দেওয়া-নেওয়ার অঙ্ক
TMC

ঘুঘুর বাসা ভাঙাই এখন প্রশাসনের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ

সিপিএমের প্রতাপের কালেও অনেক কিছু হয়েছে, যার সঙ্গে আজকের তৃণমূল শাসকদের জমানার বিশেষ তফাত নেই।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২২ ০৭:৫৯
 প্রাপ্তি: পুর-নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ের পর উল্লাস, বীরভূম, ২ মার্চ।

প্রাপ্তি: পুর-নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ের পর উল্লাস, বীরভূম, ২ মার্চ। পিটিআই

পুরভোটের রাজনীতি ছিল এক রকম। এখন পুরবোর্ড গঠনের সময় তা অন্য আকার নিয়েছে। বোর্ড তৈরি হওয়ার আগেই দু’টি পুরসভায় শাসক তৃণমূল এবং বিরোধী কংগ্রেসের দুই সদ্য নির্বাচিত প্রতিনিধি খুন পর্যন্ত হয়েছেন। কেন, সেই সব তর্ক বহু দূর বিস্তৃত। তদন্ত ইত্যাদি নিয়েও জল বিস্তর ঘোলাচ্ছে। তবে জোড়া খুনে রহস্যের গন্ধ যে তীব্র, তাতে সন্দেহ নেই।

প্রেক্ষিত কিছুটা পৃথক হলেও একই সময়ে রামপুরহাটে তৃণমূলের এক পঞ্চায়েত উপপ্রধানের খুন এবং তার পরের অগ্নি-তাণ্ডবে আরও অনেকের জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার ঘটনাটিও অশান্তির বন্ধনীতে কিছুমাত্র কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমন ঘটনার পিছনে কতটা রাজনীতি, কতটা গ্রাম্য বিবাদ বা পারিবারিক কারণ, সে সব নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে যাওয়া যুক্তির আড়াল মাত্র।

Advertisement

সোজা কথা হল, কোনও ক্ষমতাসীন জনপ্রতিনিধির খুনের জেরে সংগঠিত ভাবে প্রতি-আক্রমণ হয়ে থাকলে তাকে কোনও ভাবে অ-রাজনৈতিক বলে ধরে নেওয়া যায় না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সবের মূলে খুঁজে পাওয়া যায় ভাগ-বাঁটোয়ারার কাহিনি। সেটা জমি-টাকা-দালালি যা-ই হোক। সেখানে ‘চক্রান্ত’-এর চরিত্রটিও একেবারে অন্য রকম।

বস্তুত শাসন-কাঠামোর একদম নিচুতলায় অর্থাৎ পুরসভা থেকে পঞ্চায়েত পর্যন্ত যে ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে বহু ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতার অভাব খুবই স্পষ্ট। শাসক নেতারা বা সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যতই ধমক-চমক-হুমকি-ফরমান দিন না কেন, এই সব ঘুঘুর বাসা ভাঙা যায় না। আগে কোনও দলের কেউ সফল হননি, আজও এটা হওয়ার নয়। বরং প্রবণতা ক্রমে বেড়ে চলে। এই সারসত্যটুকু মেনে নেওয়াই ভাল। নইলে ক্ষমতাসীনদের মুখের চুন-কালি ঢাকার চেষ্টা দ্রুত প্রহসনে পরিণত হতে বাধ্য।

সিপিএমের প্রতাপের কালেও অনেক কিছু হয়েছে, যার সঙ্গে আজকের তৃণমূল শাসকদের জমানার বিশেষ তফাত নেই। যেমন, বাম-রাজত্বে পঞ্চায়েত স্তরে ‘পঞ্চুবাবু’ বলে একটি পরিচিতি চালু হয়ে গিয়েছিল। সেই পঞ্চুবাবুরা হলেন মূলত ক্ষমতাভোগী পঞ্চায়েত প্রধান বা সদস্য। কোথাও কোথাও সঙ্গে শাসক দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরাও। সেই সময় গ্রামে লিখন দেখা যেত, ‘আমার মাথায় খড়ের চালা, পঞ্চুবাবুর পাঁচতলা’: অর্থ পরিষ্কার। ক্ষমতায় বসে পঞ্চুবাবুদের ‘কপাল’ খুলেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যে ঢুঢু! তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কয়েক বছর পরে এক বার পূর্ব মেদিনীপুরে নন্দীগ্রামের পথ ধরে যেতে গিয়ে নজর করেছিলেন এক তৃণমূল নেতার বাড়ির দিকে। সেই চোখধাঁধানো বাড়িটি সেখানে যে কত ‘বেমানান’, তিনি নিজেই সেটা বলেছিলেন।

আর ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ধাক্কার পরে মানুষের মন ফেরাতে গিয়ে ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচিতে শাসক দলের যে চেহারা বেরিয়ে এল, তা তো স্মৃতিতে এখনও টাটকা। শুধু তা-ই নয়, তখন চর্মচক্ষে প্রমাণিত হল, নিচুতলায় দুর্নীতির ভিত কত মজবুত!

এটা ঘটনা যে, দিনকাল বদলেছে। প্রত্যন্ত গ্রামের জীবনযাপনেও সেই পরিবর্তনের ছবি ধরা পড়ে। আজ হয়তো তাই গ্রামে কোঠা বাড়ি বা মোটরবাইকের সংখ্যাও অনেক বেশি।

কিন্তু পাঁচ বছরের মেয়াদে যাঁরা পুরসভা ও পঞ্চায়েতের ভোটে জিতে আসেন, তাঁদের একাংশের কাছে বিষয়টি যে প্রধানত ‘করে খাওয়া’-র চাবি, সেটা আজও আগের মতো অলিখিত সত্য। সাদা চোখেই তা ধরা পড়ে। এ কাজের কুশীলবেরা সব আমলেই শাসকপক্ষের আশ্রয়ে থাকেন। কারণ তাঁরাই ‘নিতে’ এবং ‘দিতে’ পারেন। দলনির্বিশেষে এটা শাশ্বত।

এখন কোনও দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি দাবি করেন, নীচের তলার এই সব কীর্তিকলাপ তাঁদের ‘জানা নেই’, তা হলে তর্কের খাতিরে সেই যুক্তিতে মান্যতা দিতে হয়। সত্যিই তো, ক্ষমতার রেলগাড়ি লম্বা হতে থাকলে সামনের ইঞ্জিনের সঙ্গে পিছনে গার্ডের কামরার সরাসরি সংযোগস্থাপনে অসুবিধা হতেই পারে। এটাকে বৃদ্ধির সমস্যা বলা যায়। কিন্তু রোগ ধরা পড়ার পরেও যদি ‘ওষুধ’ কাজ না করে, তা হলে?

এ বার পুরভোটের আগে থেকে তৃণমূলে যে পর্ব শুরু হয়েছিল, ভোটের ফল বেরোনোর পরে বোর্ড গড়ার ক্ষেত্রে তার চেহারা আরও বিশৃঙ্খল। যদিও প্রায় সব পুরসভায় তৃণমূল জিতেছে। সে তুলনায় গোলমালের সংখ্যা ‘নগণ্য’ বলার মধ্যেও হয়তো খুব অসত্য কিছু নেই। কিন্তু ঘটনা হল, এক কলসি দুধে দু’ফোঁটা চোনা পড়লে যা হয়, দু’গ্লাস চোনা ঢাললেও তার নিট ফল খুব একটা বদলায় না। সেই দুধ পানের অযোগ্যই থেকে যায়।

এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে বড় ভুল হবে। তাই সবচেয়ে জরুরি হল বিষবৃক্ষদের যত বেশি সম্ভব অঙ্কুর থেকে বিনষ্ট করা। যাতে ফের তা পল্লবিত হতে না পারে। এ এক দুরূহ পরীক্ষা! তৃণমূল এখন তার মুখোমুখি হয়েছে।

মমতার দিক থেকে এ বার এই ব্যাপারে একটি সচেতন বার্তা ছিল গোড়াতেই। কলকাতা থেকে শুরু করে জেলাগুলিতে পুরপ্রার্থী বাছাই পর্বে তাঁর দলের মধ্যে এ বার কতটা চাপ, কতটা টানাপড়েন চলেছিল, সেটা প্রকাশ্যে এসেছে। যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্তরে দুর্নীতি, জীবনযাপনের মান হঠাৎ বদলে যাওয়া প্রভৃতি নিয়ে প্রশ্ন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে থাকা ক্ষোভের কথা তখনও খোদ মমতার কানে পৌঁছয়।

তার ফলে প্রার্থী-পদে সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েক জন বাদ যান। তাঁদের মধ্যে যাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে নির্দল হয়ে লড়েছেন, মমতার নির্দেশে দল তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও করে। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল নেত্রীর উদ্যোগ তাঁর দলের নেতাদের নজরে পড়েছিল। এ সবই আমরা জানি।

কিন্তু ভোট মেটার পরে বিপুল সংখ্যাধিক্যে জয়ী তৃণমূলের এক-একটি বোর্ড গড়াকে কেন্দ্র করে আরও যা যা ঘটছে, তাতে ‘লাভালাভের অঙ্ক’ খুব গোপন থাকছে না। দলের উপরতলার নেতারা এর যত ব্যাখ্যাই দিন না কেন, কাজের স্বচ্ছতার দিক থেকে বিষয়টি উদ্বেগের বলা চলে।

তার কারণ অনেক। প্রথমত, এর থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, শাসক দলের শীর্ষ থেকে আসা নির্দেশ বা উপদেশ নীচের তলা মানছে না। মমতার দলে এমনটা যে শুধু বিরল, তা-ই নয়। এর ফলে প্রমাণ হয়, ক্ষমতার ‘মধুভাণ্ড’ দখল করতে লড়াই কত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি আজ যাঁরা ‘মধু’ পেলেন না, অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা তলায় তলায় কে কোথায় কী ভূমিকা নেবেন, সেই প্রশ্নও উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

দ্বিতীয় হল, সরাসরি মাছ না খেয়ে ঘুরপথে মাছের ঝোল খাওয়ার কৌশল। যেমন ধরা যাক, অনুরোধ-উপরোধ-সুপারিশ-চাপ সব মিলিয়ে এমন কাউকে হয়তো কোথাও কোনও বোর্ডের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হল, যাঁর ঘনিষ্ঠতম কোনও আত্মীয়ের ‘ভাবমূর্তি’ নিয়েই গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। কোথাও হয়তো কোনও বড় নেতার ব্যক্তিগত অনুচর একটি দায়িত্বপূর্ণ চেয়ার পেয়ে গিয়েছেন। এ বার সেই সব বোর্ডের কাজ কেমন হতে পারে, সেটা অনুমানসাপেক্ষ। ক্ষমতা ‘পাইয়ে’ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পুরবোর্ডে পদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার বিযয়টিও এখন চর্চায়।

আর একটি ব্যাপার হল ভোটে প্রার্থী-পদের মতোই বোর্ডে পদ পাওয়ানোর উমেদারি। যে সব স্বার্থান্বেষী নেতা, বিধায়ক কোনও ‘খুঁটি’ ম্যানেজ করতে পারছেন, তাঁরা যত দূর সম্ভব ‘হাতের’ লোকেদের দিয়ে বোর্ড গড়ার বন্দোবস্ত করে ফেলছেন। হিসাব যেখানে পাকা। আজ এঁদের সংখ্যাই বোধ হয় সর্বাধিক।

মমতা নিশ্চিত ভাবে এর অনেক কিছুই জানেন না। তাঁর স্তরে এত খুঁটিনাটি জানার কথাও নয়। তবে এটা ঠিক যে রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক তিনিই, সুতরাং দায়টা তাঁর উপরেই বর্তায়।

আরও পড়ুন
Advertisement