ভোটের জন্য রাজনৈতিক দলগুলি সাধ্যের সীমা অতিক্রম করছে
Government Scheme

প্রতিশ্রুতির বিপদ

অমৃতকুম্ভের মতো তাঁরা খুঁজে চলেন এমন নীতি এবং প্রকল্প, যা একই সঙ্গে বহু লোকের কাছে পৌঁছবে, এবং বহু ভোটের জোগান দেবে। সম্প্রতি মনে হচ্ছে যে, অনুদান এবং খয়রাতিতেই এই বিশল্যকরণীর হদিস পেয়েছেন নেতারা।

Advertisement
অশোক কুমার লাহিড়ী
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:১৭

আমাদের বিবিধ রাজনৈতিক দল এবং সেগুলির নেতারা ‘বহু জন হিতায়’ কাজ করতে সর্বদাই উদ্‌গ্রীব। তবে, তাঁরা এ কথাও কখনও ভোলেন না যে, তাঁদের কাজ ‘বহু ভোট জুগায়’ না হলে নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় আসা যাবে না। অতএব, অমৃতকুম্ভের মতো তাঁরা খুঁজে চলেন এমন নীতি এবং প্রকল্প, যা একই সঙ্গে বহু লোকের কাছে পৌঁছবে, এবং বহু ভোটের জোগান দেবে। সম্প্রতি মনে হচ্ছে যে, অনুদান এবং খয়রাতিতেই এই বিশল্যকরণীর হদিস পেয়েছেন নেতারা।

Advertisement

সাম্প্রতিক রাজ্য নির্বাচনগুলিতে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিভিন্ন দল— নারীদের জন্য নগদ হস্তান্তর, বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার, কৃষকদের নিঃশুল্ক বিদ্যুৎ, কৃষকদের ঋণ মকুব, বিনামূল্যে খাদ্য প্যাকেট এবং স্মার্ট টেলিফোন, এমনকি মহিলাদের স্কুটার। এই সব প্রকল্পই অমৃতকুম্ভের শর্ত পূরণ করে— অনেকের কাজে যেমন লাগে, তেমন অনেকের ভোটও এনে দেয়।

কিন্তু এগুলি কি হঠকারী এবং সরকারের আর্থিক ক্ষমতার নাগালের বাইরে? সাধ্যের তুলনায় বেশি প্রতিশ্রুতির পরিণাম আমরা সরকারি হাসপাতালে নিঃশুল্ক চিকিৎসার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার থেকে ভাল ভাবেই জানি। পরিষেবা নিঃশুল্ক, তবে সে হাসপাতালে শয্যা খালি পাওয়াই দুষ্কর। ওষুধ এবং অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার নিদারুণ অভাব। অসীম দুর্ভোগ। বেশির ভাগ মানুষ, এমনকি দুঃস্থরাও, সরকারি ছেড়ে বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ। প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ঊর্ধ্বে বিনামূল্যে টার্শিয়ারি বা কঠিন চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি কি সরকার সময়ের বেশি আগে দিয়ে ফেলেছে?

দারিদ্র দূরীকরণ সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের বীজমন্ত্র। প্রশ্ন হল, দরিদ্র কে? এবং, দরিদ্রকে চিহ্নিত করার উপায় কী? কে গরিব এবং কে গরিব নয়, তার সংজ্ঞা দেশ এবং কাল, দুইয়ের উপরেই নির্ভরশীল। আয়ের নিরিখে, ভারতের অনেক মধ্যবিত্তই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গরিব হিসাবে পরিগণিত হবেন। আবার, দেশের সার্বিক অবস্থার উপরেও নির্ভর করে যে, কে গরিব আর কে নন। ৪০-৫০ বছর আগে যে আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন মানুষকে মধ্যবিত্ত বলে মনে হত, দেশের সার্বিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আজকে যাঁদের জীবনযাত্রার মান সেখানেই দঁড়িয়ে আছে, তাঁদের মধ্যবিত্ত বলে মনে না হয়ে গরিব মনে হতেই পারে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগান্তকারী উন্নতি হয়েছে। ফলে, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি স্বাধীনতা অর্জনের পরে, বিগত পাঁচ-সাত দশকে গরিব বা নিম্ন আয়ের উপনিবেশগুলি এখন নিম্ন-মধ্য আয় বা মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ১৯৯০ সালে ১০ জন গরিবের মধ্যে ৯ জন থাকতেন নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে, এখন ৪ জনের মধ্যে ৩ জন গরিব থাকেন নিম্ন-মধ্য বা মধ্য আয়ের দেশগুলিতে। আগে যাঁরা মধ্যবিত্ত হিসাবে পরিগণিত হতেন, তাঁদের অনেকেই আজকে নিজেদের দরিদ্র ভাবেন।

কে গরিব আর কে গরিব নন, সেই বাছাই করার জন্য কোন গোত্রের মাপকাঠি ব্যবহার করব, তা অনেকাংশে নির্ভর করে বাছাই করা গরিবদের নিয়ে কী করা হবে, তার উপরে। যদি উদ্দেশ্য হয় দারিদ্র দূরীকরণের প্রকল্পের সাফল্য-ব্যর্থতার পর্যালোচনা করা, তা হলে দারিদ্রের এক রকম সংজ্ঞা ব্যবহৃত হবে, আর যদি দরিদ্রদের সহায়তা দিতে চাই তা হলে আর এক রকম। সহায়তার ক্ষেত্রে, সীমিত ক্ষমতার তুলনায় অনেক উদারপন্থী মাপকাঠি নিলে সব ঘোষিত যোগ্য সুবিধাভোগীকে সহায়তা দেওয়া যাবে না, সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার দুর্নীতি বাড়বে এবং সরকারের উপর মানুষের আস্থা কমবে। হিতে বিপরীত হবে।

দরিদ্র চিহ্নিতকরণের কাজটা সরল হলে, দারিদ্র নিরসনের প্রচেষ্টাও অনেকটা সহজ হত। গরিবদের চিহ্নিত করা গেলে, সাধ্যের অতীত ‘অতিরিক্ত’ খরচের সমস্যাটিও অনেকটাই দূর হত— যাঁরা প্রকৃতই গরিব, শুধুমাত্র তাঁদের জন্যই খরচ করত সরকার। গরিবদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য, চিকিৎসা, কৃষির জন্য সস্তায় বিদ্যুৎ পাওয়া উচিত— নীতিগত ভাবে বেশির ভাগ মানুষই এই কথাটির সঙ্গে সহমত হবেন। যাঁরা গরিব নন, তাঁরা এই সুবিধাগুলি পান বলেই মানুষ অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাঁদের আয় নির্ধারণ করা দুষ্কর। ফলে, কে গরিব আর কে নন, আয়ের ভিত্তিতে সে কথা বলাও কঠিন।

স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তা বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দেওয়া ‘নিম্ন’ আয়ের শংসাপত্রের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এলাকার কোনও মানুষকে, সন্দেহ সত্ত্বেও, ‘নিম্ন’ আয়ের সার্টিফিকেট দেওয়ায় স্থানীয় অধিকর্তাদের কোনও ব্যক্তিগত ক্ষতির আশঙ্কা কম— বরং, না-দিলেই জনপ্রিয়তা কমে এবং শত্রু বাড়ে। সুতরাং, তাঁরা সহজেই দিয়ে থাকেন। আয়কর তথ্যও গরিবদের চিহ্নিত করতে তেমন সহায়ক নয়— বর্তমানে ভারতে মাত্র ১০ কোটি মানুষ আয়কর দেন। গরিব নন, তাই স্বেচ্ছায় ভর্তুকি ত্যাগ করবেন, সেই প্রবণতাও বিরল— ২০২১ সালে, ২৪.৭২ কোটি সক্রিয় এলপিজি গৃহস্থালি গ্রাহকদের মধ্যে মাত্র ১.০৩ কোটি মানুষ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এলপিজি ভর্তুকি ত্যাগ করেছিলেন। গরিব মানুষকে চিহ্নিত করার একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা এখনও চিহ্নিত এবং বাস্তবায়িত হয়নি।

জনকল্যাণমূলক প্রকল্প, বিশেষত দারিদ্র দূরীকরণের প্রকল্পে উভয় সঙ্কট— এক দিকে ‘এক্সক্লুশন এরর’ বা যোগ্য প্রাপককে বাদ দেওয়ার ভ্রান্তি, অন্য দিকে ‘ইনক্লুশন এরর’ অর্থাৎ যাঁরা গরিব নন এবং যাঁদের প্রকল্পের প্রাপক হওয়ার যোগ্যতা নেই, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা। নৈতিক বিচার এবং রাজনৈতিক সমালোচনার ভয়ে ‘এক্সক্লুশন এরর’ সব সময়ই ‘ইনক্লুশন এরর’-এর চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। ফলে, প্রকল্পের খরচ বাড়ে।

সীমিত সামর্থ্য নিয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার অনেক বিপদ আছে। প্রথমত, প্রতিটি প্রতিশ্রুতিই দুর্নীতির সম্ভাব্য ক্ষেত্র। যদি সরকারের সাধ্য থাকত অনায়াসে সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতি পূরণ করার, তা হলে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু, সীমিত সামর্থ্যের ফলে প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যবস্থার জোগানও সীমিত, ফলে ন্যায্য প্রাপকদেরও সেই সুবিধা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ‘কাটমানি’ দিতে হয়। সমাজ দুর্নীতিতে এই ভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। দ্বিতীয়ত, প্রতিশ্রুতি পূরণের অর্থ জোগাড়ে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাটছাঁট হয়— যার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিকাঠামোর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও পড়ে। তৃতীয়ত, অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি জনগণের রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আস্থা নষ্ট করে। সৎ রাজনীতির অবকাশ আরও কমে যায়।

সম্প্রতি হিমাচলপ্রদেশ, তেলঙ্গানা এবং কর্নাটকে অবাস্তব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সামনে এসেছে আর্থিক সঙ্কট। এই তিনটি রাজ্যেই গত দু’বছরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে, জয়ী দলগুলি মহিলাদের ১,৫০০-২,৫০০ টাকা মাসিক ভাতা এবং বিনামূল্যে বাস ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। হিমাচলপ্রদেশ এবং কর্নাটকে ছিল কিছু বিনামূল্যে বিদ্যুতের প্রতিশ্রুতিও। তেলঙ্গানায় ছিল মহিলাদের ৫০০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার; কৃষকদের ২ লাখ টাকা ঋণ মকুব এবং প্রতি একরে ১৫,০০০ টাকা বার্ষিক ভাতা; ভাগচাষিদের প্রতি বছর ১২,০০০ টাকা ভাতা এবং প্রবীণ নাগরিকদের জন্য মাসিক ৪,০০০ টাকা পেনশনের প্রতিশ্রুতি।

তিনটি রাজ্যই এখন প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সমস্যার মুখোমুখি। হিমাচলপ্রদেশে আর্থিক সঙ্কট এমনই যে, এ বছর সেপ্টেম্বরে কর্মীদের বেতন সময়মতো দেওয়া যায়নি, মন্ত্রীরা দু’মাসের বেতন না-নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার বকেয়া ১৫০ কোটি টাকা পাওনা আদায় করার জন্য দিল্লির হিমাচল ভবন বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয় আদালত। হিমাচল সরকার ‘ফ্রি’ সুবিধাগুলো প্রত্যাহার বা যুক্তিসঙ্গত করার চিন্তা করছে। আশা করা যায়, অন্য রাজ্যগুলি এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবে।

বিধায়ক, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ

Advertisement
আরও পড়ুন