প্রশাসন-যন্ত্রের কলকব্জা নড়বড়ে হলে ফল বিষময় হতে পারে
Politics

College Politics: হাতে লাঠি, কানে জবাফুল!

বছর চারেক আগে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষককে চড় মারার অভিযোগে ‘খবর’ হয়েছিলেন জনৈক গৌরব দত্ত মুস্তাফি।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২২ ০৫:২৪

গিয়াসুদ্দিন মণ্ডল নামের মনুষ্যেতর প্রাণীটিকে আমি চিনি না। তবে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে হেনস্থার যে ভিডিয়ো সামনে এসেছে, তার ধাক্কায় জানতে পারা গেল, ওই দু’-পেয়ে মনুষ্যেতরটি তৃণমূলে বাস করত। তাকে নাকি তিন বছর আগে দলের ছাত্র সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

যুক্তি বলে, বহিষ্কার তাঁকেই করা যায়, যাঁর কোনও না কোনও পদ বা পরিচিতি থাকে। নিতান্ত নামগোত্রহীন কাউকে বহিষ্কার করা, না করা একই রকম অর্থহীন। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে, তৃণমূল ছাত্র পরিষদে উক্ত প্রাণীটির কোনও নির্দিষ্ট অবস্থান ছিল। সংশয় জাগে, কস্মিন্কালে শিক্ষার বুনিয়াদ পাঠটুকু সে পেয়েছিল তো!

Advertisement

শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিতে এমন মণিরত্নের সমাহার অবশ্য হালফিল বিরল বলা যাবে না। কয়েক বছর পিছিয়ে গেলে মনে পড়বে ভাঙর কলেজে পরিচালন সমিতির বৈঠকে শিক্ষিকার দিকে জলের জগ ছুড়ে মারার ঘটনা। তাতে শিরোনাম হন আরাবুল ইসলাম। তৃণমূল নেতৃত্বের চোখে তিনি আবার ‘দলের সম্পদ’ বলে খ্যাত।

বছর চারেক আগে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষককে চড় মারার অভিযোগে ‘খবর’ হয়েছিলেন জনৈক গৌরব দত্ত মুস্তাফি। এখন তিনিও নাকি উত্তর কলকাতার তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের এক পদাধিকারী! এমন আরও অনেক দৃষ্টান্ত রায়গঞ্জ থেকে কোন্নগর— নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে।

অন্য দিকে গিয়াসুদ্দিনের ঘটনাটি যে ভাবে পরতে পরতে খুলছে এবং বিবিধ ফোনালাপের অডিয়ো থেকে যে ভাবে একের পর এক কেষ্টবিষ্টুর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এর শিকড় কত গভীরে, বোঝাই যায়। তবে এটা ঘটনা যে, শাসক দলের ছত্রছায়া মানে যা খুশি তা-ই করার ‘ছাড়পত্র’, এই ধারণা তিল-তিল করে রাজনীতিতে বাসা বেঁধেছে।

শুধু আজ তৃণমূলের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য নয়, অতীতে সিপিএমের রাজত্বেও দলীয় বর্গিদের উৎপাত দেখা যেত। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে তাদের ‘আদেশ’ ছিল শেষ কথা। শিক্ষাক্ষেত্রেও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ন্যক্কারজনক দাদাগিরি আমরা ধারাবাহিক ভাবে দেখেছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে সিপিএমের ছাত্র ও কর্মীদের দ্বারা কী পরিমাণ মানসিক পীড়ন ও অত্যাচার সইতে হয়েছিল, তা ভোলার নয়। একের পর এক কলেজে অধ্যক্ষ ঘেরাও থেকে শুরু করে ঘেরাও-আক্রান্ত অধ্যক্ষার মৃত্যু পর্যন্ত নানা ঘটনায় তখনকার শাসক সিপিএমের দিকে অভিযোগ ও প্রতিবাদের আঙুল উঠেছে বার বার। কোনও বিচার মেলেনি। এঁরাই এখন আবার ভোল পাল্টে ‘সাধু’ সাজেন! যদিও ইতিহাস তাতে বদলায় না।

একই ভাবে ‘সিপিএম আমলেও এমন হয়েছে’ বলে আজ তৃণমূল নিজেদের অপকীর্তি ঢাকতে পারে না। যদি তা করতে চায়, তবে সেটা আরও বড় অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত। কোনও ঘটনা ঘটার পরে দু’চারটি গ্রেফতারে তার ক্ষালন হয় না। কারণ মানুষ যখন বদল আনে, তখন তাতে সর্বাঙ্গীণ পরিবর্তন দেখতে চায়। সেটা শিক্ষাঙ্গনে, রাজনীতিতে, প্রশাসনিক বা পুলিশি ব্যবস্থায়, যেখানেই হোক। অনেক ফাঁক যে ধরা পড়ছে, তাতে কিন্তু সন্দেহ নেই।

তবে এর সবটাই শাসকবর্গের একার দায় বলেও মনে করি না। বরং বলব, বিভিন্ন ঘটনার নিরিখে প্রশাসনিক স্তরে, বিশেষ করে পুলিশের একাংশের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশ্নের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। অনেক সময় মনে হচ্ছে, নবান্নের উচ্চমহল ঠিক যে ভাবে যে তৎপরতা এবং কঠোরতায় কোনও বিষয়ে ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হয়, ফলিত স্তরে সর্বদা ঠিক সেই ভাবে তা এগোয় না।

তবে কি কোথাও কেউ পিছু টেনে ধরছে? কোনও দোলাচল? কোনও ‘রহস্যময়’ অনীহা, উদাসীনতা, কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে এক প্রকার গা-এড়ানোর মানসিকতা কি কাজ করছে? যদি তা হয়ে থাকে তবে বলব, প্রবণতাটি রাজ্যের পক্ষে খুবই উদ্বেগজনক। ছিদ্র বেড়ে গহ্বর হতে পারে!

অতি তুচ্ছ একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সবাই জানেন, পুজোর সময় কলকাতার লাগোয়া একটি নামকরা মণ্ডপ নিয়ে অভিযোগ উঠল। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা করতে বললেন। সেটা চতুর্থীর সন্ধ্যা। অথচ তাঁর নির্দেশ কার্যকর করাতে গড়িয়ে গেল অষ্টমীর মধ্যরাত! মাঠে নামতে হল মুখ্যসচিবকেও। ব্যবস্থা করার মূল দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশের কাজে এ-হেন গয়ংগচ্ছতা কি প্রত্যাশিত ছিল?

ছবি আর একটু বড় করে আমতার আনিস-কাণ্ড এবং রামপুরহাটের বগটুই-কাণ্ডের দিকে তাকানো যাক। দু’টিই অতি মর্মান্তিক। রাজ্যের পক্ষেও চরম দুর্বিপাকের উদাহরণ। আর উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গেল পুলিশের কার্যকলাপ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ও সন্দেহ।

আনিস-কাণ্ডে প্রথম কয়েক দিন পুলিশ এবং প্রশাসন ‘ভুল’ বুঝিয়েছিল বললে হয়তো খুব ভুল হবে না। নইলে গভীর রাতে উর্দিধারী পুলিশই যে আনিসের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে তাড়া করে এবং তাঁর পরিবারকে আটকে রাখা হয়, সেই নিখাদ সত্যিটা নিশ্চিত করতে কি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর তিন দিন লাগে!

কেন এমন হবে? কারণ জানা নেই। তবে এটুকু বোঝা গিয়েছে, ওই ঘটনায় সরকারের মুখ পোড়ানোর পিছনে পুলিশের একাংশের ‘অবদান’ কম নয়।

বগটুইয়ের বেলাতেও যা হল, তা কি নিছক পুলিশের ব্যর্থতা, অদক্ষতা? না কি সচেতন অবহেলা বা অন্য কোনও ‘খেলা’? এগুলি যুক্তি-তর্কের বিষয় হতে পারে। কয়েক জন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি ব্যবস্থা করাও হয়েছে বটে। কিন্তু সর্বোপরি আরও এক বার প্রকাশ্যে এসে পড়েছে পুলিশের ‘হাত’ দিয়ে সরকারের মুখে কালিলেপন।

পুলিশ, প্রশাসন, এ সব কোনও অবয়বহীন বায়বীয় পদার্থ নয়। ‘নিরপেক্ষতা’ বিষয়ক সকল তত্ত্ব ও ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে স্বীকৃত সত্যটি হল, তারা সর্বত্র সর্বদাই ক্ষমতাসীনের দিকে ঝুঁকে থাকতে অভ্যস্ত। কারণ গদিতে যাঁরা, তাঁদের আদেশ মেনে চলা যুগ যুগ ধরে সাধারণ রীতি। এ কথাও অনস্বীকার্য যে, প্রশাসন ও পুলিশের উপর সব আমলেই শাসকবর্গের রাজনৈতিক চাপ থাকে। উপরন্তু বড় নেতা-নেত্রী-মন্ত্রীদের বিবিধ ‘বেফাঁস’ সামলাতে গিয়েও অনেক সময় তাঁদের ছুঁচো গেলার হাল হয়!

তথাপি আপাত ভাবে একটি ভারসাম্য বজায় রেখে চলা পুলিশ ও আমলাদের দক্ষতার একটি দিক। সরকার বিপাকে না পড়ে, সেটা দেখা তাদের কাজ। যে পুলিশ ও প্রশাসনের উপর নির্ভর করে সরকার কাজ করে, একের পর এক ঘটনায় তাদের কার্যকলাপে এত ফাঁক ধরা পড়বে কেন? প্রশাসন-যন্ত্রের কলকব্জা যদি নড়বড়ে হয়, তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে।
মনে আছে, কলকাতায় এক বার শাবানা আজমির কোনও শুটিংয়ে সিপিএমের এক প্রভাবশালী ‘দাদা’ ঝামেলা করায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। শাবানা মহাকরণে ফোন করে মুখ্যসচিবকে সরাসরি অভিযোগ জানান। মণীশ গুপ্ত তখন মুখ্যসচিব। তৎক্ষণাৎ তাঁর নির্দেশে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। সমস্যা মেটে।

শাসক-নেতাকে গ্রেফতারের অভিযোগ দ্রুত পৌঁছয় জ্যোতি বসুর কাছে। তিনি মুখ্যসচিবকে ডেকে বলেন, “এ সব কী শুরু করেছেন?” যত দূর জানি, মণীশবাবু উত্তরে বলেছিলেন, “স্যর, একটি গ্রেফতার যদি সরকারের ভাল ইমেজ তৈরি করে, চিফ সেক্রেটারি হিসেবে সেটাই করা উচিত বলে মনে করি। নইলে বিষয়টি অন্য ভাবে ছড়াত।” জ্যোতিবাবু মেনে নিয়েছিলেন।
পরিহাস হল, আজ এমন ভাবনাও খুব সুলভ নয়। বদলেছে প্রশাসন ও পুলিশের কাজের ধারা। শঙ্খ ঘোষের পঙ্‌ক্তি মনে রেখে বলি, সেই ফাঁক দিয়েই হয়তো ‘নিষাদেরা জেগেছে সমাজে’। যাদের ‘হাতে লাঠি, কানে জবাফুল’!

আরও পড়ুন
Advertisement