Los Angeles Hughes Fire

যে আগুন সব পোড়ায়

লস অ্যাঞ্জেলেসে শুরু হওয়া দাবানলের শিকার-তালিকা সুদীর্ঘ: বারো হাজারের বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভস্মীভূত, প্রায় দু’লাখ মানুষ ঘরছাড়া, মৃতের সংখ্যা ত্রিশ পার, বহু মানুষ আজও নিখোঁজ।

Advertisement
সারস্বত সেন
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৫৮

পঞ্চাশ বছর কেটেছে মালিবুর এই বাড়িতে। এখানেই তিনি ও তাঁর স্ত্রী বড় হতে দেখেছেন তাঁদের সন্তান, পরের প্রজন্মকেও। কত স্মৃতি জড়িয়ে এই বাড়ির গায়ে— বা বলা ভাল জড়িয়ে ছিল। আগুন মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে অভিনেতা বিলি ক্রিস্টালের সাধের ঘর। সপ্তাহ দুয়েক আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে শুরু হওয়া দাবানলের শিকার-তালিকা সুদীর্ঘ: বারো হাজারের বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভস্মীভূত, প্রায় দু’লাখ মানুষ ঘরছাড়া, মৃতের সংখ্যা ত্রিশ পার, বহু মানুষ আজও নিখোঁজ। কেউ খোঁজ নিচ্ছেন ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ির মর্টগেজের কী হবে, কেউ সাধ করে কেনা দামি গাড়ির ক্ষতিপূরণ বিমায় পাওয়া যাবে কি না সেই নিয়ে অস্থির। কেউ সপরিবার হোটেলে বা বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

Advertisement

আগুনের আঁচে পুড়ে গেছে আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও মান-মর্যাদার মইটাও— প্রকৃতির খেয়ালে মানুষ এখন সামাজিক উঁচু-নিচুর ঊর্ধ্বে। ‘ঘরপোড়া’দের এই দলে যেমন আছেন তথাকথিত সাধারণ মানুষ, তেমনই অ্যান্টনি হপকিন্স, মেল গিবসন, জেফ ব্রিজেস-এর মতো মহাতারকারাও। সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ছাইয়ের গাদায় পড়ে থাকা অস্কার স্ট্যাচুর ছবি— এআই দিয়ে তৈরি বটে, তবু মনে করিয়ে দেয় জীবনের অমোঘ সত্য, নগর পুড়লে সেলেব-দেবতারাও নিরাপদ নন।

ক্যালিফোর্নিয়ার অগ্নি-নির্বাপণ ও অন্যান্য জরুরি বিভাগের কর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করছেন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। আগুন এই স্তিমিত হয়, বহু চেষ্টায় নাগালে আসে, ফের জ্বলে ওঠে। এ-ই চলছে। বিপদ এখনও কাটেনি। কী উস্কে দিল এই দাবানল, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বিজ্ঞানীদের মতে জীবাশ্ম জ্বালানির থেকে দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন দাবানলের প্রভাবকে ভয়াবহতর করেছে; দশ বছরে এক বার হওয়া সান্টা অ্যানা ঝড় আগুনের লেলিহান শিখাকে করেছে আরও দ্রুতগামী। পুনর্বাসনের জন্য বহু স্বনামধন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, বহুজাতিক সংস্থাগুলো আর্থিক অনুদান দিচ্ছে, বিনামূল্যে খাবার ও ওষুধ, নতুন বিছানা-আসবাব, ফুড ভাউচার দিচ্ছে। সরকারি সাহায্য তো আছেই। তারকাদের তবু আরও সম্পত্তি আছে, ব্যাঙ্কের লোন মেটানো চাকরিজীবীদের মতো দুরবস্থা তাঁদের নয়। কিন্তু বিপর্যয়ের যে মানসিক চাপ, তাতে ধনী-মধ্যবিত্তে তফাত নেই। দু’পক্ষই সমান অসহায় হয়ে পড়েন। তারকার পরিবারও বিনিদ্র রাত কাটায় যখন তাঁদের প্রিয়জন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেন।

এই ধ্বংসলীলার মধ্যে এ বারের অস্কার অনুষ্ঠান হবে কি না, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস আত্মবিশ্বাসী, অনুষ্ঠান যথাসময়েই করা যাবে। কেউ বলছেন, এ বছর এত আনন্দ-আয়োজন না-ই বা হল; অনুষ্ঠান হলে তাঁরা বয়কট করবেন। স্টিফেন কিং-এর মতো লেখক বলেছেন এই অন্ধকার সময়ে, এই দুঃসহ বিপর্যয়ের মুখে সিনেমার পুরস্কার ঘিরে এত জাঁকজমক অসহ্য, অমানবিক।

আপাতদৃষ্টিতে হয়তো ঠিক, কিন্তু অস্কার অনুষ্ঠান বন্ধ করলেই কি ছাই হয়ে যাওয়া বাড়ি-গাড়ি-ব্যবসা ফিরে আসবে ম্যাজিকের মতো? যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁদের কষ্ট লাঘব হবে? তা তো নয়ই, বরং অন্য এক দল মানুষের কপালের ভাঁজগুলি বাড়বে। অস্কার অনুষ্ঠান শুধুই কোটিপতি তারকা, মনোনীত তথা বিজয়ীদের মঞ্চ নয়; এই দিনটার সঙ্গে জড়িয়ে বহু মানুষের রুজিরুটি। বিশ্বজোড়া বোকাবাক্সে ধরা পড়ে না পর্দার পিছনের সেই মানুষগুলোর অবদান। খাদ্য ও পানীয় সরবরাহকারী, ফুল বিক্রেতা, ড্রাইভার থেকে মঞ্চ-সহায়ক, প্রযুক্তিকর্মী ও আরও অনেকে মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক অস্থায়ী কর্মীর দায়িত্ব থাকে সিনেমার এই মহাযজ্ঞ মসৃণ ভাবে সমাপন করার। সেই অনুষ্ঠান বাতিল করার অর্থ, গড়পড়তা হিসাবে কয়েক হাজার মানুষের রোজগার কেড়ে নেওয়া। অতিমারির অভিঘাত কাটিয়ে যখন ব্যবসা আবার স্থিতাবস্থা ফিরে পাচ্ছে, তখন এই বয়কটের বেসুর কি নিষ্ঠুর শোনায় না?

মহাবিপর্যয়ের চরিত্র এমনই, সময় ও জীবনের বড় সিদ্ধান্তগুলিকে সে লড়িয়ে দেয় মানসিকতার, মানবিকতার দ্বন্দ্বযুদ্ধে। এমন নয় যে আমেরিকার এই অঞ্চলগুলিতে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগে ঘটেনি— দাবানলকে সহজ স্বাভাবিক ভূপ্রাকৃতিক বিপর্যয় বলেই দেখে আসা হয়েছে এত কাল। এমন নয় যে আগে পুড়ে যায়নি ঘরবাড়ি, বনের পশুপাখি, মানুষের সহায়সম্বল— অতীতের ক্ষতির সব খতিয়ানই লেখা আছে আঞ্চলিক ইতিহাসে। কিন্তু এ বারের এই বিপর্যয় যেন অন্য রকম: ভূপ্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক দুর্যোগের ও-পারে এক ‘দার্শনিক’ বিপর্যয়ও। এমনিতে দুর্যোগের সঙ্গে নিয়তিবাদের একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে, ছাপোষা সাধারণ মানুষ যে কোনও দুর্যোগকে ভাগ্যবিপর্যয়ের সমার্থক করে তোলেন। লস অ্যাঞ্জেলেসের এ বারের আগুন সেই নিয়তিবাদকে এনে ফেলেছে বহু তারকা-মহাতারকার দুয়ারেও। প্রচারমাধ্যমে সব দেখেশুনে গড় আমেরিকাবাসী বলছেন— তা হলে বোঝা গেল, শুধু সময় নয়, আগুনও ‘গ্রেট লেভেলার’! মানুষের সমাজের তাবৎ ভেদরেখা, ডলারের বৈষম্য তার কাছে কিচ্ছুটি নয়, ‘আঙ্কল স্যাম’-এর দেশের হরিপদ কেরানি আর আকবর বাদশাকেও সে এক ধাক্কায় দাঁড় করিয়ে দিতে পারে একই ছাইগাদার সামনে।

বাজার বিষম বস্তু। অস্কার অনুষ্ঠানের আয়োজনে তাই ব্যত্যয় হবে বলে মনে হয় না, হয়তো নীরবতা পালন হবে খানিক। তারকাদের মনের ভিতরটা দেখা যায় না বলে রক্ষা, নইলে সেখানেও হয়তো পাওয়া যেত দীর্ঘশ্বাস, ছাইচাপা পড়ে আছে।

Advertisement
আরও পড়ুন