যে দেশের সঙ্গে নাড়ির যোগ
Bangladesh

অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যেন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ছাপ না ফেলে

২০০৮-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশে নির্বাচনের পরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। তার পরে দিল্লিতে পট পরিবর্তন হয়েছে।

Advertisement
প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:২৮
পারাপার: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সেতুবন্ধনের কাজ করতে পারে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মান। পদ্মা সেতু।

পারাপার: ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে সেতুবন্ধনের কাজ করতে পারে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মান। পদ্মা সেতু। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স।

বা‌ংলায় যাকে বলে বকুনি, সেই বকুনিই দিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। না, কংগ্রেসের কোনও নবীন নেতাকে নয়। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতাকে।

২০০৭-০৮ সালের কথা। খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদ ফুরোনোর পর বাংলাদেশে তখন জরুরি অবস্থা। কেয়ারটেকার সরকার চলছে। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা, দু’জনেই বন্দি। ভারত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দৌত্য করছে। খালেদা ও হাসিনার মুক্তির জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ জব্লিউ বুশের সঙ্গে কথা বলছেন প্রণব। সেই সময়ই আওয়ামী লীগের কিছু নেতা দল ছাড়েন। প্রণব পরে তাঁর স্মৃতিকথা দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স-এ লেখেন, “যখন আওয়ামী লীগের কিছু নেতা জেলে থাকার সময় হাসিনাকে ছেড়ে চলে যান, আমি তাঁদের এই অবস্থানের জন্য বকুনি দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কারও দুঃসময়ে তাঁকে ছেড়ে যাওয়াটা অনৈতিক।”

Advertisement

২০০৮-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশে নির্বাচনের পরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। তার পরে দিল্লিতে পট পরিবর্তন হয়েছে। দু’দেশের সম্পর্ক অবশ্য তাতে বিশেষ চিড় খায়নি। মোদী সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের কূটনীতিকরা প্রায়ই দাবি করেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এখন ‘সোনালি অধ্যায়’ চলছে। আজ ঢাকায় বাংলাদেশের বিজয় দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ উপস্থিত থাকবেন।

দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে গত দু’বছরে বার বার একটি বিষয়েরই কালো ছায়া পড়েছে। তা হল রাজনীতি। বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক কর্মসূচি। নয়া নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-র বিরুদ্ধে শুধু যে এ দেশে প্রতিবাদ হয়েছে, তা নয়। তা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ছায়া ফেলেছে। হিন্দুত্বের রাজনীতি করতে গিয়ে বিজেপি নেতারা কখনও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ করেছেন। কখনও বলেছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চলছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রে নির্যাতনের শিকার হিন্দুদের এ দেশে আশ্রয় দিতে নয়া নাগরিকত্ব আইন আনতে গিয়ে মোদী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে একই বন্ধনীতে ফেলেছে। ৫০ বছর আগে যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত।

এই সিএএ বাংলাদেশের মননে কতখানি বিরক্তি তৈরি করেছিল, তার প্রমাণ মিলেছিল গত মার্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময়। কোভিড অতিমারির পরে প্রথম বার বিদেশ সফরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। উপলক্ষ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। কিন্তু মোদীর সফরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে এমন বিক্ষোভ, হিংসা ছড়িয়ে পড়ে যে, তা থামাতে হাসিনা সরকারকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল।

বাংলাদেশ প্রশ্নে গত দু’বছরে মোদী সরকার তথা বিজেপি কার্যত দ্বিধাবিভক্ত থেকেছে। একই সঙ্গে দু’টি মুখ কথা বলেছে। এক জন অমিত শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে তিনিই ছিলেন বিজেপির সেনাপতি। অন্য জন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। শাহ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’ তকমা দিয়েছেন। অনুপ্রবেশের সমস্যা কাল্পনিক নয়। কিন্তু তা রুখতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন দোলাচল তৈরি করেছে যে, তা সামলাতে বার বার বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে মাঠে নামতে হয়েছে।

এই ভারসাম্যের খেলার সবচেয়ে বড় উদাহরণ গত বছরের দুর্গাপুজো। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপরে কিছু হামলার ঘটনাকে হাতিয়ার করে সে সময় পশ্চিমবঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী, অসমে রাজদীপ রায়ের মতো বিজেপি নেতারা বার বার সরব হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ, অসমে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক ঝোলায় পুরতে তাঁরা মোদী সরকারের কাছে দাবি করেছিলেন যে, বাংলাদেশে হিন্দুদের রক্ষায় দিল্লি হস্তক্ষেপ করুক। দেশভাগের ক্ষত খুঁচিয়ে তুলতেও বিজেপির নেতারা কসুর করেনি। এক দিকে বিজেপি নেতারা হিন্দুত্বের রাজনীতি করেছেন। অন্য দিকে দিল্লিতে বিদেশ মন্ত্রক বলে গিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ করছে। সরকারের সহযোগিতায়, বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের সহযোগিতায় দুর্গাপুজোও নির্বিঘ্নে চলছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময় বলেছিলেন, তিনি হিংসায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করছেন। সেই সঙ্গে ভারতকেও এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এমন কিছু যেন না হয়, যাতে তাঁর দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে আঘাত আসে। হাসিনা সিএএ-কে বরাবরই ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু এই আইনের কোনও প্রয়োজন ছিল না বলেও মত দিয়েছিলেন তিনি।

মোদী সরকার সংসদে নয়া নাগরিকত্ব আইন পাশ করানোর পরেও তা এখনও রূপায়ণ করেনি। বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা কিছু দিন আগেই বাংলাদেশে ঘুরে এসেছেন। কূটনীতিকের দাবি, সিএএ অথবা দুর্গাপুজোয় বাংলাদেশে হিংসার ঘটনা নিয়ে কোনও অস্বস্তির চিহ্ন তাঁর চোখে পড়ছে না।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই সে দেশে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা আলফা ও অন্য জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতে শুরু করেন। চাপের মুখে আলফার শীর্ষনেতারা ভারতে ফিরে কার্যত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। মোদী সরকারের আমলে দু’দেশের মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিস্তা চুক্তি এখনও অধরা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। মমতা এখনও রাজ্যের স্বার্থের জন্য তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাঁর আপত্তিতে অনড়। এখানেও কূটনীতিতে ছায়া ফেলেছে রাজনীতি। তিস্তার জল বাংলাদেশের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই তা উত্তরবঙ্গের আধ ডজন জেলারও জীবনরেখা। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক শিবিরের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতও তিস্তা নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে উঠেছে।

উপমহাদেশে বাংলাদেশ এখন বোধ হয় একমাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যেখানে চিন ছড়ি ঘোরাতে পারে না। বিজেপি নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে, হিন্দুত্বের রাজনীতিতে বাংলাদেশকে নিশানা করলে সেখানে জামাত ও মৌলবাদী সংগঠনগুলিই প্রশ্রয় পাবে। আখেরে লাভ হবে পাকিস্তানের। পাকিস্তানকে মদত দেবে চিন।

২০০৮-এ কেয়ারটেকার সরকারের আমলে বাংলাদেশের তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন অহমেদ ভারত সফরে এসেছিলেন। অভিযোগ উঠেছিল, তাঁর ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ মেনে এক সঙ্গে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কেরিয়ার শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রণব মুখোপাধ্যায় মইনকে বুঝিয়েছিলেন, হাসিনা হোন বা খালেদা, সব রাজনৈতিক বন্দিকেই মুক্তি দিতে হবে। মইনের আশঙ্কা ছিল, হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাঁর উপরে কোপ পড়বে। প্রণব আশ্বাস দিয়েছিলেন, হাসিনা ক্ষমতায় এলেও যাতে মইন ক্ষমতাচ্যুত না হন, সে দায়িত্ব তাঁর। বহু বছর পরে মইনের আমেরিকার চিকিৎসার সময়ও প্রণববাবু সাহায্য করেছিলেন।

এ দেশের রাষ্ট্রনেতা থেকে কূটনীতিক, বার বার একটা কথা বলেছেন— ভারত-বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়; দু’দেশে নাড়ির যোগ। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, ভৌগোলিক নৈকট্যের কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া দরকার। একে অপরের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সম্মান জানাতে হবে। ঘরোয়া রাজনীতিতে ফয়দা তুলতে গিয়ে বিজেপি নেতারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বতে আঘাত করতে চান। তার ধর্মনিরপেক্ষ নীতির দিকে আঙুল তুলে ফেলেন। রাজনীতি যাতে কূটনৈতিক বন্ধুত্বে ছাপ না ফেলে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।

আরও পড়ুন
Advertisement