DA Controversy

মহার্ঘ ভাতা রাজ্য সরকারি কর্মীদের বেতনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কৃপার দান নয়

বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী বহু অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে বাজার গরম করার চেষ্টা করেছেন। করছেনও। ডিএ না দিয়ে গরিব মানুষের অনুদানের পক্ষেও কেউ কেউ সওয়াল করে দু’টি অংশের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দিচ্ছেন।

Advertisement
বিকাশ ভট্টাচার্য
বিকাশ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৩ ১৮:৩০
ডিএ নিয়োগকর্তার কৃপার দান— এ জাতীয় মানসিকতা ঔপনিবেশিক।

ডিএ নিয়োগকর্তার কৃপার দান— এ জাতীয় মানসিকতা ঔপনিবেশিক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সাম্প্রতিক কালে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, ইতিপূর্বে এমনটা কোথাও হয়েছে কি না, তা জানা নেই। ডিএ নিয়ে যে ঐক্যবদ্ধ লড়াই হচ্ছে, তা-ও অভূতপূর্ব। পথচলতি বহু মানুষও এখন জানতে চান, সরকারি কর্মচারীরা ডিএ কবে পাবেন।

মহার্ঘ ভাতা সরকারি কর্মীদের অধিকার না সরকারি কৃপা? বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রী বহু অবাঞ্ছিত মন্তব্য করে বাজার গরম করার চেষ্টা করেছেন। করছেনও। ডিএ না দিয়ে গরিব মানুষের অনুদানের পক্ষেও কেউ কেউ সওয়াল করে দু’টি অংশের মানুষের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দিচ্ছেন।

Advertisement

মূল কথা হল, ডিএ সরকারি কর্মচারীদের বেতনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডিএ নিয়োগকর্তার কৃপার দান— এ জাতীয় ঔপনিবেশিক মানসিকতায় অনেকেই প্রভাবিত। বাম সরকার আইন করে ডিএ-প্রাপ্তিকে সরকারি দায়বদ্ধতার আওতায় এনেছে। সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্রে একটি আদর্শ সরকারের যে ভূমিকা হওয়া উচিত, বাম সরকার সেটাই করেছিল।

কলকাতা হাই কোর্ট দীর্ঘ সওয়ালের পর রাজ্য সরকারি কর্মীদের ‘ডিএ ন্যায্য অধিকার’ বলে মেনে নিয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চের সেই রায় মেনে নিয়েছে রাজ্য সরকারও।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি, কেন্দ্রীয় হারে বা ‘অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স’ (এআইসিপিআই)-এর নিয়ম মেনে ডিএ দেওয়ার ক্ষেত্রে। চেন্নাই, দিল্লি শহরে কর্মরত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ও পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কর্মচারীদের এক হারে ডিএ দিতেও তাঁর আপত্তি। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা মেনে কাজ করতে মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি রয়েছে। একই রাজ্য সরকারের অধীনে কর্মচারীদের মধ্যে ডিএ বৈষম্য হয় কোন যুক্তিতে, তা বোঝা মুশকিল। স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য সরকারি কর্মচারী ও সরকার পোষিত সংস্থার কর্মচারীরা বিক্ষুব্ধ।

বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে এবং তার প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পড়ে। এই মূল্যবৃদ্ধিকে প্রশমিত করতে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়। সাধারণত এক জন সরকারি কর্মচারীর প্রারম্ভিক বেতন কাঠামো ঠিক হয় বেতন কমিশনের মাধ্যমে। এই বেতন কমিশন ১০-১২ বছর পর পর বসে এবং কর্মচারীদের বেতন সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়। যাতে তাঁদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ হয়। দুটো বেতন কমিশনের অন্তর্বর্তিকালীন সময়ে যে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে, সেটা প্রশমিত করতে সরকার তার কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দিয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে যত দিন বামফ্রন্ট পরিচালিত সরকার ছিল, ২০১১ সাল পর্যন্ত, কর্মচারীরা তাঁদের প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা পেয়েছেন প্রায় নিয়মিত ভাবেই। পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে বামফ্রন্ট সরকার ‘রোপা আইন, ২০০৯’ তৈরি করে এবং মহার্ঘ ভাতা প্রাপ্তিকে আইনি স্বীকৃতি প্রদান করে। এই আইনগত অধিকার কায়েম করার জন্য বর্তমান বাজারমূল্য বৃদ্ধি সূচকের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মহার্ঘ ভাতা প্রদানের আইন তৈরি করে। ২০১১ সালে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়। ক্ষমতায় আসীন হয় মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা কর্মচারীদের এই মহার্ঘ ভাতা প্রাপ্তির আইনসঙ্গত অধিকারকে অস্বীকার করে এবং তাঁদের প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা থেকে বঞ্চিত করতে থাকে।

এমতাবস্থায় ‘কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ়’ নামক একটি সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ট্রাইব্যুনাল (স্যাট)-এ মামলা করে। সেই সময় স্যাট রায় দেয়, মহার্ঘ ভাতা সরকারি কর্মীদের আইনসঙ্গত অধিকার নয়। সরকারি কর্মচারীদের এই সংগঠন সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে যায়। হাই কোর্ট রায় দেয়, মহার্ঘ ভাতা সরকারি কর্মচারীদের আইনসঙ্গত অধিকার। একই সঙ্গে হাই কোর্ট এটাও বলে যে, রাজ্যে এবং রাজ্যের বাইরে কর্মরত সরকারি কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সমহারে মহার্ঘ ভাতা পাবে কি না, তা স্যাট ঠিক করবে।

বর্তমান রাজ্য সরকার এই রায় পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জানায়। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এবং রাজ্য সরকারকে আবার ট্রাইব্যুনালে ফিরে আসতে হয়। স্যাট হাই কোর্টের রায়কে বহাল রাখে এবং বলে, কেন্দ্রীয় হারে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ দিতে হবে।

রাজ্য সরকার আবারও এই রায় পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জানায়। এবং আবারও প্রত্যাখ্যাত হয়।

এর পর রাজ্য সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সেই মামলাতেও দুই বিচারপতির বেঞ্চ ঘোষণা করে, মহার্ঘ ভাতা সরকারি কর্মীদের আইনসঙ্গত অধিকার। এবং সেই ভাতা তাঁদেরকে দিতেই হবে।

রাজ্য সরকার আবার পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জানায়। এবং তা আবারও খারিজ হয়।

বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার এ যাবৎ কাল পর্যন্ত মোট ছ’বার রাজ্য সরকারি কর্মীদের কাছে পরাস্ত হয়েছে। রোপা আইন, ২০০৯ মোতাবেক রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেস্কের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দিতে হবে।

সাধারণত রাজ্য সরকারি কর্মচারী এবং কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এক না হলেও যে হেতু রোপা আইন, ২০০৯ বর্ণিত মহার্ঘ ভাতা আইনসঙ্গত, সেই যুক্তি রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের সমহারে মহার্ঘ ভাতা প্রাপ্তির দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারও তার কর্মচারীদের অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেস্কের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে মহার্ঘ ভাতা দেয়। অর্থাৎ, অল ইন্ডিয়া কনজিউমার প্রাইস ইনডেস্কের বা কেন্দ্রীয় মূল্যবৃদ্ধি সূচকই এই দুই পৃথক শ্রেণির কর্মচারী গোষ্ঠীকে সম অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে।

(লেখক সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ এবং কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবীমতামত নিজস্ব।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement