স্নিগ্ধ: নন্দলাল বসুর চিত্রকৃতিতে বাংলার গ্রামজীবন, সহজ পাঠ-এ।
চ ছ জ ঝ দলে দলে/ বোঝা নিয়ে হাটে চলে”— সহজ পাঠ-এ অক্ষরগুলো নিজেরাই এক-একটা গল্পের চরিত্র। বাংলা অক্ষর আর অন্ত্যমিলযুক্ত দ্বিপদীর মধ্য দিয়ে আমরা খোঁজ পাই রবীন্দ্রনাথের বাংলার। নদী বেয়ে যাওয়া ডিঙির বুকে একা মাঝির উদাস সুর মিশে যায় ক খ গ ঘ-এ। এ ভাবেই প্রতিটি অক্ষরের ভূগোলে পাঠক আবিষ্কার করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের চোখে গ্রাম-বাংলার মনোরম রূপ।
বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রনাথ, দুইয়ের প্রতি ভালবাসা থেকেই সম্প্রতি হাতে তুলে নিয়েছিলাম সহজ পাঠ। দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে আর গানের প্রতি টানের সূত্রে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক গান ও কবিতার সঙ্গে পরিচয় ছিল আগে থেকেই, নিজে বাঙালি না হওয়া সত্ত্বেও। পরিচয় ছিল নানা বিষয়ে ওঁর লেখালিখি নিয়ে— যেমন জাতীয়তাবাদের বিপদ বা উদারবাদী হিন্দুধর্মের নানা সম্ভাবনা। ‘একলা চলো রে’-র একটা গিটার-রূপও তৈরি করেছিলাম অবসরে।
সহজ পাঠ পড়তে গিয়ে, বাংলা স্বরবর্ণগুলির সঙ্গে নিজের এত দিনের হিন্দিভাষী সত্তার আলাপের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সময়ের নতুন নতুন দিক খুলে গেল আমার কাছে। সহজ পাঠ-এর সুরেলা ছন্দ ও দৃশ্যকল্পে যেমন আনন্দ পাচ্ছিলাম, তেমনই কিছু প্রশ্নও জাগছিল— তার রোম্যান্টিক গ্রামজীবন নিয়ে, জাতপাত ও লিঙ্গবৈষম্যের আবছা উপস্থিতি নিয়েও।
রবীন্দ্রনাথ কেন প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা পাল্টাতে চেয়েছিলেন, তা বুঝতে গেলে ফিরতে হবে ওঁর নিজের স্কুলবেলার কথায়। ছেলেবেলা-য় তিনি লিখেছেন ক্লাসরুমের বিষণ্ণ একাকিত্বের কথা, ‘দশটা চারটার আন্দামান’-এ তাঁর নির্বাসনের অনুভব: “দিনগুলো এমনি চলে যায় একটানা। দিনের মাঝখানটা ইস্কুল নেয় খাবলিয়ে, সকালে বিকেলে ছিটকিয়ে পড়ে তারই বাড়তির ভাগ। ঘরে ঢুকতেই ক্লাসের বেঞ্চি-টেবিলগুলো মনের মধ্যে যেন শুকনো কনুয়ের গুঁতো মারে। রোজই তাদের একই আড়ষ্ট চেহারা।”
এর উল্টো ছবিটাই সহজ পাঠ-এ। সেখানে কল্পনা ছুটে বেড়ায় বাধাহীন। চোখ-রাঙানো শিক্ষক নেই, ধুলো-পড়া লাইব্রেরি নেই। শেখার কাজটা ঘটে অন্যত্র: বাজারের হইচইয়ের মধ্যে, হাতির পিঠে, বাঁশের ডগায়, এমনকি স্বপ্নেও— ‘একদিন রাতে আমি স্বপ্নে দেখিনু—/ “চেয়ে দেখো” “চেয়ে দেখো” বলে যেন বিনু।/ চেয়ে দেখি, ঠোকাঠুকি বরগা-কড়িতে,/ কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।’
সহজ পাঠ-এর বেশির ভাগ অংশেরই পশ্চাৎপট প্রত্যন্ত গ্রামবাংলা। সেখানে টুকরো কত দৃশ্য: মাঠ ভরা পাট তিসি তিল; কুকুরের হাত থেকে বাঁচতে বাঁদরের হুটোপুটি; পাড়ার হাট থেকে বয়স্ক মানুষটির আটা, ডাল কেনা। এক জলাশয়ের কত না প্রকারভেদ— পুকুর, দিঘি, ডোবা। বাংলার পাখপাখালির বিচিত্রতাও পাতায় পাতায়, পানকৌড়ি থেকে বৌ কথা কও, কোকিল।
সৃষ্টিশীলতাকে জাগিয়ে তোলা এই বিস্ময় আর খেয়ালরস-ই সহজ পাঠ-কে প্রিয় করে তোলে সকলের কাছে, এমনকি বাংলার বাইরেও। ১৯৭০ সালে মরাঠি লেখক পি এল দেশপাণ্ডে প্রথম বার শান্তিনিকেতনে এলেন, সহজ পাঠ নিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ তো বিস্তর লিখেছেন— কবিতা, নাটক, উপন্যাস, ভ্রমণকথা, আরও কত। কিন্তু শুধু সহজ পাঠ লেখার জন্যই তিনি প্রণম্য। ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ বা ‘চুরি করিবে না’ গোছের শুকনো কথায় ভরা অনুচ্ছেদ নয়, এর প্রতিটি পাঠই আসলে একটা যাত্রা— আবেগ, অনুভূতি, রং, গন্ধের। বাঙালি প্রজন্মগুলি এই বইকে পাঠ্য হিসেবে পড়ে চলেছে। সরকারও যে দলেরই হোক, শিক্ষা সব সময়ই রবীন্দ্রমুখী। সহজ পাঠ বাংলাকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপহার।
দেশপাণ্ডে এই বইকে দেখেছিলেন রাজনীতি ও মতাদর্শের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ব্যাপার ঠিক অতই সহজ কি? সহজ পাঠ-এ কল্পনা যতই ডানা মেলুক, খতিয়ে দেখলে তাতে সমাজ ও রাজনীতির ছবিটা তত উদার না-ও মনে হতে পারে। গ্রামজীবনকে রোম্যান্টিক দেখানো সত্ত্বেও গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবটা যেন একটু অবজ্ঞার। সহজ পাঠ-এ শুধুই যেন ভদ্রলোক বাবুর কথা, সবটুকু সম্মানের প্রাপক তাঁরাই, মহিলা ‘কাজের লোক’, কৃষক বা জনজাতি মানুষেরা নয়। দেখেশুনে মনে হয় যেন এই সমাজ-কাঠামোয় জাতপাত আর পুরুষতন্ত্র দুই-ই বেশ জোরদার, অন্য দিকে মেলে হালকা হিংসা ও বঞ্চনার আভাসও।
অত্যাচারী জমিদার দুর্লভবাবু নিচু জাতের মজুর উদ্ধবকে শাস্তি দেয়, মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে সে গ্রামের পুকুর থেকে মাছ ধরার স্পর্ধা করেছে বলে। অথচ গ্রামের পুকুরটি নিজে কুক্ষিগত করলেও দুর্লভবাবুর কোনও শাস্তি বা সমালোচনা হয় না। শেষে উদ্ধবের উপর চাপানো বিপুল জরিমানা গোপনে মিটিয়ে দেন দুলর্ভবাবুর পিসি— কর্মফলের ভয়ে। অন্য এক গল্পে শিকারের ব্যর্থতায় অবসন্ন শক্তিবাবুর সঙ্গে ফেরার পথে দেখা হয় এক দল কাঠুরের। তিনি তাদের কাছে ধরে বসেন, “তোমাদের ঘরে নিয়ে চলো। রাস্তা ভুলেছি। কিছু খেতে দাও।” তারা যত্ন করে খেতে দেয়— তালপাতার ঠোঙায় চিঁড়ে, বনের মধু, ছাগলের দুধ, ভাঁড়ে করে নদীর জল। পরে কাঠুরিয়াদের সর্দার পথ দেখিয়ে নৌকায় পৌঁছে দিলে, শক্তিবাবু একটা দশ টাকার নোট ওদের দিতে চান, “বড়ো উপকার করেছ, বকশিশ লও।” কাঠুরিয়া সর্দার হাত জোড় করে বলে, “মাপ করবেন, টাকা নিতে পারব না, নিলে অধর্ম হবে।” নমস্কার করে চলে যায় তারা।
ভদ্রলোক আর গ্রাম্য সম্বলহীনের ক্ষমতার সমীকরণটা এখানে হাট হয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পূর্বজরাও জমিদার ছিলেন, সেই অভিজাত ও উচ্চবংশীয় জমিদারের ‘ক্যারিকেচার’ হিসেবে দেখলেও দুর্লভ ও শক্তিবাবুর মতো চরিত্রগুলি কিন্তু অসহায় নিপীড়িতদের শোষণ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ধরে বিলক্ষণ।
জাতপাতের কথা আছে সূক্ষ্ম ভাবে। একটি পাঠে স্মৃতির রঙে রাঙিয়ে বলা আছে পৈতের ব্যাপক প্রস্তুতির কথা। কুলতিলকের মতো বাঘের গল্পটি পড়া যেতে পারে জাতিভেদের ধারণার আলোয়, ডোরাকাটা দাগ সেখানে উঁচু জাতের লক্ষণ। তার পাশে কুলতিলকের মতো ছিট ছিট দাগের বাঘ যেন অসভ্য আর নচ্ছার, অন্য বাঘেদের কাছে “ওর রকমটা ভালো ঠেকছিল না।” জাতি ও শ্রেণিবৈষম্যের গা ঘেঁষেই আসে লিঙ্গভেদ। প্রায় কোনও পাঠেই প্রধান চরিত্র হিসেবে মেয়েদের দেখা মেলে না, যেটুকুতে মেলে সেখানেও মেয়েরা কেবল ঘরের কাজে কোণঠাসা। তারা শুধু শ্বশুরবাড়ির লোকেদের রেঁধেবেড়ে খেতে দেয়, ঘর পরিষ্কার করে, বা বিয়ের অপেক্ষায় থাকে। পুরুষেরা যা যা কাজ করে তা করতে মেয়েরা পথে বেরোচ্ছে, বা তাদের সে ক্ষমতাটুকুও দেওয়া হচ্ছে, এমন উদাহরণ হাতে গোনা। ঘরে বাইরে-র বিমলা বা চোখের বালি-র বিনোদিনীর মতো নির্ভীক স্পষ্টভাষী নারীদের পাশে সহজ পাঠ-এর মেয়েদের তুলনাই চলে না। তারা নিতান্ত অবলা, পশ্চাদ্গামিনী।
সহজ পাঠ পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক হয়েছিল ১৯৬৯-এ, কিন্তু অচিরেই তা রাজ্যের শিক্ষানীতিতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ‘প্রাইমার’ হিসেবে তা ছাত্রছাত্রীদের বিতরণ করা শুরু হয় বিনামূল্যে। পাশাপাশি তার সমালোচনার সুরটিও জেগে ওঠে। বিশেষত বামপন্থীরা বলেন, এতে বাংলার সমাজবাস্তবতার প্রকৃত ছবিটি ফুটে ওঠেনি, এ যেন শহুরে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পাঠকদের ভেবে লেখা— গ্রামের যে শ্রমজীবী মানুষদের প্রকৃত শিক্ষা ও সাক্ষরতা প্রয়োজন, তাঁদের জন্য এ নয়।
অনেকে বললেন, সহজ পাঠ-এর সম্পূরক পাঠ হিসেবে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় পড়ানো হোক। অনেকে বললেন, নতুন প্রাইমার লেখা হোক। তাঁদের মতে, রবীন্দ্রনাথের ভাব-ভাষার সৌন্দর্য সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সহজ পাঠ যথোপযুক্ত নয়। রবীন্দ্রপ্রেমীরা বললেন, সহজ পাঠ বর্জন পিতৃদ্রোহের শামিল। শেষ বিচারে অবশ্য রবীন্দ্র-ঐতিহ্যই বলবৎ থাকল, নব্বইয়ের দশকে সহজ পাঠ ফিরল আবার। আজও সে বাঙালি নবপ্রজন্মকে ‘শিখিয়ে’ চলেছে।
গবেষক, ব্রাউন ইউনিভার্সিটি