বিশ্বজয়ের পরেই অন্ধকারে ডুবল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট। —ফাইল চিত্র
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পর বিরাট কোহলী, সেখান থেকে রোহিত শর্মা।
সরফরাজ আহমেদের পর বাবর আজম।
স্বাভাবিক ভাবেই সব দেশে অধিনায়ক বদল হয়। আবির্ভাব হয় নতুন নায়কের। পূজিত হন দু’জনেই।
স্টিভ স্মিথের পর টিম পেন, তারপর কে?
প্রথম দু’টির সঙ্গে এক পংক্তিতে রাখা গেল না উপরেরটি। কারণ, এই অধিনায়ক বদল ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটে নয়, এটি অস্ট্রেলিয়ার। তাদের অধিনায়ক বদল স্বাভাবিক নিয়মে হয় না।
সাড়ে তিন বছর আগে ‘স্যান্ডপেপারগেট’ বিতর্কে সরে যেতে হয়েছিল স্টিভ স্মিথকে। সে বার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সিরিস কাগজ দিয়ে এমন ভাবে বলের চামড়া তুলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেটের ছাল-চামড়া উঠে গিয়েছিল। ক্যামেরন ব্যাঙক্রফট এবং ডেভিড ওয়ার্নারকে নির্বাসিত হতে হয়। পদত্যাগ করেন কোচ ড্যারেন লেম্যান, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ডিরেক্টর মার্ক টেলর এবং হাই পারফরম্যান্স ম্যানেজার প্যাট হাওয়ার্ড।
স্মিথের জায়গায় পেনকে অধিনায়ক করা হয়।
সিংহাসনে বসে পেন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন করতে এসে বলেছিলেন, ‘‘আমরা সবার আগে একটা সংস্কৃতি তৈরি করতে চাই। যে সংস্কৃতির ফসল হবে শুধু ভাল ক্রিকেটার নয়, ভাল মানুষ। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, আমরা জানি। আমাদের থেকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের কী প্রত্যাশা, সেটা আমরা জানি।’’
সেই ‘প্রত্যাশা’ পূরণ হয়ে গিয়েছে। সংস্কৃতির নামে আরও একটি অপসংস্কৃতির জন্ম দিয়ে পেন সরে গেলেন। বিশ্বকাপ জেতার পর সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই আরও একবার অন্ধকারে ডুবল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট। বল বিকৃতির থেকেও এ বারের বিতর্কের অভিঘাত অনেক অনেক বেশি। মহিলা সহকর্মীকে যৌন নিগ্রহ।
বল বিকৃতি কান্ডের পর পেনকে অধিনায়ক করা হয়েছিল ২০১৮ সালের মার্চে। পেন বলেছেন, তিনি ২০১৭ সালেই নিজের এই কুকীর্তির কথা সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ পেনকে অধিনায়ক করার সময় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড বিষয়টি জানত। তারপরেও ‘নতুন সংস্কৃতি’ তৈরির লক্ষ্যে পেনের উপর দেশের ক্রিকেটের গুরুদায়িত্ব দেয় তারা।
পেনও গুরুদায়িত্ব লুফে নেন। সাড়ে তিন বছর ধরে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকেন। যখন দেখেন, তাঁর ‘দায়িত্ব পালন’ করার মার্ক শিট প্রকাশ্যে আসা সময়ের অপেক্ষা, তখন চোখের জল ফেলে সরে গেলেন। একেবারে পকেট থেকে লেখা কাগজ বার করে তিনি জনিয়েছেন ‘ওই ঘটনার সময়ই স্ত্রী এবং পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, বিষয়টি মিটে গিয়েছে। ফলে গত তিন-চার বছর ধরে আমি সম্পূর্ণ ভাবে ক্রিকেটে মন দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখলাম বিষয়টি আর গোপন নেই, জনসমক্ষে এসেছে।’
অর্থাৎ, পেনের সরে যাওয়ার একমাত্র কারণ বিষয়টি জানাজানি হয়ে গিয়েছে। কেউ কিছু না জানলে তিনি ঘাপটি মেরেই পড়ে থাকতেন। উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে রুট-কোহলীদের যথেচ্ছ স্লেজিং করে যেতেন, হয়ত সুযোগ পেলেই পকেট থেকে সিরিস কাগজ বার করে বলের চামড়া তুলতেন, হয়ত ঋষভ-রাবাডাদের বর্ণবৈষম্যের চোখে দেখতেন। হয়ত আরও কত কী। এগুলো সবই যে অস্ট্রেলিয়ার চিরকালের ‘নতুন সংস্কৃতি’।
একই বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, আগামী অ্যাশেজে তিনি খেলবেন, ‘সামনেই অ্যাশেজ সিরিজ আছে। অস্ট্রেলিয়া দলের একজন সদস্য হিসেবে নিজের পুরোটা দেব।’ আরও হয়ত ‘সংস্কৃতির’ জন্ম হবে তাঁর হাত ধরে।
বিবৃতির তৃতীয় অনুচ্ছেদে পেন লিখেছেন, ‘ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার তদন্তে প্রমাণ হয়েছিল, আমি কোনও ভাবেই ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার আচরণবিধি লঙ্ঘন করিনি।’ সত্যিই পেনদের বাড়াবাড়িগুলো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাঁদের জন্য এ বার আচরণবিধির সহজপাঠ, বর্ণপরিচয় লিখতে হবে। সেখানে বলে দিতে হবে, ‘বাবা, মহিলাদের সবসময় সম্মান করতে হয়। তা না হলে অন্যায় হয়। বাছা, মহিলাদের অশ্লীল কথা বলতে নেই, দুষ্টু ছবি পাঠাতে নেই।’ এ বার হয়ত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তাদের আচরণবিধির পরবর্তী সংস্করণে ‘মহিলাদের সম্মানরক্ষা’-র অধ্যায়টি অন্তর্ভুক্ত করবে।
তার পরের লাইনে তিনি লিখেছেন, ‘যদিও নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলাম, সেই ঘটনার জন্য তখনও আমার তীব্র অনুশোচনা ছিল, এখনও আছে।’ ঠিকই, ‘নির্দোষ’ পেনের অনুশোচনা তখনও ছিল, এখনও আছে।
তখনকার অনুতপ্ত পেন ধবধবে সাদা জামা পরে হাসতে হাসতে মাঠে নেমেছেন, স্লেজিং করেছেন। আর জনৈক মহিলার অসম্মান করার সাড়ে তিন বছর পরে অনুতপ্ত পেন এখন কাঁদছেন।