধানসভায় ক্ষমতার ধারে-কাছেও আসতে পারেনি। এ বার বিজেপি তাই যথাসম্ভব শক্তি প্রয়োগ করছে। সেই নির্বাচনের লড়াই কেমন চলছে?

এক কথায় বললে, ঠিক যে ভাবে দেশের রাজনীতি চলছে। যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের মূল বিষয় হওয়া উচিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাস, বিদ্যুৎ, পরিস্রুত পানীয় জল, দূষণমুক্ত আবহাওয়া থেকে মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন। ছোট করে বললে, নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন। তার বদলে দেশের রাজনীতি এখন ধর্মীয় মেরুকরণ, মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার খয়রাতির প্রতিযোগিতা থেকে কুকথার লড়াই হয়ে উঠেছে। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনেও ঠিক সেই ছবি।

দিল্লির ক্ষেত্রে অবশ্য গোটা দেশের মানুষের অন্য রকম প্রত্যাশা ছিল। কারণ দিল্লিতে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টির জন্ম হয়েছিল দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন থেকে। খড়্গপুরের আইআইটি-র ছাত্র কেজরীওয়াল এই রাজনৈতিক ‘স্টার্টআপ’ তৈরি করে নিজেদের বাকি দলের থেকে আলাদা বলে দাবি করেছিলেন। এখনও আপ ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে, ‘কেন আমরা আলাদা’ শিরোনামের এক নাতিদীর্ঘ তালিকা রয়েছে।

কেজরীওয়ালের দলের দাবি, আম আদমি পার্টি আলাদা কারণ তার জন্ম দুর্নীতি বিরোধী লড়াই থেকে। তারা ভোটের খরচ, চাঁদায় স্বচ্ছতায় বিশ্বাসী। তারা জনমুখী শাসন ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধ। তারা পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী। এবং তারা ভিআইপি সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে।

গত ১১ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে সেই আম আদমি পার্টির শীর্ষনেতৃত্বের বিরুদ্ধেই এখন দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতি ঠেকাতে লোকপালের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অরবিন্দ কেজরীওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ঠিকই, দিল্লিতে লোকপাল নিয়োগ হয়নি। দিল্লির জন্য পূর্ণ রাজ্যের দাবি হিমঘরে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভোল পাল্টে দেওয়ার কথা বলেছেন কেজরীওয়াল। স্কুল, হাসপাতালের ভোল পাল্টেছে ঠিকই, তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আবাসও ভোল পাল্টে প্রাসাদে পরিণত। কেজরীওয়াল বলতেন, কেউ ঘুষ নিলে মোবাইলে তার ভিডিয়ো তুলে যেন তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন মদের দোকান খোলার লাইসেন্স বিলি করে আবগারি দুর্নীতির টাকায় আম আদমি পার্টি বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে ভোটে লড়েছে বলে বিজেপির পাশাপাশি কংগ্রেসেরও অভিযোগ। ক্ষতে প্রলেপ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মীর ভান্ডারের ধাঁচে মহিলা সম্মান যোজনায় টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেজরীওয়াল।

উল্টো দিকে বিজেপি কী ভাবে লড়ছে? একদা নরেন্দ্র মোদী যে রাজনীতির নিন্দা করতেন, ঠিক সেই খয়রাতির রাজনীতিই দিল্লিতে বিজেপির হাতিয়ার। নরেন্দ্র মোদী যখন থেকে টের পান, উগ্র হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদের ভরসায় রাজ্যের ভোট জেতা যাচ্ছে না, সেখানে আঞ্চলিক দলগুলি লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পে ভর করে ভোট জিতে নিচ্ছে, তখন থেকেই তিনি একে রেউড়ির রাজনীতি বা তিল-গুড়ের মিষ্টি বিলি বলে আক্রমণ করেছিলেন। এখন বিজেপি নিজেই মধ্যপ্রদেশ থেকে মহারাষ্ট্র লাডলী বহনা থেকে লাডকী বহীণের সাহায্যে ভোটে জেতার রাস্তা নিয়েছে। দিল্লিতেও তারই পুনরাবৃত্তি।

এক দিকে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি ২০৪৭-এ বিকশিত ভারত বা উন্নত অর্থনীতির স্বপ্ন দেখাচ্ছে। সেই বিজেপিই আবার দিল্লি শহরে ক্যান্টিন খুলে ৫ টাকার খাবার জোগাবে বলে আশ্বাস দিচ্ছে। দ্বিচারিতা? না কি পরোক্ষে আমজনতার রুটিরুজির সমস্যা মেনে নেওয়া?

ভারতের রাজধানী দিল্লি। সেই রাজধানী বছরের অধিকাংশ সময় দূষণের কালো চাদরে ঢাকা থাকে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে গোটা কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত মন্ত্রীর ঠিকানা দিল্লি। তাঁদের দফতর থেকে বাড়িতে দিনরাত বায়ু পরিশোধন যন্ত্র বা এয়ার পিউরিফায়ার চলে। আমজনতা শ্বাসকষ্টে ভোগেন। ফুসফুসে রোগ বাসা বাঁধে। অথচ দিল্লির ভোটে দূষণ নিয়ে কেউ কথা বলে না। দিল্লিতে বিজেপির সরকার নেই বলেই হয়তো মোদী সরকারও গত দশ বছরে দিল্লির দূষণ দূর করার চেষ্টা করেনি। শুধুই দোষারোপ চলেছে। বিজেপি দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকারকে দুষেছে। দিল্লির সরকার পঞ্জাব-হরিয়ানাতে ফসলের গোড়া পোড়ানোর দিকে আঙুল তুলেছে। কিন্তু মোদী সরকার মুখে কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতার মন্ত্র আওড়ালেও দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানার সরকারকে এক বারও সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসে সমাধানসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেনি। এ বার দিল্লি ভোটেও বিজেপির ইস্তাহারে দিল্লির দূষণ নিয়ে একটিও শব্দ নেই। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি, কংগ্রেস থেকে আম আদমি পার্টি সবাই দিল্লির দূষণ নিয়ে কথা বলেছিল ঠিকই, তবে লোকসভা ভোটে জিতে মোদী সরকার ক্ষমতায় এলেও দিল্লির দূষণ নিয়ে কোনও ইতিবাচক পদক্ষেপ করেনি।

বায়ুদূষণ নিয়ে কথা না বললেও অরবিন্দ কেজরীওয়াল মেনে নিয়েছেন, তিনি দিল্লির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা যমুনাকেও দূষণমুক্ত করতে পারেননি। তাই দিল্লির প্রতিটি কোণে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। দিল্লির রাস্তাঘাট ইউরোপীয় ধাঁচের করে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা-ও অধরাই থেকে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী যেমন লোকসভা ভোটের আগে বলেছিলেন, প্রথম দশ বছরে শুধু ভিত তৈরি হয়েছে। আসল কাজ এ বার হবে। ঠিক সেই ভাবে কেজরীওয়ালও এখন বলছেন, যে সব প্রতিশ্রুতি তিনি গত ১১ বছরে পূরণ করতে পারেননি, তা আগামী দিনে করবেন। তাই তাঁকে আবার ভোট দিয়ে মানুষ জিতিয়ে আনুক।

বাকি পড়ে থাকে হিন্দুত্ব ও ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগ খারিজ করে হিন্দু মন জয়ের চেষ্টায় দিঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি করে থাকেন, তা হলে অরবিন্দ কেজরীওয়ালও দিল্লির ভোটের আগে ‘সনাতন সেবা সমিতি’ খুলে ফেলেছেন। হিন্দু ধর্মগুরুদের সামনে রেখে ভোটের প্রচার করেছেন। হিন্দু পুরোহিত ও শিখ গ্রন্থিদের জন্য মাসিক অনুদানের কথা বলছেন। এমন নয়, আম আদমি পার্টি প্রথম বার হিন্দুত্বের পথে হাঁটছে। দিল্লি জুড়ে বিজেপি রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী নিয়ে ধুয়ো তুললেও আম আদমি পার্টির সরকার তা নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলেনি। উল্টে তীর্থ যাত্রা যোজনা থেকে রামায়ণের সুন্দর কাণ্ডের পাঠ আয়োজন করেছে। গত বাজেটে ২৩ মিনিটের বক্তৃতায় ৪৫ বার রামরাজ্যের কথা বলেছে।

পাঁচ বছর আগে সিএএ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে যে হিংসা হয়েছিল, তাতে মুসলিমরা আক্রান্ত হলেও আম আদমি পার্টি তা ঠেকানোর চেষ্টা করেনি। হিংসা বন্ধ করতেও সক্রিয় হয়নি। তাতে মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হলেও আম আদমি পার্টি নিশ্চিত, সংখ্যালঘুরা বিজেপির দিকে যাবেন না। তাঁদেরই ভোট দেবেন। ঠিক যে ভাবে অন্য রাজ্যে কংগ্রেস বা আঞ্চলিক দলগুলি সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে নিশ্চিত থাকে।

দিল্লির নির্বাচনী রাজনীতিতে সত্যিই গোটা দেশের রাজনীতির বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন হয়।

Advertisement
আরও পড়ুন