ভারতে জমি অধিগ্রহণের ইতিহাস নির্মম। প্রায় সাড়ে ছ’কোটি মানুষকে হটতে হয়েছে, যার সিংহভাগ আদিবাসী। উন্নয়নের ফসল তাঁরা পাননি। ডেউচা-পাঁচামিতেও যাঁদের জমির তলায় কয়লা মিলেছে, তাঁরা সরেন, মুর্মু, বাস্কে, টুডু, মান্ডি। আর আছে কিছু দলিত ও মুসলিম পরিবার। কাজেই পুরনো আশঙ্কাগুলি থেকেই যায়।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষতিপূরণের ঘোষণা ওই মানুষগুলিকে স্বস্তি দিতে পারে। ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন অনুসারেও জমি অধিগ্রহণ করার জন্য গ্রাম সংসদে আলোচনা করা দরকার। তা ছাড়া জমি-জীবিকা হারানোদের আলাদা করে চিহ্নিত করা, পূর্ণ ক্ষতিপূরণ আগে দিয়ে তার পর জমি অধিগ্রহণ, অধিগ্রহণের পরে উচ্ছেদ-হওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের ও পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জমির বাজারদরের কমপক্ষে দ্বিগুণ করা— এমন নানা শর্ত রয়েছে। সঙ্গে সামাজিক ক্ষতি মূল্যায়ন করা ও তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার কথাও আছে। স্বীকার করা হয়েছে যে, জীবিকা হারানোদের মধ্যে খেতমজুর, ভাগ চাষি, ঠিকা চাষি, মৎস্যজীবী, বনবাসী-সহ অন্যরাও পড়েন। পরিবেশের ক্ষতির মূল্যায়নও হওয়ার কথা।
এখনও পর্যন্ত সংবাদে যত কথা উঠে এসেছে, তাতে স্বস্তির পাশাপাশি সংশয়ের কারণও থেকে যাচ্ছে। প্রথমত গ্রাম সভা, গ্রাম সংসদে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কোনও আলোচনা হয়নি; দুই, পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম সামাজিক ক্ষতি মূল্যায়ন করেছে বলে জানা গিয়েছে, কিন্তু তা জনসমক্ষে আনা হয়নি। পরিবেশের ক্ষতির মূল্যায়ন হয়েছে কি? কত জন জমি-জীবিকা হারাচ্ছেন, তার তালিকাও জনসমক্ষে নেই। জমির বাজারদর কত হিসাব হল, তা-ও জানা নেই। যে প্রতিশ্রুতিগুলি মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় দাঁড়িয়ে দিয়েছেন, তা এখনও কোনও সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়নি। কতটা জমি অধিগ্রহণ হতে চলেছে, তারও কোনও গেজেট নোটিফিকেশন এখনও অবধি বার হয়নি।
এ বছর জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম ‘সামাজিক উন্নয়ন ইউনিট’ প্রতিষ্ঠার জন্য টেন্ডার ডেকেছিল। তাতে বলা ছিল, ১০টি মৌজায় ১৯টি গ্রামে ৩০১০টি মতো পরিবার আছে, যারা এই প্রকল্পে প্রভাবিত হবে। ৩৪০০ একর মতো জমি এই প্রকল্পের জন্য আপাতত চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই ইউনিটের কাজ হবে সামাজিক ক্ষতির মূল্যায়ন করা, ক্ষতিপূরণ পৌঁছে দেওয়া, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অভিযোগ নিরসনের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এই ইউনিটের তিন বছর কাজ করার কথা। কোন সংস্থা এই বরাত পেল, তা জনসমক্ষে বলা হয়নি। এই টেন্ডারের সঙ্গে ২০১৩ সালের আইনের কিছু অসঙ্গতিও লক্ষ করা যায়, যেমন খেতমজুর এবং ওই জমি-নির্ভর অন্য সম্ভাব্য মানুষগুলির কথা এই টেন্ডারে নেই, গ্রাম সভা বা গ্রাম সংসদের কথা নেই। সামাজিক ক্ষতি মূল্যায়ন কী বলছে, তা মানুষকে বোঝানোর কথা নেই; জনসমক্ষে আনার কথাও নেই। টেন্ডার থেকে মনে হয় যে, সরকার শুধু ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসনের বিষয়টাতেই জোর দিতে চাইছে। বিভিন্ন সংবাদে ইঙ্গিত মিলছে যে, সরাসরি গ্রামে বসে মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে পারস্পরিক আস্থা তৈরি করার কাজটাও সে ভাবে হয়নি।
‘সিঙ্গুরের মতো জোর করে জমি অধিগ্রহণ করব না’, জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু, কী ভাবে জমি নেওয়া হবে তা হলে? উপায় চারটি— জমি কেনা, জমি অধিগ্রহণ, স্বেচ্ছায় জমি দান, আর জমি ‘পুলিং’। শেষ পদ্ধতিটি নিয়েছিলেন চন্দ্রবাবু নাইডু। অন্ধ্র-তেলঙ্গানা বিভাজনের পর অমরাবতীতে নতুন রাজধানী গড়ে তোলার জন্য প্রায় ৩০ হাজার একর জমি নিয়েছিলেন চন্দ্রবাবু, ‘ল্যান্ড পুলিং’-এর মাধ্যমে। জমি অধিগ্রহণ নয়, মানুষকে বলা হয়েছিল যে, সরকারকে জমি দিলে নতুন রাজধানীতে তাঁদের বাড়ি করার, ব্যবসার জমি মিলবে। সঙ্গে বছরে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করে দশ বছর ধরে পেনশন, আর তার সঙ্গে চাকরি। ভূমিনির্ভর খেতমজুরদের সরকার দেবে মাসিক ২৫০০ টাকা পেনশন। সরকারকে বিশ্বাস করে কয়েক হাজার পরিবার জমি দিয়েছিল; যারা দেয়নি, পুলিশ তাদের মেরে ধরে জমি লিখিয়ে নিয়েছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন, জগন রেড্ডি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর অমরাবতীর গুরুত্ব কমে গিয়েছে। শর্তপূরণ হয়নি, তাই অনেকে জমি ফেরানোর আন্দোলনে নেমেছেন।
ডেউচা-পাঁচামিতে আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের পর ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসনের কাজে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয়ের কারণ এখনই উপস্থিত হয়নি। তবে মনে রাখতে হবে, ভারতের রাজ্যগুলির সামনে গণতান্ত্রিক এবং মানবিকতাপূর্ণ উপায়ে জমি অধিগ্রহণের দৃষ্টান্ত তেমন নেই। এই প্রেক্ষিতে সরকার, এবং ওই জমির যাঁরা বাসিন্দা, দু’পক্ষকেই সতর্ক থেকে, আইন মেনে, স্বচ্ছতা বজায় রেখে জমি হস্তান্তর ও পুনর্বাসন-ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে হবে।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়