glasgow

কার পাশে দাঁড়াল ভারত

বহু ভারতীয়ের জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কয়লার উপর নির্ভরশীল।

Advertisement
অদিতি মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২১ ০৪:৩৫

ভালই হয়েছিল শুরুটা, কিন্তু শেষরক্ষা হল না। গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে চার দিক থেকে সমালোচনা শুনতে হল যে, ভারতই জলবায়ু চুক্তি দুর্বল করেছে। বিদ্যুৎশক্তির জন্য কয়লার ব্যবহার দ্রুত কমিয়ে আনার যে অঙ্গীকার উন্নত দেশগুলো করতে চেয়েছিল, ভারতের জন্যই তার ভাষায় অনেকটা জল মিশেছে, এমনটাই সবার মত। ভারতের কোটি কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিপন্ন হয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যেই। তা হলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য বিশ্বের সব দেশ যেখানে লক্ষ্য বাঁধতে চাইছে, ভারত তাকে নীচে নামাতে চাইছে কেন?

ভারতের অবস্থানকে যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁরা বলছেন যে, তেল বা গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর লক্ষ্য স্থির না করে কেবল কয়লাকে বাতিল করতে চাওয়া অন্যায়। ভারত তার বিদ্যুতের জোগানের জন্য প্রধানত কয়লার উপরেই নির্ভর। দ্রুত অন্য জ্বালানিতে সরতে গেলে তার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। সেই আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা না করেই কয়লার ব্যবহার কমাতে গেলে কয়েক কোটি ভারতীয় জীবিকা হারাবেন। যদিও উন্নত দেশগুলোই কার্বন নিঃসরণ করে বেশি, তাই তাদেরই উপর উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের দায় বর্তায় বেশি, তবু উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ক্ষতিপূরণ এবং আর্থিক সহায়তার দায় সেই সব দেশ কতটা নেবে, সে ব্যাপারে সম্মেলনের চুক্তির ভাষা আদৌ স্পষ্ট বা জোরালো নয়। সেই দৃষ্টিতে ভারতের অবস্থান হয়তো ধনী দেশগুলোর উপর একটা চাপ বজায় রাখল, যাতে ২০২২ সালে মিশরে জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধের আর্থিক দিকগুলি (বিনিয়োগ ও ক্ষতিপূরণ) নিয়ে যে আলোচনা হবে, সেখানে আরও জোরালো ভাষা এবং বেশি বরাদ্দ পাওয়া যায়।

Advertisement

বহু ভারতীয়ের জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কয়লার উপর নির্ভরশীল। তাঁদের রোজগার যাতে বাঁচে, তা নিশ্চিত করতে হবে, এমনটাই ভারতের অবস্থান। মুশকিল হল, এর ঠিক উল্টোটা হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এতই দ্রুত হচ্ছে, তার প্রভাব এত ছড়াচ্ছে যে, যাঁঁদের জীবন-জীবিকা বাঁচাতে ভারত ধীরে পদক্ষেপ করতে চাইছে, তাঁরাই হয়তো এ দুটোই হারাবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞদের প্যানেল সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ধরনের প্রভাবের সঙ্গে ইতিমধ্যেই যুদ্ধ করছে। গ্রাম এবং শহর, সর্বত্রই সর্বাধিক বিপন্ন হচ্ছেন দরিদ্র, মহিলা, ভূমিহীন, দলিত ও আদিবাসীরা। বন্যা, খরার মতো বিপর্যয় ঘন ঘন হওয়ার ফলে খাদ্য ও পানীয় জলের নিরাপত্তা ব্যাহত হচ্ছে। তীব্র গরম ও উচ্চ আর্দ্রতার ফলে মানুষ কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন । উষ্ণায়ন যত তীব্র হবে, ততই সবের প্রভাব বাড়বে।

বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ অন্তত ৪৫ শতাংশ না কমাতে পারি, তা হলে আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন রুখে দেওয়ার নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না। উন্নত দেশগুলির উপর কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর নৈতিক দায় বেশি, এ কথা ঠিক। কিন্তু এও পরিষ্কার যে, ভারতে জলবায়ু বিপর্যয় শিয়রে সংক্রান্তি হয়ে দেখা দিয়েছে, তাই আস্তে-ধীরে কম নিঃসরণের পথে হাঁটার দিন আর নেই। তাতে দরিদ্রের ঝুঁকি আরও বাড়বে।

ভারত আজ এক অদ্ভুত মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দিকে ভারত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণের নিরিখে আমেরিকা আর চিনের পরে তৃতীয় স্থানে রয়েছে (যদিও মাথাপিছু নিঃসরণ এখনও খুব কম)। আমেরিকা আর চিনও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর দাবিকে প্রতিরোধ করে এসেছে— গ্লাসগোতেও করেছে। অন্য দিকে, ভারতের স্থান সব চাইতে ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলির সঙ্গে। তার কারণ দুটো। এক, কর্কটক্রান্তি রেখার কাছাকাছি ভারতের অবস্থান, যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল— ঝঞ্ঝা, বন্যা, উচ্চ আর্দ্রতা, প্রখর গ্রীষ্ম— ভারতের মানুষকেই ভোগ করতে হবে। দুই, অন্য দেশগুলির তুলনায় দারিদ্র বেশি; অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ঝুঁকিও বেশি। তাই অধিক দূষণকারী উন্নত দেশগুলির তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভারতের ঝুঁকি বেশি।

গ্লাসগোর সম্মেলন ভারতকে একটা সুযোগ দিয়েছিল— গ্রীষ্মমণ্ডলের অন্যান্য যে সব অনুন্নত দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন, তাদের নিয়ে জোট বেঁধে উন্নত দেশগুলোকে আরও দায়বদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে বলা ছিল, প্রতি বছর ধনী দেশগুলি দরিদ্র দেশগুলিকে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেবে, যাতে তারা স্বচ্ছ শক্তির পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ-সহ পরিবেশবান্ধব নানা ব্যবস্থা করতে পারে। পাঁচ বছরে সেই খাতে পাওয়া গিয়েছে মাত্র আশি বিলিয়ন ডলার। ভারত এই দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিতে পারত।

আর একটি দাবি উঠেছে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ তৈরি করার জন্য, যা পরিবেশ-উদ্বাস্তুদের সহায়তা করবে। ভারতের এমন সহায়তার কত প্রয়োজন, তা সুন্দরবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দরিদ্র দেশগুলো এই দাবি কয়েক দশক ধরে তুলছে। ইদানীং কয়েকটি চুক্তিতে তার উল্লেখ করা হয়েছে কেবল, লিখিত অঙ্গীকার করেনি কোনও দেশ। এই দাবিকে আরও জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে পারত ভারত। বহু বছর ধরে উন্নত দেশগুলি যে দূষণ করেছে, আজ তাতেই বিপন্ন দরিদ্র দেশগুলি। তাদের জন্য ন্যায় দাবি করলে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হত না কি?

কিন্তু দেখা গেল, ভারত শেষ অবধি আমেরিকা এবং চিনের মতো উন্নত দেশগুলির অবস্থানই গ্রহণ করল। তাদের মতোই, জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করার কর্মসূচি রূপায়ণে আরও বেশি সময়ের দাবি তুলল। এর ফলে ভারতের বিপন্ন মানুষদেরই ক্ষতি হবে, সেই আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

আইপিসিসি বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য

আরও পড়ুন
Advertisement